অযথাই যে জেগে আছে কুন্তলা , তা নয় । এমনকি অপেক্ষা করছে কেউ আসবে বলে , তাও নয় । বুঝে উঠতে পারছে না জীবনে এমন সময় কেন এলো ? নিজেই কি জেনে-শুনে জন্ম দেয়নি ? “আমি জেনে-শুনে বিষ করেছি পান…” রবি ঠাকুর এই গানটি যেনো এ সময়ের জন্যেই সৃষ্টি করেছিলো । কুন্তলা নিজেই নিজেকে বলে , “এবার তো ফিরে চল তুই , আর কতো ?” তবুও পারেনা । একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে যে জীবনটাকে আঁকড়ে আছে , সে কি আদৌ কুন্তলার জীবন ? কে জানে ! হয়তো হ্যা , নয়তো না । শুধু এটুকু জানে একটি দিনের ছুটি মানে একটি রাতের জেগে থাকা আর একটি সকালের ঘুম । ছুটির একটি সকালই অ্যালার্মহীন থাকে । তাও এমনই অভ্যেস যে সে যতো রাত করেই ঘুমাক না কেন , সেই সকাল সাতটের সময় ঘুম ভাঙ্গবেই ।
বালিশের এক পাশে গল্পের বই , অন্যপাশে ডায়েরী । সেখানে যদিও প্রতিদিনকার ঘটনা লেখা নেই । বরং চলতি সময় থেকে স্বপ্ন দেখা আগামীকাল আছে । আবার পেছনের মিষ্টি-তেঁতো মুহূর্তগুলোও । চঞ্চলতার জন্যেই মনের আনাচে-কানাচে কোথাও আগাছা গজিয়ে ওঠেনি কুন্তলার । তবে ওর এই জগতে ঘন সবুজ অরণ্য আছে । সেই অরণ্যের ভেতরে অবিরাম ধারায় গড়িয়ে পড়া একটি ঝর্ণা আছে , যার নাম রেখেছে বিভোরী । তার জন্যেই ছোট্ট একটি নদীর জন্ম হয়েছে । ক্ষীণকায় নদী , কিন্তু অনেক বড়ো তার প্রাণ । কলকল করে বয়ে যায় সমস্তটি অরণ্য জুড়ে । এতো স্বচ্ছ জল দিনের আলোয় ডুব-সাঁতার কাটে যে পানকৌঁড়ি তার গোলাপী ঠোঁটটুকুও দেখা যায় । আর রাতের অন্ধকারে ঝঙ্কার তোলে নদীর জল , যেনো স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো অপ্সরীর নিক্কণের শব্দ । সমস্তটি আকাশ জুড়ে অজস্র তারা-নক্ষত্র পাহারা দেয় অরণ্যের চারিদিকে । সঙ্গী হয় রূপোলী জোনাকীর আলোও । লুকোচুরী খেলে তারাদের সাথে । একবার আলো জ্বালিয়ে , আর একবার নিভিয়ে । অমন সুন্দর পরিবেশে রাতজাগা পাখীদের সুর । কারুর কর্কশ , আর কারুর বা মিষ্টি । এই হলো কুন্তলার পৃথিবী । তবে ওর এই জগতে আরোও একটি অনুভূতি আছে , সে হলো অপেক্ষা ।
প্রায় তিনটে বাজতে চললো । তাও নিদ্রা দেবীর দেখা নেই । আবার কি বই পড়া শুরু করবে ? তাহলে তো আর ঘুম আসবেই না । সবাই বলে বই হাতে নিলেই ঘুম পেয়ে যায় , কুন্তলার উলটো । শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছুতেই স্বস্তি পায়না । নিজেকে পর্যবেক্ষণ করেনা কখনো । তবে কাছে বন্ধু থেকে পরিচিত প্রায় সকলেই বলে ওর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একেবারে আলাদা । একবার কুন্তলা ওর মায়ের কাছে জিজ্ঞেসা করেছিলো , “মা আমি কি উলটো হয়ে জন্মেছিলাম ?” কুন্তলার মা কিছু না বলে হেসেছিলেন ।
বইটা হাতে নিয়েও খুললো না । বরং চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো । প্রায় একঘন্টা পর হাল ছেড়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সাথে কথা বলতে লাগলো । এই পাগলামীটাই এখনও থেকে গেলো । “ভাগ্যিস এই পাগলামী মা ছাড়া আর কেউ দেখেনি । তুই বল কি হতো তা না হলে !”
একবার স্কুল ছুটি হয়ে গেলো সময়ের আগেই , তাও শুধুমাত্র ছাত্র-ছাত্রীদের । কুন্তলার মা ওই স্কুলেরই শিক্ষিকা । বাড়ী ফিরেই গল্পের বইটা হাতে নিয়ে রকিং চেয়ারে । আর ডেকসেটে তখন চলছে ,
“কোন্ সাগরের পার হতে আনে কোন্ সুদূরের ধন—
ভেসে যেতে চায় মন,
ফেলে যেতে চায় এই কিনারায় সব চাওয়া সব পাওয়া…।”
কখন যে বইটা শেষ হয়ে গেলো , তখনও মনে র’য়ে গেলো তারই রেশ । যেনো “শেষ হইয়াও হইলো না শেষ ।” তারপর আয়নার সামনে এসে নিজের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করলো নিজেকেই ।
–“সবাই বলে তোর চোখ নাকি বেশ বড়ো ? কাজল-কালো চোখ ।”
–“আমি জানিনা ।”
–“এই মেয়ে শোন , কখনো চোখে কাজল আঁকিস না ।”
কুন্তলার সমস্ত মুখ অমনি লজ্জ্বায় লাল-গোলাপী রঙ ছড়ালো । ঠিক ওই সময়েই কুন্তলার মা ওর চোখের সামনে । কিচ্ছু বললেন না ।
–“উফ এ কি হচ্ছে আজ ? কোথায় চলে গিয়েছিলাম ? নাহ ঘুমোতে হবে । যে করেই হোক ।
–“কুন্তলা আর অপেক্ষা না । এবার লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড় তো । কিসের জন্যে , কার জন্যে অপেক্ষা করছিস ? অপেক্ষা সময়ের উপরেই নির্ভর করে । শুধু মনে রাখিস যা ঘটার , অপেক্ষায় না থাকলেও ঘটবেই ।”
এসব কথাকে পাশ কাটিয়ে ডায়েরীটা টেনে নিলো । উপুড় হয়ে বালিশটাকে চেপে নিয়ে লিখতে শুরু করলো কুন্তলা ।
“আজ বৃষ্টি হবে । যদিও মেঘের কোনো তোড়জোর নেই । আকাশের বুক চেপে বসে আছে তো আছেই সেই কখন থেকেই—
কেবল বদলে দিচ্ছে তার রঙ ।
আর হাওয়া ? সেও বড়ো শান্ত , তবে কেমন জানি এলোমেলো ।
শীতলতা আছে , কিন্তু স্বস্তি নেই ।
এড়িয়ে থাকার বিশাল শক্তি আছে মেঘের । আসলে অবস্থান জেনে গেলে ইচ্ছেমতোন নাটাই যে ঘোরানো যায় ! তবু প্রশ্ন জাগে মনে , মেঘ কি আদৌ ভালো আছে মৃত্তিকার ফেঁটে যাওয়া চৌঁচির বুকে বৃষ্টি না ঝড়িয়ে ?
এতো কিছুর পরেও জানি , আজ বৃষ্টি হবেই । আকাঙ্ক্ষার তীব্রতার কাছে মেঘকে ভিঁজে যেতে হবেই । আজ নয়তো কাল বৃষ্টি তাই হবেই…।”
কুন্তলার চোখ ভারী হয়ে আসছে । কলমটা পড়ে গেলো হাত থেকে । জানালার পর্দায় হাওয়াদের দাপাদাপি । অপেক্ষার স্পর্শটা যেনো চোখের উপর । “এতো দেরী হলো আসতে ? কেন বলো তো ?”
উত্তরটা ঠোঁট নাড়িয়ে বলার আগেই অ্যালার্মের কর্কশ কন্ঠ । চারদিকে এখনও আবছা অন্ধকার । পরিপূর্ণ আলো ফোঁটার আগেই ছুটতে হবে কুন্তলাকে ।
হ্যামিল্টন , কানাডা
২ সেপ্টেম্বর , ২০১৪ ইং ।
২৬টি মন্তব্য
আগুন রঙের শিমুল
মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস,
এতো দীর্ঘশ্বাস, কে জানতো!
নীলাঞ্জনা নীলা
আসলেই কেউ জানিনা…
নুসরাত মৌরিন
মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়লাম দিদি…।
“আজ বৃষ্টি হবেই । আকাঙ্ক্ষার তীব্রতার কাছে মেঘকে ভিঁজে যেতে হবেই । আজ নয়তো কাল বৃষ্টি তাই হবেই…”।
বৃষ্টি হোক…ভাসিয়ে নিয়ে যাক জীবনের সব অপূর্নতা কে…।
দারুন লেখা… (y) -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
এখানে গতকাল :Tired: ঝড় হয়েছে…আর গত রবিবার চরম বৃষ্টি হলো…আমি তো ভিঁজে একাকার…
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
আপনি দরুন লিখেন….এমনি হয় কোন টেনসন থাকলে ঘুমেরা বাপের বাড়ী যায়…–“উফ এ কি হচ্ছে আজ ? কোথায় চলে গিয়েছিলাম ? নাহ ঘুমোতে হবে । যে করেই হোক । -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
টেন(দশ) আর সন(ছেলে)…আমার একটি-ই ছেলে…
জিসান শা ইকরাম
এমনই তো জীবন আমাদের
টেনে নেয়া শুধু ।
লেখা ভালো হয়েছে ।
নীলাঞ্জনা নীলা
টেনে নেবো কেন ? আমি তো দৌঁড়ের উপর থাকি… 😀
বনলতা সেন
অন্য রকম লেখা , বৃষ্টি আসতে বাধ্য ।
নীলাঞ্জনা নীলা
এমনই এসেছিলো যে আমার বারোটা বেজেছিলো সেদিন…
লীলাবতী
ভালো লিখেছেন খুব নীলাদি -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
ইস একটা গোলাপ দিতে চাইলাম…কিন্তু জানিনা “ইমো” কাজ করছে না…মন খারাপ
খসড়া
এই মেয়ে শোন — যে চোখ কথা বলে তাতে কাজল দিতে নেই।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমার জন্মগত চোখ আর কথা বলেনা…তবে ডাক্তার প্রদত্ত চোখ ভালোই দেখে এবং বলেও…
মোঃ মজিবর রহমান
আপনি মন ভোলানো লেখক খুব দারুন হয়েছে।
নীলাঞ্জনা নীলা
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে…
ব্লগার সজীব
বৃষ্টি হোক। ভালো লেগেছে খুব দিদি।
নীলাঞ্জনা নীলা
আকাশ আজ মেঘে ঢাকা…কি জানি কাল সকালে বৃষ্টি হলে মরণ…
স্বপ্ন নীলা
এত সুন্দর একটি লেখা পড়ছিলাম –দিলেন তো হঠাৎ শেষ করে —দারুন — এইতো জীবন !!
নীলাঞ্জনা নীলা
শেষ না হলে নতূনের জন্ম হবে কি করে ?
ছাইরাছ হেলাল
এভাবে শেষ করলে তো হবে না !
নীলাঞ্জনা নীলা
কি যে করি !
মিথুন
হঠাত শেষ হয়েছে বলেই হয়ত এমন ভালো লেগেছে বলে আমার মনে হয়।
নীলাঞ্জনা নীলা
তাই ? খুশী না হয়ে উপায় নেই দেখছি আমার…
শুন্য শুন্যালয়
চমৎকার গল্প। এমন করে শেষ করে দিলে কস্ট পাইতো। একটা অতৃপ্তি থাকে যেন।
এমন একটা সবুজ অরন্য, নদী সবার মাঝেই কি থাকে? আমারও অপেক্ষা থাকে কবে নীলাদির একটা লেখা পাবো।
নীলাঞ্জনা নীলা
এতো অপেক্ষায় থাকলে না দিয়ে তো পারিনা লেখা…তাই দিয়েই গেলাম আজ তিরি আর অহমকে…