একদিন আমাদের পাড়ার শেষ প্রান্তের বাড়িটিতে নতুন ভাড়াটিয়া এলো। পরীর মত দেখতে তিনটি ছোট ছোট মেয়ে সেই পরিবারে। ছেলের আকাঙ্ক্ষায় ওদের মা চতুর্থবারের মত সন্তানসম্ভবা। সন্তান জন্মদানের সময়টাতে তিনি হাসপাতালে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। মায়ের আঁচল ধরে ছোট্ট আমিও সেদিন হাসপাতাল বেডের কোণায় দাঁড়িয়েছিলাম। মুখে অক্সিজেন মাস্কসহ হাতে, শরীরে নানান রকম স্যালাইন, সুঁই আর তার প্যাঁচানো। তিনি নিঃশ্বাস নিচ্ছেন অনেক বড় করে। প্রতি নিঃশ্বাসের সাথে তার বিশালাকৃতির শরীর কয়েক ইঞ্চি উপরে উঠে যাচ্ছিলো। নার্সরা কেউ কেউ হাত পা চেপে ধরেছিলো। অনেক কষ্ট করে শ্বাস নেয়া, আবার ছেড়ে দেয়া। শ্বাস-প্রশ্বাস। বেডের রেলিঙের ফাঁক দিয়ে হতভম্ব হয়ে ভীত চোখে যমে-মানুষে লড়াই দেখি আমি। একপর্যায়ে নিঃশ্বাস ছোট হতে হতে নিস্তেজ হয়ে আসে সেই মায়ের। চারিপাশে কান্নার রোল উঠে। জীবনে সেই প্রথম আমার কারো মৃত্যু দেখা। দুঃস্বপ্নের মত গেঁথে থাকে ঘটনাটি আমার শিশুমনে।
বড় হবার পর, এক বর্ষার সকালে কলেজের জন্যে তৈরি হচ্ছিলাম। গ্রাম থেকে খবর আসে আমার এক কাজিনকে নৌকায় করে গ্রাম থেকে শহরে আনা হচ্ছে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। সাত মাসের গর্ভবতী সেই কাজিন সিঁড়িতে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর অবস্থা আশংকাজনক। আব্বা, আম্মা ছুটলেন হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। সন্ধ্যার কিছু আগে ফিরলেন শতাব্দীর নিষ্ঠুরতম সংবাদ নিয়ে। মা এবং সন্তান কাউকেই বাঁচানো যায়নি।
অনাগত সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখানোর স্বপ্নে বিভোর প্রতিটি মা-ই জানেন যে, জন্মদানের মুহূর্তে তাঁর নিজের জীবন প্রদীপটুকু নিভে যাবার সম্ভাবনা অনেকখানি। তবুও কি স্বপ্ন দেখা থেমে থাকে ! সন্তানের মুখখানা দেখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মাঝেও যেন সুখ ! অতঃপর জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত মায়েদের ত্যাগের কথা আর না-ই বলি ! তাই বলে বাবাদের অবদানকে খাটো করে দেখবার অবকাশ নেই। নিরবে, নিঃশব্দে, নিভৃতে একজন বাবা দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন আয়ের পিছনে ছুটে। সন্তানের মুখে ভালটা তুলে দিবে বলে, পছন্দের জামাটা কিনে দিবে বলে, কিংবা লেখাপড়ার সীমাহীন খরচ মেটাবে বলে। নিজের সুখটুকু বিসর্জন দিয়ে, নানান কায়দায় অর্থ সাশ্রয় করে সন্তানের জন্যে সুখ কেনেন বাবা’রা । এটাই শাশ্বত সত্য, সন্তানের প্রতি বাবা-মা’র ভালোবাসাই পৃথিবীর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা । তাঁদের এই ভালোবাসার গভীরতা বুঝি ক’জন ? বৃদ্ধ বয়সে তাঁদের নিঃসীম শূন্যতার কথা ভাবি ক’জন ? প্রতিটি সন্তানের বুকের গভীরে থাকুক বাবা-মায়ের জন্যে অন্তহীন ভালোবাসা।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
৮টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
নারী পুরুষ উভয় জীবনের শেষ বয়সে একেবারে একা হয়ে যান।সন্তানেরা মেতে থাকেন তাদের সংসারের খুটিনাটিতে সময় কৈ তাদের শেষ বয়সে মা বাবাকে দেখার।তবুও দেখতে হবে যত্ন নিতে হবে বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া মা বাবাদের কারন সন্তনদের পরবর্তী সুন্দর জীবন নির্ভর করে শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করা মা বাবাদের আর্শীবাদে।সুন্দর হৃদয় ছোয়া লেখা।আরো লিখুন।
রিমি রুম্মান
অনেক ধন্যবাদ। শুভকামনা জানবেন। -{@
জিসান শা ইকরাম
মা এর সন্তান গ্রহন করা থেকে জন্মদান পর্যন্ত যে কষ্ট, এই কষ্টের কারনেই একজন সন্তান তার মা এর পা ধরে আজীবন বসে থাকা উচিৎ।
বাবাদের কষ্ট মা এর কষ্টের তুলনায় কিছুই নয়, তারপরেও বাবারা তাঁদের জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন পরিবারের জন্য, নিজের জন্য সময় থাকে উপেক্ষিত।
আমরা যেন আমাদের বাবা মা এর প্রতি অনুগত থাকি, যত্নে রাখি তাঁদের।
রিমি রুম্মান
কিন্তু আমরা বেশিরভাগ মানুষই বাবা-মায়ের কথা ভাবি না একটা সময়ে এসে। ভাবি না এমন বাস্তবতা একদিন আমার সামনেও এসে দাঁড়াবে।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমরা মায়েরা কতো অল্পতেই খুশী হয়ে যাই। অথচ এটুকু খুশীও আমরা সন্তানরা দিতে পারিনা।
তবে আপু আমাদের দেশের বেশীরভাগ পুরুষরা পুত্র সন্তানের জন্য কাতর থাকে। আর এর জন্য কতো নারীদের জীবন বিপন্ন হয়!
মা-বাবা’রা যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক।
ভালো রেখো আপু। -{@
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুক আমাদের সকলের বাবা-মা। ভাল রাখুক সকলে নিজ নিজ বাবা-মাকে।
মৌনতা রিতু
মায়ের যে কষ্ট আপু, তা মাই জানে।
আমি হসপিটাল কোয়ার্টারে বড় হয়েছি তাই দেখেছি এমন সব অহরহ চিত্র। আমাদের হসপিটাল কোয়ার্টারে থাকার কারণে গ্রাম থেকে এরকম বহু আত্মিয় আসত আপু বাসায়। জানো, মাঝে মাঝে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে যেতাম। মা রেগে যেতো আমার উপর। পরে যখন বুঝতে শিখলাম হেল্প করতাম।
আমি তো আমাদের হসপিটালে প্রথম সিজার দেখতে গিয়ে পড়ে গেছিলাম মাথা ঘুরে।
বরাবরের মতো সুন্দর করে লিখেছো আপু।
রিমি রুম্মান
ছোটবেলায় আমরা অনেককিছুই না বুঝলেও এই বড়বেলায় এসে ঠিকই বুঝেছি। আর আমাদের মায়েরা যেমন ছিলেন, আমরাও কিন্তু সেই দোষ গুণগুলো পেয়েছি। ভাল থেকো।