লিসাকে আমি কথা দিয়েছিলাম তাকে নিয়ে লিখবো। এক শব্দহীন, কোলাহলহীন দুপুরে আমরা দু’জন। একজন বলছে… অন্যজন শুনছে। সুনসান নীরব দুপুরে পৃথিবীর সমস্ত মনোযোগ যেন একযোগে সেই মুহূর্তে কথক মেয়েটির দিকে…
আর দশটা স্বাভাবিক শিশুর মতই জন্ম লিসার। বাবা’র সীমাহীন আদর আহ্ললাদে বেড়ে উঠা। শিশুকালের একটি অসুস্থতায় তার জীবনটা ঘুরে যায় অন্যস্রোতে। জীবন তার স্বাভাবিক গতি হারায়। ইয়ার ইনফেকশন থেকে ভুল ট্রিটমেন্টের কারনে অবশেষে “কানে কম শুনা”। আদতে এটি কোন সমস্যা মনে না হলেও, বড় হবার সাথে সাথে এটি বিধাতার একটি অভিশাপ মনে হতে থাকে লিসার কাছে। মধ্যবিত্ত বাবা সাধ্যাতীত অর্থ ব্যয়ে সেই সময়কার নামী ডাক্তার দেখান।
কৈশোরে ভালবাসলো যে যুবক, সে তার কাজিন। লিসা দ্বিধা দ্বন্দ্বে থাকে। তার কি কাউকে ভালোবাসা ঠিক হবে ? এমনই দ্বিধা দ্বন্দ্বের মাঝে এক দুপুরে জানলো, ছেলেটির পরিবার লিসা’র স্পর্ধা আর সাহস নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এই প্রথম তার ভেতরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ভূমিকম্প হয়। অতঃপর বোবা প্রাণীর ন্যায় সবকিছু একরকম মেনেই নেয়। প্রতিবাদী হয়না। প্রতিবাদী হবার মতন দুঃসাহস নেই। সমাজের আর দশটা মানুষের মতন স্বাভাবিক উচ্ছ্বাস নিয়ে জীবন বয়ে নিয়ে যাবার ক্ষমতাতো বিধাতা নিজ হাতেই কেড়ে নিয়েছেন।
যৌবনে পদার্পণ করা লিসা’র বিয়ে ঠিক হয়। যে বাবা কন্যাকে শহরের বাইরে বিয়ে দিবেন না বলে পণ করেছিলেন, তিনিও শেষে নিয়তির কাছে, আশার কাছে, স্বপ্নের কাছে হার মানেন। বিদেশে ভালো ডাক্তার… উন্নত চিকিৎসায় কন্যাটি ভালো হয়ে উঠবে ভেবে রাজী হন। পিতা-কন্যার সেই বিচ্ছেদ পরবর্তী হাহাকার আর ভেতরের আকাশ-বাতাস কাঁপানো বোবাকান্না বিধাতা ছাড়া পৃথিবীর আর কোন প্রাণীই দেখতে পেলো না।
লিসা তার স্বামীর সাথে প্রতারনা করেনি। বিয়ের আগেই জানিয়েছিলো সব। তিনি আমলেই নিতে চাননি। “এটা কোন সমস্যাই না” টাইপের অভিব্যক্তি ছিল হবু স্বামী’র। লিসা ভাবে, একজন মহান মানুষকে পেয়েছে সে। জগত জয় করার আনন্দ যেন তার। সে সৃষ্টিকর্তার কাছে নত হয়… কৃতজ্ঞতা জানায়।
দিন গড়ায়। ফুটফুটে এক সন্তান জন্মায়। বাড়ীর পাশ দিয়ে ট্রেন যায়, মাথার উপর দিয়ে প্লেন যায়__ সেই সব শব্দে ঘুমন্ত শিশুটি কেন জেগে উঠে না… কেঁদে উঠে না, শাশুড়ি চিন্তিত। শুনে স্বামীও চিন্তায় পড়ে যায়। যদিও শিশুটি হিয়ারিং টেস্টে পাশ করেই হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেয়েছে, তবুও তাদের আশংকা থেকেই যায়… যতদিন না নিশ্চিত হয়। শিশুটির কথা বলা শিখতে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি সময় লাগে, বিধায় এটিও লিসার দোষ ! জগত সংসারে একটি মেয়ের সবাইকে খুশী রাখার প্রানান্তকর চেষ্টা… সবকিছুকে পজেটিভ ভাবে নেয়ার মানসিকতা এসবই ভীষণ তুচ্ছ ! যাদের খুব আপন মনে হয়, সেই আপনজনেরাও “কোন এক সুযোগ সন্ধানী”র মতই খোটা দিতে ছাড়ে না। লিসা বুঝে গেছে, এই পৃথিবীর কোন মানুষই তার আপন নয়।
সবশেষে সে আমায় প্রশ্ন করে, “শারীরিক ছোট্ট একটি অক্ষমতা কি এতোটাই শক্তিশালী ? বিধাতা প্রদত্ত এই ত্রুটি কি আমার দোষ ?”
আমি সেই বিষণ্ণ, গম্ভীর মুখখানির দিকে নির্বাক, নিশ্চুপ চেয়ে থাকি। আমার সমস্ত পৃথিবী ক্ষণিকের জন্য থেমে থাকে যেন। আমি ক্ষয়ে যেতে থাকি নিদারুন ভাবে। মনে হতে থাকে___ এমন নীরব অদৃশ্য ক্ষতের চেয়ে, প্রকাশ্যে শরীরের একটি অঙ্গ কেটে দ্বিখণ্ডিত করে দেয়াটা অধিক সুখকর হতো।
২২টি মন্তব্য
ওয়ালিনা চৌধুরী অভি
আপনি তো জীবনের কঠিনতম জায়গা ছুঁয়ে যাচ্ছেন আপনার লেখায়।যা বাস্তবতা।
রিমি রুম্মান
বাস্তবতা… আমাদের আশেপাশের ঘটনা নিয়েই লিখি। এসব থেকে আমরা কেউ যদি সামান্যতম কিছু শিখতে পারি তবেই আমার লেখার সার্থকতা। ভাল থাকবেন।
সোনিয়া হক
অসাধারন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন আপু। আমাদের শিক্ষা,সভ্যতা,ভদ্রতা আসলে মুখোশ মাত্র। সামান্য শারীরিক ত্রুটিকেও আমরা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারিনা, লিসার সমস্ত গুণাবলী চাঁপা পরে যায় সামান্য একটি ত্রুটিতে যা তাঁর নিজসৃষ্ট নয়। আমরা সভ্য হবো কবে ?
রিমি রুম্মান
লিসা’দের দীর্ঘশ্বাস এক অন্তর্যামী ছাড়া কেউ শুনতে পায়না। আমার লেখা থেকে কেউ কি শুনতে পাবে ?
ছাইরাছ হেলাল
জীবন কখনও কখনও পরাস্ত হয় আমাদের চোখের আড়ালে ,আপনি আপনার দেখায়
তা তুলে ধরেছেন।
রিমি রুম্মান
কৃতজ্ঞতা তাদের সবার প্রতি… যারা আমার লেখাটি পড়েছেন। আমার ধারনা, আশেপাশের লিসাদের কষ্ট কেউ না কেউ বুঝতে চাইবে হয়তো লেখাটি পড়ে।
অরণ্য
লিসাদের জন্য শুভকামনা।
রিমি রুম্মান
ধন্যবাদ আপনাকে। ভাল থাকুন সবসময়।
শিশির কনা
অনেক দিন পরে ব্লগে এসে, লেখা পড়ে মন খারাপ হয়ে গেলো আপু। মনে হচ্ছে আমিই লিসা। এই ত্রুটি পুরুষের হলে কিছুই হতো না। সব দায় শুধু নারীর।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। লিসাদের সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ত্রুটির ও ক্ষমা নেই যেন ।
মেঘাচ্ছন্ন মেঘকুমারী
কষ্টের এক অনুভুতি।
রিমি রুম্মান
এমন লেখা লিখতে চাইনা, যা মানুষের মন খারাপ করে দেয়। তবুও কেমন করে যেন নিজের অজান্তেই লেখা হয়ে যায় সেইসব মানুষের কথা… যাদের দীর্ঘশ্বাস কেউ শুনতে পায়না। ভাল থাকবেন।
শুন্য শুন্যালয়
একজন নারীর তো এমনিতেই হাজার ক্ষত, আর যদি এমন বিধাতার দেয়া ক্ষত হয়, তাহলে তো কথাই নেই। দায় যে কার উপর দেব? মন খারাপ হয়ে গেলো।
রিমি রুম্মান
আমি কেবল সবার মনই খারাপ করি নিজের অজান্তেই। ক্ষমা করবেন সবাই।
জিসান শা ইকরাম
জীবন থেকে নেয়া ঘটনা গুলো শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
কবে যে আমরা এসব বুঝবো যে এতে নারীর কোন দোষ নেই।
রিমি রুম্মান
নারী কিংবা পুরুষ … শারীরিক ত্রুটি নিয়ে আমাদের সমাজের মন-মানসিকতা এখনো অনেক পিছিয়ে। এরা সবখানেই অবহেলিত।
ব্লগার সজীব
এমন মানসিকতা থেকে বের হবো কিভাবে আমরা ?
রিমি রুম্মান
এ প্রশ্নের উত্তর আমিও খুঁজছি … ধন্যবাদ আপনাকে।
ওয়ালিনা চৌধুরী অভি
জীবনের এ আর এক দিক।যা আমরা দেখি না।
রিমি রুম্মান
আমাদের অদেখার মাঝেই অনেক অনেক চাপা দীর্ঘশ্বাস গুমরে কাঁদে…
লীলাবতী
লেখাটি পড়ে খুব কষ্ট লাগলো আপু।
রিমি রুম্মান
একটু মন ভাল রাখার জন্যে যারা সোনেলায় আসেন… লেখাগুলো পড়ে মন খারাপ করেন… তাদের কাছে আমি সরি। ভাল থাকুন সবসময়।