সময় কাটতে চায় না। পুরনো স্মৃতিরা মন ছেঁকে ধরে। বয়সের ধর্মই যে এমনটা। সময় বন্দী কাজ তো এ সময়ে থাকে না। কোথাও হয়তো বসে আছি–খানিক পরেই কেমন ঝিম এসে যায়! আর ঝিমের মাঝে স্মৃতির আনাগোনা !
খুব ছোট বেলার এক স্মৃতি মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কতই বা বয়স হবে তখন–বয়স নয়, দশ! বালক বেলা যাকে বলে।
রানাঘাটে থাকতাম। তখন বন্ধু,বান্ধবীর কোন পার্থক্য নেই–চায়না,ননটাই,কল্যাণ,রীনা,বাবু সবাই আমারা বন্ধু–এক সঙ্গে খেলাধুলা করি। ছেলে মেয়েদের খেলা আলাদা হয় নি তখনও। রান্নাবাটি,আপত্তি নেই–পুতুল বিয়ে,আপত্তি নেই–লুকোচুরিও চলবে।
আমার এক স্কুলের সহপাঠী অন্য পাড়ায় থাকে। আমার চে বছর দুই তিনের বড় হবে। ও আমায় একদিন আড়ালে নিয়ে গিয়ে কেমন যেন হেসে বলে ছিল,কিরে তুই মেয়েদের সঙ্গে খেলিস?
আমি,কেন ? প্রশ্ন করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এই কেন’র উত্তর বন্ধুটি কি দিয়েছিল আজ আর মনে নেই। তবে সে বয়সে এ ব্যাপারটা আমার মনেও দু একবার উঁকি ঝুঁকি মেরে ছিল। আর ভেবে ভেবে সেই বয়সেও ছেলে ও মেয়ের মধ্যে একটা আড়াল ভাব যেন মনের কোনে কোথাও অনুভব করে ছিলাম। আর এই অনুভব করার পর থেকেই মেয়েদের সঙ্গে মেলা মেশা ক্রমশ কমে যাচ্ছিল। লজ্জা,নামক একটি গোপন ভাবের সৃষ্টি মনে মনে সক্রিয় ভাবেই যেন সৃজন হয়ে যাচ্ছিল।
ঠিক এমনি দিনের কথা। আমাদের পাশের বাড়ির ননটাইয়ের এক মাসতুত বোন এলো আমাদের এখানে বেড়াতে। নাম তার শান্তা–আমাদের চে বছর দুই তিন বড়ই হবে। আমাদের সঙ্গে শান্তা ভালই মিলেমিশে গেল।
আমি শুরুতে বুঝতে পারি নি,পরে মনে হয়ে ছিল,খেলাধুলার সব জাগায় শান্তা আমায় সাপোর্ট করে চলে। খেলার মাঝে ওর গা আমার গায়ের ছোঁয়া ছুঁই খারাপ লাগত না।
আমি ওই সময় হাত লাট্টু ঘুরাতে শিখে ছিলাম। ওই সময় হাত লাট্টুর বেশ প্রচলন ছিল। প্রায় আট দশ হাত সুত নিয়ে ছুঁড়ে মারতাম সে লাট্টু,ঘুরতে ঘুরতে সুতোর শেষ প্রান্তে গিয়ে আবার ঘুরপাক খেতে খেতেই ফিরে আসত আমার হাতে।
সে দিন লুকোচুরি খেলার ফাঁকে ফাঁকে আমি লাট্টু ঘোরাচ্ছিলাম। দেখলাম,শান্তা বেশ মনোযোগ দিয়ে তা দেখছিল। ও বেশ আনন্দ উপভোগ করছিল। বারবার হাসছিল। এক সময় আমার দিকে তাকিয়ে ও হেসে বলে উঠলো,তোর লাট্টু তো বেশ রে ! দে তো আমি ঘুরাব। মনে আছে,লাট্টু ছিল পিঙ্ক কালারের।
শান্তা আবার বলল,দে না আমি ঘুরাই !
–তুমি ! আমি বড় আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করে ছিলাম। এক তো মেয়েদের লাট্টু ঘুরাতে কখনও দেখিনি,তারপর এ লাট্টু না শিখে ঘোরানো কোন ভাবেই সম্ভব নয়।
–দে না—শান্তা আবার বলে উঠে ছিল। আমি দিতে ইতস্তত করছিলাম। উল্টাপাল্টা ছুঁড়ে মারলে নিশ্চয় আমার লাট্টুর দফা রফা হয়ে যাবে। শান্তা যেন একটু অভিমানিনী হয়ে উঠলো,কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে–আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে বলে উঠে ছিল, বাবাঃ,দেখছি,এই লাট্টুর ওপর খুব মায়া !
শান্তার চোখের দিকে আমার চোখ পড়েছিল–তার ভাষা সে দিন ততটা হয়তো বুঝতে পারি নি। আজ বুঝতে পারি সে চোখের ভাষা বড় মায়াময় ছিল। আমার মনের কোন কোণ থেকে যেন এক অনুভূতি উঠে আসছিল। শান্তার ঝংকৃত সে কথাগুলি আমার মনে রণিত হয়ে যাচ্ছিল।
–বাবাঃ ! এই লাট্টুর ওপর খুব মায়া ! সে বয়সের হঠাৎ সজাগ হয়ে যাওয়া মনটা বারবার স্মৃতিতে উঠে আসত।
শান্তার সঙ্গে আর কোন দিন আমার দেখা হয় নি। ওর আর কোন কথা আমার মনে নেই।
জানি স্মৃতি সতত সুখের হয় না–সুখদুঃখের মিলনেই তো জীবনের সম্পূর্ণতা।
সমাপ্ত
১৪টি মন্তব্য
আদিব আদ্নান
এ দেখছি স্মৃতির রণন ,সুখ-দুঃখ নিয়েই আমাদের স্মৃতিময়তা ।
আপনার লেখা পড়ার আলাদা আনন্দ আছে ।
তাপসকিরণ রায়
লেখা পড়ে আনন্দ পেয়েছেন জেনে খুশি হলাম।ধন্যবাদ রইল।
মিথুন
আজ কোথায় সেই লাট্টু, কোথায় সেই শান্তা ???
তাপসকিরণ রায়
তবু স্মৃতিটুকু থাক–ধন্যবাদ।
ছাইরাছ হেলাল
নষ্টালজিয়া , অদ্ভুত সুন্দর উপস্থাপনা ।
তাপসকিরণ রায়
অশেষ ধন্যবাদ রইল।
খসড়া
আদিব আদ্নান বলেছেনঃ
এ দেখছি স্মৃতির রণন ,সুখ-দুঃখ নিয়েই আমাদের স্মৃতিময়তা ।
আপনার লেখা পড়ার আলাদা আনন্দ আছে ।
তাপসকিরণ রায়
আনন্দ দিতে পারায় আমিও কম খুশি হই নি–অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
বনলতা সেন
ঝানু লেখিয়েদের এই এক মস্ত সুবিধে , সহজে গুছিয়ে সাবলীল উপস্থাপনায়
হৃদয়গ্রাহী করে আমাদের ভালমন্দ গছিয়ে দেবেই । এটি একদমই ঠিক না ।
বুলস্ আই ।
এতটা ভাল ভাল না ।
এরপর থেকে একটু খারাপ করে লিখবেন ।
ভাল থাকুন , লিখুন নিয়মিত ।
তাপসকিরণ রায়
ঝানু লেখক আমি নই– তবে পাঠকের ভাল লাগুক,এটা আমার চেষ্টা।আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
খব সুন্দর আর কোমল স্মৃতি
সেদিন লাট্টু দিলে শান্তার মায়াময় মুখটি আপনি দেখতে পেতেন না
আর আমরাও এত সুন্দর একটি মায়াময় স্মৃতির কথা জানতে পেতাম না ।
ভালো লেগেছে খুব
লিখুন এমন সুন্দর কিছু স্মৃতি ।
শুভকামনা ।
তাপসকিরণ রায়
আপনাদের ভাল লাগলে মনটা ভরে যায়–এমনি প্রেরণা দেবার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।
স্বপ্ন
পুরনো স্মৃতিরা আসলেই সুন্দর । ভালো লেগেছে খুব । -{@
তাপসকিরণ রায়
পড়ার জন্যে আর খুব ভাল লাগার জন্যে ধন্যবাদ।