অনেককেই বলতে শুনেছি স্কুল জীবনেই প্রেমে পড়েছিলো বা হয়েছিলো অথবা কারো উপরে ক্রাশ খেয়েছিলো। তাদের অনেকেই মুখ ফুটে তার ভালোবাসার মানুষকে সে কথাটা বলতে পারেনি। হয়তো একতরফা প্রেম ছিলো সেটা। অথচ স্কুলের গন্ডিতে আমি প্রেম নামক বস্তুটিকে লজ্জা পেতাম। সে কারনেই আমার প্রেম হয় নাই।
কিন্তু কলেজে এসে আমিও একজনের উপর ক্রাশ খেয়েছিলাম। অবুজ মনের ভালোবাসায় পতিত হওয়া যাকে বলে। তিনি ছিলেন আমাদের কলেজের সবচেয়ে সুন্দরি মহিলা। আমাদের ক্লাসের ম্যাডাম, বিবাহিত কিন্তু নিঃসন্তান ছিলেন তিনি। আমার এই ভালোবাসায় কোনো নোংরামি ছিলোনা। ক্লাসে কিংবা ক্লাসের বাইরে তিনি আমাকে ডাকতেন এই দুষ্টু বলে। এ নিয়ে বন্ধুরা দারুন হিংসে করতো আমায়।
তিনি সবাইকে পড়া ধরতেন, না পারলে রাগ করতেন। সবার শেষে আমাকে বলতেন- এই দুষ্টু এবার তুমি বলতো….. আর ক্লাসের সবাই মিটি মিটি হাসতো। আমিও মুচকি হাসি দিতাম আর বলতাম ম্যাডাম পারবোনা। তিনি বলতেন উহ! এই দুষ্টুকে নিয়ে আর পারা গেলোনা। আমার প্রিয় ম্যাডাম।
ক্লাসের বাইরে কলেজ মাঠে, রাস্তায় যখনি দেখা হতো তখনি বলতেন – এই দুষ্টু কেমন আছ?
আমিও মুচকি হাসি দিয়ে বলতাম- ভালো আছি ম্যাডাম।
দীর্ঘ আঠারো বছর তার সাথে আর দেখা হয়নি। আজ আকস্মিকভাবেই তার সাথে দেখা রাস্তায়। ছোট্ট ফুটফুটে এক বাবুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন। সামনাসামনি পড়ে যাওয়াতে আমি সালাম দিলাম। তিনি উত্তর দিয়ে বললেন- ভালো আছো তৌহিদ? আমার নাম তিনি মনে রেখেছেন!
– জ্বী ম্যাডাম। ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম তিনি একটুও বদলাননি, ঠিক শেষবার যেরকম দেখেছিলাম তেমনি আছেন।
কোথায় আছি, কি করছি এসব জিজ্ঞেস করছেন আর এর ফাঁকে তার কোলের বাচ্চাটি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো, আমিও হাত বাড়িয়ে তাকে কোলে নিলাম।
– এটা আমার ছোট মেয়ে। ছেলে বড়, ক্যাডেটে পড়ে।
বাচ্চাটি আমার গাল টানছে, নখ দিয়ে ঠোঁটে চিমটি কাটছে। উহ! অসহ্য।
ম্যাডাম বললেন- এই দুষ্টু!
কি বলছেন ম্যাডাম! আমাকে এই বয়সে এসেও ভরা রাস্তায় সবার সামনে এই দুষ্টু বলে ডাক দিচ্ছেন! আহ! সেই প্রিয় শব্দগুলি দিয়ে তিনি আমাকে ডাকছেন!
দাও আমার কোলে দাও বাবুকে, না হলে একটু পরে তোমার চুল টানতে শুরু করবে – ম্যাডাম আমাকে বললেন।
ওহ! তাহলে তিনি তার বাচ্চাকে এই দুষ্টু বলে ডাকছিলেন এতক্ষন! এটা ভেবে মনটা কিঞ্চিত খারাপ হলো আমার।
তৌহিদ তুমি কিন্তু আগের মতই আছ। শুধু ভুঁড়ি হয়েছে আর চুলে পাক ধরেছে, চুলও পাতলা হয়ে যাচ্ছে তোমার।
– এই একটু আধটু ম্যাডাম।
– নাহ! যত্ন নাও, না হলে ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেশার নানান সমস্যা অল্প বয়সেই জেঁকে বসবে শরীরে।
মনে মনে বললাম – ম্যাডাম আর একটুক্ষন আপনার পিচ্চি আমার কোলে থাকলে আমি নিশ্চত আরো তিন চারটা চুল মাথা থেকে সে নাই করে দিত।
বললাম আপনার বাবুটা কিন্তু দারুন দুষ্টু! তিনি আমার দিকে চেয়ে থাকলেন। আমার কথাতে কি রাগের কোন বহিঃপ্রকাশ ছিলো? আশ্চর্য আমার রাগ উঠছে কেন? মনে হচ্ছে এখান থেকে চলে যেতে পারলেই আমি বাঁচি।
তিনি আমার পরিবারের সবার খোঁজ খবর নিলেন। কলেজে আসতে বললেন একদিন।
– জ্বী আচ্ছা ম্যাডাম। তার গাড়ি চলে এসেছে।
– আচ্ছা ভালো থেকো, আর অবশ্যই যোগাযোগ রেখো কিন্তু!
– ঠিক আছে ম্যাডাম।
আমি দাঁড়িয়ে আছি, তিনি চলে গেলে তারপর রিক্সা নিব।
তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- তৌহিদ, তোমার মনে আছে কলেজে আমি এই দুষ্টু বলে ডাকতাম?
আমি বললাম- মনে আছে ম্যাডাম। কিন্তু কি আশ্চর্য কলেজের সেই মুচকি হাসিটা আমার আজ আর এলোনা!
– আচ্ছা ভালো থেকো, এ কথা বলে তিনি চলে গেলেন।
আমি সালাম দিয়ে তাকে বিদায় জানিয়ে বাসায় ফেরার সময় রিক্সায় বসে ভাবছি- তার সাথে কাটানো শেষ সময়টুকুর কথা। আমারতো মনঃক্ষুন্ন হবার কথা না। তবে কি হিংসে? আমার সামনে তার বাচ্চাকে এই দুষ্টু বলে ডেকেছে তাই! দুধের বাচ্চাকে হিংসে করছি আমি! অদ্ভুত এই মানবমনের প্রকৃতি, নিজের স্বার্থ সবসময় দেখে।
আমি বুঝতে পারলাম কেন আমাকে এই দুষ্টু বলে ডাকতেন ম্যাডাম। নিঃসন্তান তিনি হয়তো কলেজে আমাকে সন্তানের মত ভালোবাসতেন। আমার মাঝেই নিজের সন্তানের মুখ কল্পনা করতেন। অথচ কলেজে জীবনে এটা নিয়ে তার মাঝে কখনওই কোন অতিরঞ্জন ছিলোনা। আমিও ওই অতটুকুন ভালোবাসা পেয়ে হয়তো তার প্রেমে পড়েছিলাম। প্রত্যেকটা মানুষ যে শুধু বিশুদ্ধ ভালোবাসাই পেতে চায়।
কি বোকা ছিলাম আমি! আজও তাই রয়ে গেছি। ভালো থাকবেন প্রিয় ম্যাডাম।
——————
তৌহিদ, রংপুর।
২৭টি মন্তব্য
ইঞ্জা
প্রায় সকলেরই প্রথম প্রেম, না প্রেম বলবোনা, ক্রাশ তাদের শিক্ষকই হয়ে থাকেন, যেমন আমারও ছিলো যিনি আমার স্কুলেরই টিচার, ছবি টিচারের কথা এখনো ভুলিনি ভাই।
তৌহিদ
আমিও ম্যাডামকে অনেক শ্রদ্ধা করি দাদা। তিনি অত্যন্ত সজ্জন মানুষ ছিলেন। তার জন্য অনেক দোয়া থাকবে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ।
ইঞ্জা
শুভেচ্ছা ভাই
রাফি আরাফাত
হিহিহি আমার ক্রাশ টিচার স্কুল ছাড়ে পালাইছে 😭 কলেজে নতুন ক্রাশ হইছে, ও-ই টাও ম্যাম 🤣হিহি
তৌহিদ
স্কুল কলেজে এমনই হয় বোধহয়। তবে পালিয়েছে মানে কি? রাফি!! 😃😃
রাফি আরাফাত
পালায় বিয়ে করছে 😂 তাও আবার স্কুলের স্যারের সাথে, যার কারনে দুজনকেই স্কুল থেকে বের করে দিছে😂
তৌহিদ
মানুষের মন বড় অদ্ভুত!!
শিরিন হক
অসাধান। এমনি তো হয় হয়েছিলো কোনো একদিন ভাইয়ের মতো ভালোবেসে ছিলাম শুনে কেঁদেছিল মৃণ্ময়। মৃন্ময়কে ফেরাতে আার যোগাযোগ করিনি। আজ ওর কথা মনে পড়লো খুব। যেখানে থাকুক ভালো থাকুন মৃন্ময়।
তৌহিদ
মৃন্ময়ের জন্য শুভকামনা রইলো। যেখানেই থাকুন তিনি যেন ভালো থাকেন।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপু।
মনির হোসেন মমি
হা হা হা
দুষ্টুর মানে বুঝতে আপনি পারেননি
এই দুষ্টু হল মমতার ভালবাসা
আর
যা দুষ্টু হল ভালবাসার ভাল লাগা।
এবার একটু ভাবুন,
নিজের চুল টানার একজনকে আনুন।ওখানেই আছে যত দুনিয়ার সুখ।
তৌহিদ
হ্য ভাই, পরে বুঝেছি তার স্নেহ কতটা পবিত্র ছিলো। তিনি ভালো থাকুন এই প্রার্থনাই করি।
আরজু মুক্তা
এটা একবার ফেসবুকে পড়েছিলাম।
আবারও ভালো লাগলো।
তৌহিদ
আবারও পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপু। শুভকামনা রইলো।
ছাইরাছ হেলাল
ভালোলাগা আর ভালবাসা থাকে।
সাথে কিছু হিংসা, যা ভালবাসার পরিপূরক।
তৌহিদ
ঠিক বলেছেন ভাই, ধন্যবাদ।
বন্যা লিপি
আহারে নিখাদ ভালোবাসায় হিংসুটে অনুভূতি এসে এতকাল পরে বড্ড নাড়া দিয়ে গেলো।
তা জানতে বড় ইচ্ছে করে……. লাজ লজ্জা ভেঙেছিলো কখনো??
তৌহিদ
না আপু, সেই লাজ ভাঙেনি। লেখা পড়েছেন জেনে ভালো লাগলো। পাশেই থাকবেন।
প্রদীপ চক্রবর্তী
এমন প্রেমের প্রেমিক হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।
এত এত ভালোবাসা আর ভালো লাগা। তাকে ঘিরে কত না অভিমান। ম্যাডামের প্রতি ক্রাশ।
বাহ্ বাহ্!
বিষণ ভালো লেখনী দাদা।
তৌহিদ
পবিত্র ভালোবাসা কার মনে কখন কিভাবে আসে বলা মুশকিল। সেদিক দিয়ে আমি ভাগ্যবান দাদা।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
প্রেম টা হয়েছিল শ্রদ্ধা আর শ্নেহের উপর ভিত্তি করে।
আপনার অবচেতন মন মাতৃ শ্নেহই চেয়েছিল, যে কারনে ম্যাডামের সন্তানকে হিংসে করেছেন, রাগ উঠেছিল নিজের মধ্যেই।
ভালো লেগেছে পোস্ট,
শুভ কামনা।
তৌহিদ
জ্বী ভাই, সুন্দর মন্তব্য করে বুঝিয়ে দিলেন আপনার মনটাও কত সুন্দর। পৃথিবীতে ভালো মানুষের বড্ড অভাব। সে দিক থেকে আমি ভাগ্যবান কিন্তু।
এমন ভালোবাসা সবাই পায়না।
শাহরিন
খুবই সরলভাবে সত্যিটি বলে ফেললেন। স্মৃতি সব সময় বেদনার নয় এটা প্রমাণিত হলো।
তৌহিদ
সত্যি সবসময়েই সুন্দর আপু। এসব মধুর স্মৃতি জীবনে।
শুভকামনা রইলো।
মাছুম হাবিবী
প্রথমে সালাম নিবেন ভাইয়া অনেকদিন আপনার সাথে কথা হয় না। ফেইসবুকেও আপনাকে খুঁজে পাইনা। ইদানিং ব্যস্ততার কারণে ব্লগেও কম অাসি। আজ আপনার পোষ্টটি পড়ে আমার স্কুল জীবনের একজন ম্যাডামের কথা মনে পড়ে গেল ।উনি আমাকে উনার সন্তানের মত আদর করতেন। আমি সব সময় উনার ক্লাসের পড়া শিখে অাসতাম। কোনোদিন মারেননি আমাকে। উনার যেকোনো কাজে আমাকে ডাকতাম। বড্ড মিস করি প্রিয় ম্যাডামকে। অনেক সুন্দর লিখেছেন ভাই
তৌহিদ
শুভকামনা রইলো মাছুম। লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
শাফিন আহমেদ
কলেজে এরকম একজন ম্যাডাম আমারো ছিল , এত অপরূপা সুন্দরী তিনি ছিলেন । তার ক্লাস কখনও মিস করিনি । ক্লাসে ঢুকলে তার দিকিয়ে তাকিয়ে থাকতাম । অনেক ভালো লাগলো লেখাটি , কিছুক্ষনের জন্য কলেজ জীবনে ফিরে গিয়েছিলাম । শুভ কামনা ।
তৌহিদ
লেখাটি পড়েছেন জেনে ভালো লাগলো ভাই। শুভকামনা রইলো।