অতিমাত্রায় ঠাণ্ডা লাগার কারণে কাঁপুনি ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলো নাবিলার। সে চোখ মেলছে না। শুনতে পাচ্ছে পাশ থেকে সাব্বির কথা বলছে। সম্ভবত কবিরের সাথে। ট্রেন এ আছে ওরা। স্বপ্নের কাঁপুনিটা আসলে ট্রেন এর ঝাঁকুনি ছিল। পুরো একটা কামরা নিয়েছে কবির। ওরা ঢাকা যাচ্ছে। সাব্বির ঢাকার ছেলে। ঢাকাতেই জন্ম, সেখানেই বড় হয়েছে। আচ্ছা, আজ যেন কত তারিখ ! মনে করতে পারছে না নাবিলা। আবার চোখ টা খুলে যে ঘড়ি দেখবে সেটাও ইচ্ছে করছে না। ও আচ্ছা, স্বপ্নটার কথা ভুলেই গিয়েছিল প্রায়। এই স্বপ্ন ভুলে গেলে চলবে না। সাব্বির কে অবশ্যই বলতে হবে। সাব্বির নিশ্চয়ই খুব মজা পাবে শুনলে। অসম্ভব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখেছে নাবিলা। সাধারণত ওর তখন ঐ স্বপ্ন দেখা মানায় না। কিন্তু স্বপ্নই তো, মানিয়ে গিয়েছে কোনোভাবে। ও তো আর ইচ্ছে করে দেখেনি। ইচ্ছে করে দেখা গেলে ভালোই হত। তাহলে ও ধ্রুব কে নিয়ে স্বপ্ন দেখত।
ধ্রুব !!!!
নাহ্ !!!! এই নাম টা মুছে দিতে হবে পুরোপুরি। আজকেই মাটিচাপা দিতে হবে এই নাম টি। ও চায় না এই নাম টি ওকে ক্ষণে ক্ষণে দংশন করুক সাপ হয়ে। ধ্রুব ছিল নাবিলার প্রথম প্রেম, প্রথম প্রেম নাকি ভোলা যায়না, কিন্তু এতো টা বাজে ভাবে যে ধ্রুব এর স্মৃতি নাবিলা কে জড়িয়ে রাখবে, সেটা নাবিলা বুঝতে পারেনি। মনের অজান্তে মাঝে মাঝেই ধ্রুব কে নিয়ে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে ওর। মন কে তখন বোঝায়, এখন তো সাব্বিরই আমার সব! তবুও কেন এই মিছে আশা নিয়ে ধোয়াটে সপ্নময়তার মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে ? সেই প্রশ্নের উত্তর জানা নেই নাবিলার।
-এই নাবিলা এই! ওঠো না। চা খাবে কি ?
সাব্বির এর ডাকে বাস্তবে ফেরে নাবিলা। সে চোখ খুলে ধীরে ধীরে। দেখে সাব্বির দাড়িয়ে আছে সামনে।
-কি হল ? কি দেখো ? চা খাবে ?
-হুম, দেও।
কামরা পুরোটা তে একবার চোখ বুলিয়ে কবির কে দেখতে পেল না নাবিলা, জিজ্ঞেস করলো,
-আমরা কোথায় আছি এখন ?
-কুমিল্লা পাড় করেছি একটু আগেই, কবির সেখানেই নেমে গেল।
-ওহ্। কেন ?
-ও নাকি ওর গ্রামের বাড়ি যাবে একটু, কি যেন কাজ আছে।
-ওহ্ আচ্ছা।
সাব্বির এর বাড়িয়ে দেওয়া হাত থেকে চা নিয়ে চুমুক দিলো নাবিলা। জঘন্য, ট্রেন এর ক্যান্টিন এর চা এতো জঘন্য হয়! এরা কি চা বানাতে জানে না নাকি একদমই। আজ পর্যন্ত একটা ট্রেন এও ভালো চা পায়নি নাবিলা।
-বেশ তো ঘুমলে, এখন কি ভালো লাগছে একটু ?
-হুম।
-নাবিলা!
-হুম, বল।
-এই নাবিলা এই।
-বল না!
-এই নাবিলা এই, এই।
-বল না বাবা ! শুনছি তো রে।
-চা টা কেমন হয়েছে ? ট্রেন এর ক্যান্টিন এর চা তো তেমন ভালো হয় না।
-ফালতু, এতো সুন্দর করে ডেকে এই কথা বলে মানুষ ?
-হু, বলে তো। আমি বলি, আমি কি মানুষ না ?
-না, তুমি একটা অমানুষ। যে কাজ করেছ, সেটা অমানুষরাই করে, বুঝলে ?
-নাহ্। বুঝিনি।
কিছুক্ষণ এর জন্য চুপ করে যায় দুজনই। নাবিলার অস্থির লাগতে শুরু করে। কথার মাঝে এভাবে হঠাৎ করে বক্তা রা চুপ হয়ে গেলে কেমন যেন স্তব্ধতা নামে। ব্যাপারটা নাবিলা পছন্দ করে না। বেশিরভাগ মানুষই পছন্দ করেনা এই পরিস্থিতিটি। নাবিলার অস্বস্তি লাগতে শুরু করে।
-এই নাবিলা এই।
সাব্বির এর ডাকে নাবিলার স্বস্তি ফিরে এলো। একটু ছোট করে নিঃশ্বাস ছেঁড়ে উত্তর দিল সে,
-হুম ?
-ভালোবাসি।
-আমি তো বাসি না। তুমি বাসলেই কি হবে নাকি ?
-আমি একাই এতো এতো বেশি ভালবাসবো যে তুমি আমার ভালোবাসার সমুদ্রে ডুবে থাকবে, তোমার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে আমি তোমাকে অক্সিজেন দিব, আর আমার অক্সিজেন তো তোমার জন্য আমার ভালোবাসা।
-পাগল।
-হুম, তোমার জন্য।
ঠোঁটের কোনে অল্প একটু হাসি এনে অস্ফুট স্বরে নাবিলা বলে ওঠে,
-ভালবাসি।
সাব্বির কোন উত্তর দিচ্ছে না, একদৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে নাবিলার দিকে। আবারও সে অস্বস্তিকর নীরবতা। নাবিলা ভাবছে, সাব্বির কি শোনেনি আমার কথা!
ঠক্ ঠক্ !!
কামড়ার দরজায় টোকা পরতেই অস্বস্তি কাটে নাবিলার, সাব্বির এগিয়ে যেয়ে দরজা খুলে দেখে ক্যান্টিন এর লোক, কাপ চাচ্ছে। সাব্বির পিছু ফিরতেই নাবিলা কাপ টা এগিয়ে দিল। কাপ টা দিয়েই দরজা লাগিয়ে দিল সাব্বির।
নাবিলার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো,
-ভয় লাগছে না তো আমার সাথে ? একা একা ?
-তোমাকে কিসের ভয় ? হাহ্।
-তাই ? কি কি করা যেতে পারে এখন জানো ?
-উফ্, ফাজলামো করো না তো সাব্বির।
সাব্বির এগিয়ে এসে নাবিলার পাশে গা ঘেঁষে বসলো। নাবিলার দিকে ফিরল… সে দৃষ্টি তে কি ছিল, নাবিলা জানে না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই ঘোর লাগা ভালবাসার অনুভূতি তে ডুবে গেল নাবিলা।
………………………………………
এ পর্যন্ত লিখে আর লিখতে ইচ্ছে করছে না নাবিলার। অনেক ক্লান্ত লাগছে ওর। দোটানায় পরে কিছুক্ষণ শূন্যতার মাঝে সাঁতরে আরও বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়লো নাবিলা। ক্লান্ত দেহ টা কোনমতে টেনেটুনে নিয়ে মৃন্ময়ীর পাশে উল্টো দিকে ফিরে শুয়ে পড়লো নাবিলা। শোয়ার সময় মৃন্ময়ী কে দেখে নাবিলার মনে দুটো চরণ এসেছিল, কি যেন ! মনে করতে পারল না আর নাবিলা। নাহ্, আজ বড্ড বেশি ক্লান্তি ভর করেছে হঠাৎ করেই ওর। কিন্তু কেন এমন লাগছে ! সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কল্পরাজ্যের অতলে হারিয়ে গেল সে ধীরে ধীরে।
২য় পর্বে সমাপ্ত —
৮টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
পড়লাম সবটুকু মন দিয়ে , গল্প কবিতায় বিয়োগান্তক প্রেম কাহিনী ।
তওসীফ সাদাত
হুম, ধন্যবাদ সময় করে পুরোটা পরবার জন্য।
জিসান শা ইকরাম
অনেক ভালো লেগেছে গল্পটি
ভালোবাসার এমন টারনিং থাকবেই —-
তওসীফ সাদাত
হুম… তারপরও জীবন থেকে মায়া উঠে গেলে কি চলে ? জীবন তো একটাই। ধন্যবাদ ভাইয়া, ভাল লেগেছে শুনে খুশি হলাম 🙂
আফ্রি আয়েশা
সুন্দর কিন্তু বিষাদ মাখা গল্প 🙁 । মানুষ যে কেন তার প্রাপ্য ভালোবাসা টুকু পায়না , কে জানে ! ভালো লিখেছ । তোমার কাছ থেকে আরও গল্প পাবার প্রত্যাশা রাখলাম 🙂 । ভালো থেকো
তওসীফ সাদাত
ধন্যবাদ 🙂 চেষ্টা করবো 🙂 আসলে ভালবাসায় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব করতে যাওয়া টা বোকামি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মনে হবে যে প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তি বেশি 🙂
খসড়া
বাহ বেশ ভাল লাগল।
তওসীফ সাদাত
ধন্যবাদ 🙂