প্রবাসে প্রথম যে বাড়িটির একটি রুমে সংসার শুরু করি, সে বাড়ির অন্য রুমের মানুষজনের সাথে পরিচিত হচ্ছিলাম প্রতিদিনই একটু একটু করে। পাশের রুমের এক বড় ভাই আমি ইডেন কলেজে পড়েছি, নতুন হলে থেকেছি, এসব শুনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। চোখে মুখে আনন্দ খেলে গেলো। হঠাৎ চেনা আপনজনকে দেখলে যেমনটি হয়, ঠিক তেমন। বললেন, তিনি ইডেন কলেজ এলাকায় বেড়ে উঠেছেন। তাঁর মামা কলেজের দারোয়ান ছিলেন। বিধায় মামার কোয়াটারেই শৈশব, কৈশোরের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন। ছোটবেলায় তিনি গেটে অপেক্ষারত ভিজিটরদের কাছ হতে দু’টাকার বিনিময়ে হোস্টেলের আপুদের রুমে বার্তা পৌঁছে দিতো। ক্যামন নিঃসংকোচে, ছলছল চোখে বলে যাচ্ছিলেন। অতঃপর “ওপি ওয়ান” লটারি জিতে এ দেশে আসা তাঁর। বলা বাহুল্য, আটের দশকের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্র যখন ওপি ওয়ান ভিসা দিচ্ছিলো, তখন শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ জরুরি ছিল না।
নয়ের দশকের মাঝামাঝি’তে আমি যখন এদেশে আসি, এখানে ওখানে হন্যে হয়ে জব খুঁজছিলাম। জবটা জরুরী ছিল। ভাষাগত সমস্যার জন্যে জব তখন সোনার হরিন। “জ্যাকসন হাইটস্” এ ভারতীয় এবং পাকিস্তানী’দের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য। সেখানে জব খুঁজতে গিয়ে আরেক বিপত্তি। অদ্ভুত মুখভঙ্গিতে হিন্দি জানি কিনা, উর্দু জানি কিনা__ এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। কেউ কেউ ম্যানহাটন গিয়ে জব খোঁজার পরামর্শ দেয়। দিনভর একের পর এক স্ট্রীট, এভিনিউ ধরে হাঁটছি, জব খুঁজছি। উদভ্রান্তের মত চেহারায় একটা সময় ক্লান্ত, ক্ষুদার্থ আমরা পিজ্জা কিনি। অর্ধেকটা খাই। শরীরের শেষ শক্তিটুকু ফুরিয়ে যাবার আগ অবধি জব খুঁজে বেড়াই…
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ক্লান্তিতে অবসন্ন আমরা পার্কের বেঞ্চিতে গিয়ে বসি। ছোট্ট পানির কল থেকে পানি খাই। তৃষ্ণা মেটাই। বাকি পিজ্জাটুকু খাই। ঠাণ্ডায় শক্ত হয়ে যাওয়া পিজ্জা সেই সময়ে তুলার মত নরম এবং সুস্বাদু মনে হয়। সেই সন্ধ্যায় অনেকটা সময় পা গুলো যখন বিদ্রোহ করছিলো, আর হাঁটতে চাইছিলো না, তখন নির্জন পার্কে অনেকটা সময় স্তব্দ হয়ে বসে থাকি। নয়ন বেয়ে গড়িয়ে পরা নোনা জলে ভাসতে ভাসতে বাবা-মা’এর সাথে থাকার সময়গুলোতে এসে স্থির হয়ে থাকি, স্মৃতিতে। কানে বেজে উঠে মায়ের আকুতি ভরা কণ্ঠস্বর__ “খাবার ঠাণ্ডা হইয়া যাইতাসে, গরম গরম খা… ঠাণ্ডা খাবার খাওয়া ঠিক না”।
অসাড় হয়ে আসা শরীরে রাতে বাড়ি ফিরেই মা’কে লিখি___ “আমরা ভালো আছি। সারাদিন ঘুরে বেড়াই। পিজ্জা খাই।” সত্য মিথ্যে মিলিয়ে চিঠিটি লেখার সময় ক্রমাগত হাত কাঁপছিলো। মা’কে চিন্তামুক্ত রাখার জন্যে বলা মিথ্যে কথাগুলো কখনো ক্ষতিকর হতে পারে না__ আমার বিশ্বাস।
এমনই দুঃসময়ের সময়টিতে পাশের রুমের সেই বড় ভাই একটি চাকুরির ব্যবস্থা করলেন, যে কোম্পানিতে তিনি সুপারভাইজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন, সেখানে। বুকের ভেতর থেকে বিশাল এক পাথর নেমে আসে। প্রতি ভোরে বুক ভরে শ্বাস নিতে নিতে আমি কাজে যাই…
দীর্ঘ প্রবাস জীবনে আমি হয়তো অনেককেই জব পেতে সহযোগিতা করেছি সাধ্যমত। তবুও, আজো এতো বছর বাদেও এখানে ওখানে সেই বড়ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেলে আমি শ্রদ্ধায় নত হই সকলের অদেখার মাঝে।
আমরা কেউই জানিনা কার দ্বারা কখন, কিভাবে উপকৃত হবো। মানুষ কেউই তুচ্ছ নয়। মানুষের পরিচয় হোক কেবলই মানুষ।
৩৮টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
কঠিন এক বাস্তবতা।
অন্য দিকে আমরা সাধারণত বিপদবন্ধুদের অবলীলায় ভুলে যাই, অস্বীকার ও করি।
অথচ আমরা সামান্য এগুলেই সহমর্মিতার হাতে অন্যের হাত তুলে নিতে পারি।
মায়েদের সুন্দর মুখের জন্য এটুকু আমাদের করতেই হয়।
রিমি রুম্মান
মায়েদের চিন্তামুক্ত রাখতে আমরা সব কষ্টের পরেও লিখি “আমি ভাল আছি”। জীবনের কঠিনতম সময়গুলোতে মায়ের জন্য বলা মিথ্যে কথাগুলো ক্ষতিকর নয়। তাই নয় কি ? ভাল থাকুন সব সময়।
তানজির খান
বিপদে মানুষকে যারা সাহায্য করে তারাই তো মানুষ।অসাধারণ হয়েছে লেখা। অনেকদিন পড়ে একটা সত্যিই ভাল লেখা পড়লাম।
রিমি রুম্মান
একজন মানুষ যার শৈশব কেটেছে অনেকটা পথকলি শিশুদের মতন। সেই মানুষটিই একসময় আমায় উপকার করেছে। আমরা কার দ্বারা কখন উপকৃত হবো, কেউ জানি না।
তানজির খান
হুম, ঠিক বলেছেন।
জিসান শা ইকরাম
অধিকাংশ মানুষ অতীত ভুলে যাই
কৃতজ্ঞতা আজকাল প্রায় লেখার একটি শব্দ হয়ে গিয়েছে………
ভাল লেগেছে আপনার এমন লেখা
প্রবাসে ভাল থাকুন।
রিমি রুম্মান
সেইসময় দেশ থেকে বেড়াতে আসা আমার উচ্চবিত্ত আত্মীয়রা বলাবলি করছিলো, যে আমরা লোয়ার ক্লাসের মানুষজনের সাথে উঠা বসা করছি। আমরা মানুষ। আমাদের পরিচয় কোন ক্লাস দিয়ে বিচার করা উচিত নয়। আমাদের পরিচয় হোক কেবলই মানুষ।
আজিম
অদ্ভুত। ভাল লাগলো আপনার এ লেখা। চোখের লোনা জল পেরিয়ে যাঁর দ্বারা সবচেয়ে কাঙ্খিত বস্তুটা মেলে, তাঁর প্রতি চরম শ্রদ্ধাটা এসেই যায়।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। ভাল থাকবেন। শুভকামনা রইলো।
আবু খায়ের আনিছ
অপরিচিত থেকে পরিচিত হতে কতক্ষণ। ভালো লাগল পড়ে।
রিমি রুম্মান
দেশের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমার দেশের মানুষজন একে অন্যের দুঃসময়ে এগিয়ে আসেন বলেই আমরা উঠে দাঁড়াই। ঘুরে দাঁড়াই। ভাল থাকবেন।
অলিভার
মানুষ কেউই তুচ্ছ নয়। মানুষের পরিচয় হোক কেবলই মানুষ। (y)
তবুও এই মানুষ আমরাই অন্যকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি।
শুভ কামনা ঐ সকল মানুষদের জন্যে যারা পাশে দাড়ায় বিপদে, যারা মনে রাখে, সম্মান করে তাদের ত্রাণকর্তাকে।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। আমরা যেন ভুলে না যাই সেই সব মানুষদের, যারা দুঃসময়ে এগিয়ে এসেছিল। অথৈ সমুদ্রে ভেসে যাওয়া থেকে কিনারে তুলে এনেছেন। ভাল থাকবেন।
লীলাবতী
আপনি একজন উদাহরন যোগ্য মানুষ।অনেক কিছু শিখছি আপনার কাছে আপু।
রিমি রুম্মান
আমাদের আশেপাশে প্রতিনিয়ত এমন কিছু ঘটছে, যা থেকে অনেককিছুই শিখার আছে। আমরা সবাই শিখছি প্রতিনিয়ত।
ব্লগার সজীব
আমার অনেক ঘটনা জানা আছে,যেখানে উপকারীকে ক্ষতি করেছেন মানুষ।আপনি অনন্যা আপু,অকপটে সব বলেন।শ্রদ্ধা জানাচ্ছি আপনার এই মনোভবকে।
রিমি রুম্মান
হ্যাঁ, এই উদাহরণের বিপরীত উদাহরণও আছে। তবে সেসব থেকে শিক্ষণীয় কিছু নেই। তাই সেগুলো লেখায় তুলে আনি না। ভাল থাকবেন সবসময়, প্রার্থনা করি।
সীমান্ত উন্মাদ
প্রবাস জীবনের নিরেট নিটল বাস্তবতার কথন এগুলো।
কিন্তু পৃথিবীর প্রতি প্রান্তেই আমাদের একান্ত নিজেদের কিছু মানুষ থাকেন, যারা কষাঘাত পরিপূর্ণ দুঃসময়ে বাড়িয়ে দেন হাত, পরম মমতায়। কিন্তু প্রাপ্তির পর আমরা কেউ কেউ ভুলে যাই তাদের কিন্তু আপনি ভুলেননি। বরং তাকে মনে রেখেছেন প্রতিনিয়ত অন্যকে সহযোগিতা করে। আমার আপনার এই প্রচেষ্টাই বেশি ভালোলেগেছে।
শুভকামনা জানিবেন নিরন্তর।
রিমি রুম্মান
উপকারীকে ভুলে যাওয়ার মাঝে কোন কৃতিত্ব নেই। বরং দুঃসময়কে … দুঃসময়ে বাড়িয়ে দেয়া হাতগুলোকে শ্রদ্ধার সাথে মনে রাখার মাঝে একরকম সুখকর অনুভুতি আছে। ভাল থাকবেন। শুভকামনা।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপনার জীবনধর্মী এসব লেখা মনের ভেতরে বিষাদ ছড়ালেও, জীবনের বাস্তবতাকে বোঝা-জানা যায়।
আগেও বলেছি, আবারও বলছি আমি আপনার লেখার ভক্ত। -{@ (3
জীবনপুরের পথিক তুমি
তোমার কাছেই জীবনমুখী গল্প
সুখ-দুঃখের চিত্রকল্প।
রিমি রুম্মান
একজীবনে অনেক ভাল থাকার গল্প আছে। সেইসব ভালো’র পিছনের বিষাদময় ইতিহাস আমরা ভুলে যাই। ভুলে যেতে চাই। সেইসব মনে রেখে মানুষের জন্যে ভালো কিছু করার প্রচেষ্টা থাকা উচিত আমাদের সবার। ভাল থাকুন সবসময়।
খেয়ালী মেয়ে
কাউকে সম্মান দিলে তার বিনিময়ে আরো সম্মান পাওয়া যায়, আমরা অনেক সময় একথাটা ভুলে যাই….আমরা কেউই আগে থেকে বলতে পারিনা কখন কে কার উপকারে আসবে…খুব সুন্দর করে বলেছেন কোন মানুষই তুচ্ছ নয়–শুধু আমাদের মাঝ থেকে কৃতজ্ঞতাবোধ,শ্রদ্ধাবোধ জিনিসগুলো না হারালেই হয়…
রিমি রুম্মান
কোন মানুষই তুচ্ছ নয়। মানুষের পরিচয় হোক কেবলই মানুষ। ভাল থাকুন সবসময়।
মরুভূমির জলদস্যু
## ঠাণ্ডায় শক্ত হয়ে যাওয়া পিজ্জা সেই সময়ে তুলার মত নরম এবং সুস্বাদু মনে হয়। ##
এমন কিছু অভিজ্ঞতা কখনো কখনো হয়, হয়তো তখন স্থান কাল আর পরিস্থিতি ভিন্ন থাকে।
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। ভাল থাকবেন। শুভকামনা রইলো।
অরণ্য
“আমরা ভালো আছি। সারাদিন ঘুরে বেড়াই। পিজ্জা খাই।”
সময়টা জয় করে এসেছেন বলেই কি সুন্দর লিখে গেলেন। (y)
রিমি রুম্মান
কখনো কখনো মিথ্যে ক্ষতিকর নয়। মা’কে ভাল রাখবার জন্যে বলা এই মিথ্যাটুকু সৃষ্টিকর্তা ক্ষমা করবেন, আমার বিশ্বাস ।
অরণ্য
🙂
স্বপ্ন
এই অকপট স্বীকারোক্তিতে মনের জোড় দরকার খুব।আপনার সে জোড় আছে।শ্রদ্ধা জানাচ্ছি আপনাকে আপু।
রিমি রুম্মান
আমরা আমাদের অতীত ভুলে গেলে সামনে এগিয়ে যেতে পারবো না। ভাল থাকবেন। শুভকামনা রইলো।
লীলাবতী
আপু আপনার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকবেন। শুভকামনা রইলো। -{@
শুন্য শুন্যালয়
ভুলে যাওয়াই যে সহজ। শ্রদ্ধার মাথা নত হবার কাজটি বড়ই কঠিন যেন কারো কারো কাছে। দেশের বাইরে শুরুর জীবনগুলো বড্ড ভয়াবহ হয়, তবে কেন যেন মনে হয় এ দিনগুলোর অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে।
রিমি আপু রিমি আপুর মতো থাকুক সবসময়, এই শুভকামনা।
রিমি রুম্মান
কঠিন সেই বাস্তবতার মুখোমুখি না হলে আমরা অনেক কিছুই শিখতে পারতাম না। কঠিন বাস্তবতা আমাদের আরও নমনীয় করে তুলুক। ভেতরে মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলুক। আমাদের পরিচয় হোক কেবলই মানুষ। ভাল থাকুন সবসময়।
মিথুন
মাথা নত হলেই মন উঁচুতে থাকবে। যতদিন এমন থাকবেন ততদিনই আপনি মানুষ। টাকার বিনিময়ে যে বার্তা পৌঁছে দিত, আজ সে খুশির বিনিময়ে আনন্দের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। শ্রদ্ধা এই মানুষের প্রতি……
রিমি রুম্মান
আমরা মানুষ কেউই তুচ্ছ নই। ভাল থাকুন। নিরাপদ থাকুন।
মেহেরী তাজ
আপু আপনি এতো সহজে সত্য গুলোকে বলে ফেলেন, ভালো লাগে।
হ্যা আপু কোন মানুষই তুচ্ছ নয়। মানুষ তো মানুষই।
রিমি রুম্মান
শুভকামনা জানবেন। ভাল থাকুন নিরন্তর।