নত হই অলক্ষ্যে

রিমি রুম্মান ৪ আগস্ট ২০১৫, মঙ্গলবার, ০৯:২০:৫৮পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৩৮ মন্তব্য

প্রবাসে প্রথম যে বাড়িটির একটি রুমে সংসার শুরু করি, সে বাড়ির অন্য রুমের মানুষজনের সাথে পরিচিত হচ্ছিলাম প্রতিদিনই একটু একটু করে। পাশের রুমের এক বড় ভাই আমি ইডেন কলেজে পড়েছি, নতুন হলে থেকেছি, এসব শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। চোখে মুখে আনন্দ খেলে গেলো। হঠাৎ চেনা আপনজনকে দেখলে যেমনটি হয়, ঠিক তেমন। বললেন, তিনি ইডেন কলেজ এলাকায় বেড়ে উঠেছেন। তাঁর মামা কলেজের দারোয়ান ছিলেন। বিধায় মামার কোয়াটারেই শৈশব, কৈশোরের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। ছোটবেলায় তিনি গেটে অপেক্ষারত ভিজিটরদের কাছ হতে দু’টাকার বিনিময়ে হোস্টেলের আপুদের রুমে বার্তা পৌঁছে দিতো। ক্যামন নিঃসংকোচে, ছলছল চোখে বলে যাচ্ছিলেন। অতঃপর “ওপি ওয়ান” লটারি জিতে এ দেশে আসা তাঁর। বলা বাহুল্য, আটের দশকের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্র যখন ওপি ওয়ান ভিসা দিচ্ছিলো, তখন শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ জরুরি ছিল না।

নয়ের দশকের মাঝামাঝি’তে আমি যখন এদেশে আসি, এখানে ওখানে হন্যে হয়ে জব খুঁজছিলাম। জবটা জরুরী ছিল। ভাষাগত সমস্যার জন্যে জব তখন সোনার হরিন। “জ্যাকসন হাইটস্‌” এ ভারতীয় এবং পাকিস্তানী’দের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য। সেখানে জব খুঁজতে গিয়ে আরেক বিপত্তি। অদ্ভুত মুখভঙ্গিতে হিন্দি জানি কিনা, উর্দু জানি কিনা__ এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। কেউ কেউ ম্যানহাটন গিয়ে জব খোঁজার পরামর্শ দেয়। দিনভর একের পর এক স্ট্রীট, এভিনিউ ধরে হাঁটছি, জব খুঁজছি। উদভ্রান্তের মত চেহারায় একটা সময় ক্লান্ত, ক্ষুদার্থ আমরা পিজ্জা কিনি। অর্ধেকটা খাই। শরীরের শেষ শক্তিটুকু ফুরিয়ে যাবার আগ অবধি জব খুঁজে বেড়াই…

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ক্লান্তিতে অবসন্ন আমরা পার্কের বেঞ্চিতে গিয়ে বসি। ছোট্ট পানির কল থেকে পানি খাই। তৃষ্ণা মেটাই। বাকি পিজ্জাটুকু খাই। ঠাণ্ডায় শক্ত হয়ে যাওয়া পিজ্জা সেই সময়ে তুলার মত নরম এবং সুস্বাদু মনে হয়। সেই সন্ধ্যায় অনেকটা সময় পা গুলো যখন বিদ্রোহ করছিলো, আর হাঁটতে চাইছিলো না, তখন নির্জন পার্কে অনেকটা সময় স্তব্দ হয়ে বসে থাকি। নয়ন বেয়ে গড়িয়ে পরা নোনা জলে ভাসতে ভাসতে বাবা-মা’এর সাথে থাকার সময়গুলোতে এসে স্থির হয়ে থাকি, স্মৃতিতে। কানে বেজে উঠে মায়ের আকুতি ভরা কণ্ঠস্বর__ “খাবার ঠাণ্ডা হইয়া যাইতাসে, গরম গরম খা… ঠাণ্ডা খাবার খাওয়া ঠিক না”।

অসাড় হয়ে আসা শরীরে রাতে বাড়ি ফিরেই মা’কে লিখি___ “আমরা ভালো আছি। সারাদিন ঘুরে বেড়াই। পিজ্জা খাই।” সত্য মিথ্যে মিলিয়ে চিঠিটি লেখার সময় ক্রমাগত হাত কাঁপছিলো। মা’কে চিন্তামুক্ত রাখার জন্যে বলা মিথ্যে কথাগুলো কখনো ক্ষতিকর হতে পারে না__ আমার বিশ্বাস।

এমনই দুঃসময়ের সময়টিতে পাশের রুমের সেই বড় ভাই একটি চাকুরির ব্যবস্থা করলেন, যে কোম্পানিতে তিনি সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন, সেখানে। বুকের ভেতর থেকে বিশাল এক পাথর নেমে আসে। প্রতি ভোরে বুক ভরে শ্বাস নিতে নিতে আমি কাজে যাই…

দীর্ঘ প্রবাস জীবনে আমি হয়তো অনেককেই জব পেতে সহযোগিতা করেছি সাধ্যমত। তবুও, আজো এতো বছর বাদেও এখানে ওখানে সেই বড়ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেলে আমি শ্রদ্ধায় নত হই সকলের অদেখার মাঝে।

আমরা কেউই জানিনা কার দ্বারা কখন, কিভাবে উপকৃত হবো। মানুষ কেউই তুচ্ছ নয়। মানুষের পরিচয় হোক কেবলই মানুষ।

৪২৫জন ৪২৫জন
0 Shares

৩৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ