ইমনকে দলবলসহ বাড়িতে ঢুকতে দেখে অবাক হয় আবুল-কাবুল। লম্বা ফর্সা ভদ্রলোকটি বাজান কোথায় জানতে চাইছে। পাশের লোকটা মার কাছে কি যেন ভিক্ষা চায়। তাদের বাড়িতে যে ভিক্ষুকরা আসে তাদের কাঁধে ঝোলা হাতে লাঠি থাকে। এতো বড়লোক ভিক্ষুক তাদের বাড়িতে কোনোদিন আসেনি।
ইমনের প্রতিপক্ষ ইউসুফ চৌধুরীকে কোনোদিন এই অজ পাড়াগাঁয়ে আসতে হয়নি। বিশাল সুতার মিল, হাউজিং এস্টেটের ব্যবসা ছেড়ে গ্রামে আসা সম্ভব নয়।
লক্ষ-কোটি টাকা থাকার পরও কি যেনো নেই, কি যেনো নেই জাতীয় একটা ভাব তার বুকের মধ্যে। মধ্য বয়সেই মানুষের মনে ক্ষমতার লালসাটা জেগে ওঠে। নিজের টাকায় একটা ঐতিহাসিক জনসভা দেন মাদারীপুর নাজিমউদ্দিন কলেজ মাঠে। একটা দলের জার্সি গায়ে দিয়ে তিনি নেতা বনে গেলেন। প্রথম নির্বাচনে জয়লাভের পর তিনি হয়ে গেলেন দানবীর অনলবর্ষী বক্তা, আপোষহীন জননেতা ইত্যাদি।
মাদারীপুরবাসী তাকে ভোট দেয় বিনিময়ে তিনি টাকা দেন, গেঞ্জি দেন। প্রতি ঈদে ত্রিশ-চল্লিশ মন সেমাই-চিনি এক হাজার শাড়ি-লুঙ্গি দেন। ইউসুফ সাহেব মাঝে-মধ্যেই তার ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘একটা ভোটের দাম কতো?’ ম্যানেজারটি উচ্চ শিক্ষিত গাঁধা। চাকরি নট হয়ে যাবার ভয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। একবারও মুখ ফুটে বলে না যে ধনী হওয়া কিংবা দান-খয়রাতের অভ্যাস থাকাটাই পালার্মেন্ট মেম্বার হওয়ার একমাত্র যোগ্যতা নয়।
সততা, দক্ষতা, জনগণের সমস্যা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার পাশাপাশি দানশীলতাও একটি সামান্য যোগ্যতা। অন্যান্য যোগ্যতার অভাব থাকলে দান-খয়রাতের মাধ্যমে তা পুরণ করার চেষ্টা করা হয়। ইউসুফ সাহেব টেনে টুনে আইএ পাস করেছিলেন। আইন-কানুন খুব একটা বোঝেন না। শুনতে পাচ্ছেন এবার টাকা পয়সা দেয়া পুরোপুরি হারাম। কিভাবে জায়গা মতো টাকা পৌঁছানো যায় তা নিয়ে ভাবতে থাকেন তিনি।
আবুল-কাবুলদের গ্রামটি ইমন এবং ইউসুফ সাহেবদের গ্রামের বাড়ির মাঝখানে। খুবই স্পর্শকাতর অংশ। এ কারণে ইমন খুব ধীরে সুস্থে গণসংযোগ করতে থাকে। ইমনের পাঞ্জাবীর পকেটে কয়কটা বিদেশী লজেন্স ছিলো। আবুল-কাবুলকে কাছে এনে চারটি লজেন্স দেয় সে। আবুল-কাবুল আনন্দে ভোঁ দৌঁড় দেয়।
এমনি করে প্রতিদিন। হাঁটতে হাঁটতে ইমনের পা ব্যথা করে। তারপরও দাঁতে দাঁত চেপে প্রচারণা চালিয়ে যায় সে।
পার্টির হাইকমান্ড মুড়ি ভাজা বালির মতো তেতে আছে। রাজনীতি চুমুর প্রতিদানে চুমু দেয়ার মতো নুতুনুতু বিষয় না। ইমন যা করছে তা প্রচলিত রাজনীতির স্পষ্ট বিরোধীতা। ইমনের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযোগ সে প্রচারণার সাথে অর্থের ব্যবহার করছে না, সুবোধ গোপালের মতো নির্বাচনী আচরণ বিধি মেনে চলছে। দ্বিতীয় অপরাধটা আরো মারাত্মক, সে মিডিয়ার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। এটা অনভিজ্ঞ পলিটিসিয়ানের লক্ষণ। সুচতুর রাজনীতিবিদ উল্টো কথা বলে পাবলিক ক্ষেপিয়ে তুলবে। সে বলবে নির্বাচন কমিশন কিংবা প্রশাসন আমাকে কোনো হেল্প করছে না। বিরোধীপক্ষকে বিভিন্ন সুবিধা দিচ্ছে। জনগণ আসন্ন নির্বাচনে এর দাঁত ভাঙা জবাব দেবো, ইনশাল্লাহ্।
ইমন নামের ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে নমিনেশন দেয়ায় অনেকেই ক্ষেপে আছে। মহাসচিবের বাসায় ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। সেই রাতে মহাসচিব ফোন করেন ইমনকে…
: বাবা তুমি নাকি টাকা পয়সা ছাড়তাছো না, এইটা কি ঠিক হইতাছে?
: আংকেল পাবলিক আমাকে স্বাভাবিকভাবেই এ্যাপ্রিসিয়েট করেছে। আমার ক্রিম ইমেজটাকে টাকা পয়সা দিয়ে নষ্ট করলে আমার ক্যারিয়ারের ক্ষতি হবে।
: বাবা। তুমি পাবলিক চেনো না। অরা টাকা নিতে অস্বীকার করবো কিন্তু মনে মনে ঠিকই বেজার হইবে, অন্যরে ভোট দিবো।
(ব্যাটা ভোদাইর পো ভোদাই-মহাসচিব মনে মনে গালিটা দিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন)
: কিন্তু আংকেল এখানকার এ্যাডমিনিস্ট্রেশন বেশ এ্যাকটিভ; টাকা দিতে গিয়ে যদি কেউ ধরা পড়ে ?
: কোনো চিন্তা নাই। যেইটারে দিয়া টাকা ছাড়বা সেইটারে ত্রিশ দিন আগে বহিস্কার করছো এমন রেজুলেশন কইরা রাখবা। ধরা খাইলে সাংবাদিক ডাইকা কাগজপত্র দেখাইবা। বলবা দল থিকা বহিস্কার করায় তোমার বদনাম সৃষ্টির জন্য সে এইডা করছে। এইডার সাথে প্রশাসন জড়িত। দোষ দিবা প্রশাসনের ঘাড়ে।
সৌম্য চেহারার বৃদ্ধ মানুষটা যে এতোটা মার প্যাঁচের মানুষ তা ইমনের জানা ছিলো না। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে টাকা তাকে নিতেই হবে।
: ঠিক আছে, টাকা পাঠিয়ে দিন।
: বাচাইলা বাবা। তুমি আমার কথা না রাখলে রাখব ক্যাঠা।
পরের দিন পয়ত্রিশ লাখ টাকার একটা চালান আসে গোপন ঠিকানায়। কিন্তু টাকাটা বিলিবণ্টনের সুযোগ হয় না ইমনের। আগামী পরশু একজন নির্বাচন কমিশনার আসবেন খোদ মাদারীপুরে।
নির্বাচন কমিশনার আসছে, জেলায় বড়কর্তা থেকে মেথর সবার মধ্যে টাইটানিক ডুবে যাওয়া ব্যস্ততা। সার্কিট হাউসের গাছগুলোর গোড়ায় চুনকাম করা হয়েছে, যেনো বাচ্চাদের শাদা পেন্টি পড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার অত্যন্ত স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। তেল চর্বির সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। দুপুরে উচ্ছে ভাজি এবং পাবদা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেলেন তিনি। প্রায় এক ফুট লম্বা পাবদা মাছটি দেখে কমিশনার মহোদয় মৃদুস্বরে বাহঃ বলে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। ডিসি সাহেব তার ব্যুরোক্র্যাট জীবনের স্বার্থকতা খুঁজে পেলেন। দৃষ্টিনন্দন পাবদাটি সংগ্রহের জন্য তিনি ধন্যবাদ দিলেন এনডিসিকে। এনডিসি জেলা নাজিরকে, জেলা নাজির পিয়ন লাল মিয়াকে। লাল মিয়া ধন্যবাদ দিল পদ্মা পাড়ের দরিদ্র জেলে রাধু মালোকে আর রাধু মালো দুই হাত জোড় করে পেন্নাম জানাল স্বয়ং মা গঙ্গাকে।
মিটিং শুরু হলো বিকেলে। কমিশনার মহোদয় সবাইকে নির্বাচনী আচারণ বিধি মেনে চলার উদাত্ত আহবান জানালেন। বাঙলাদেশের গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করতে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই। তিনি উপস্থিত দুই প্রার্থীকে দিয়ে এক প্রকার শপথ পড়িয়ে ছাড়লেন বক্তব্যের শেষ দিকে তিনি এমন কিছু কথা বললেন যা গোলাগুলি শুরুর আগে কমান্ডিং অফিসার তার অধীনস্তদের বলে থাকেন। পরবর্তী প্রজন্মের সুখের জন্য একটি বুলেটের আঘাত মেনে নেয়াটা বীর সৈনিকের লক্ষণ। আমরা দুঃসময়কে জয় করবই। কমিশনারের বক্তব্যের মাঝেই ইমন সিদ্ধান্ত নেয় টাকার চালানের বাণ্ডিলগুলো পর্যন্ত খুলবে না সে।
(চলবে)
আগের পর্বগুলোর লিংক :
নিছক গল্প-১
http://sonelablog.com/archives/3193
নিছক গল্প-২
http://sonelablog.com/archives/3229
নিছক গল্প-৩
http://sonelablog.com/archives/3286
নিছক গল্প-৪
http://sonelablog.com/archives/3370
নিছক গল্প-৫
http://sonelablog.com/archives/3443
১৮টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
মজা পাচ্ছি খুব
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি নির্বাচনটা
এমনই হয় , হয়ে আসছে , হতে থাকবে
সাতকাহন
জ্বি ভাই আর মাত্র একটি পর্ব আছে, আগামী পর্বেই সমাপ্ত করবো।
জিসান শা ইকরাম
এত দ্রুত শেষ হয়ে যাবে ? চলুক না , ভালো লাগছে তো ।
সাতকাহন
গল্পের প্লট এই পর্যন্তই যে
জিসান শা ইকরাম
তাহলে ঠিক আছে 🙂
ব্লগার সজীব
এ তো দেখছি আমাদের এলাকার ইলেকশনের মতই লিখছেন 🙂 (y)
সাতকাহন
বাস্তবতার নিরিখে লেখা
আদিব আদ্নান
ইমনের একটি ক্লিন ইমেজ দাড়িয়ে যাচ্ছে ,
দেখা যাক কোথায় কতদূর নিয়ে যেতে পারেন ।
সাতকাহন
ইমন ভাই ক্লিন ইমেজেরই ছেলে, ওনার আপন ছোটো ভাই সুমনই আমার বন্ধু। ইমন ভাইকে ছোটো বেলায় হিরো ভাবতাম। অনুসরন করার চেষ্টা করতাম। ভাবিকে নিয়ে দাম্পত্য জীবনেও সে খুবই সুখী। এখন সে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সহযোগী অধ্যাপক।
মিসু
টাকা খরচ না করলে ইলেকশনে পরাজয় নির্ঘাত 🙂 ভালো লেগেছে । পরের পর্বের অপেক্ষায় (y)
সাতকাহন
ধন্যবাদ আর মাত্র একটি পর্বই লিখবো
ছাইরাছ হেলাল
ক্লাইমেক্সে চলে এসেছে । এক পর্বে দিয়ে লেখাটির অঙ্গহানি করা কি ঠিক হবে ?
টান টান উত্তেজনায় কয়েকটি পর্ব চলুক এমন ই চাই ।
দেখা যাক ইমন কী ভাবে কী করে ?
সাতকাহন
শেষ হইয়াও যে হইলো না শেষ
শিশির কনা
কিছু মেধা নষ্ট করে দেন আমাদের রাজনীতিবিদগণ । রাজনীতি নষ্ট হয়ে গিয়েছে , এটি আর শুদ্ধ করার উপায় নেই।
সাতকাহন
দেখি কি হয়
বনলতা সেন
আপনার গল্পের নায়ক দেখছি আপনারও ‘নায়ক’ ।
সাতকাহন
একজন গল্পকারের গল্পের প্রতিটি চরিত্রই নিজের কাছে সবচেয়ে প্রিয় মনে হয়, আর এই গল্পটি বাস্তবতার নিরিখে লেখা।