ধারাবাহিক

তাপসকিরণ রায় ১৭ নভেম্বর ২০১৩, রবিবার, ১০:৫৪:১৫অপরাহ্ন গল্প ১৪ মন্তব্য

ঘামাসান লড়াই পার করে নব বধূ একদিন শাশুড়িতে পরিণত হয়। মাঝের ইতিহাস থাকে বড় সংঘর্ষ পূর্ণ। অনেক সুখ দুঃখের আখড়া ভেঙে তাকে এগিয়ে যেতে হয়। অনেক টানাপোড়েন সামলে সংসারের দাঁড়িপাল্লার ব্যালেন্স ঠিক রেখে তাকে এগিয়ে যেতে হয়–স্বামীকে ভালবাসা,তার আবদার রক্ষা করা,সময় করে রান্নাঘর সামলানো,খাবার পরিবেশন করা ইত্যাদি ইত্যাদি। এর মধ্যে অনেক স্বপ্নের ভাঙাগড়া পেরিয়ে চলতে হয় তাকে। সংসারকে জোড়াতালি তাকেই দিতে হয়। তাকেই অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে এক দিকে স্বামী আর অন্য দিকে শ্বশুর,শাশুড়ি,ননদ দেবরদের মান অভিমান ভঞ্জন করে চলতে হয়। এর মধ্যে তাকে কত যে খিঁচাতানি  সহ্য করতে হয় তার হিসাব নেই।

এই বউ থেকে শাশুড়ি হবার ইতিহাস কিন্তু দীর্ঘ কালের–এ ধারাবহ চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।

এবার আসুন বউ মা শাশুড়ির কিছু সংলাপ শোনা যাক–

–বউ মা,আজ তিন দিন হল তুমি বিয়ে হয়ে এসেছ কই একবারও তো রান্নাঘর মুখো হও নি !

মনোরমার তখন মনে হয়েছিল,বলে,মা,আপনিই তো হেঁসেলে ঢুকতে মানা করে ছিলেন! কিন্তু বলা হয় না–শাশুড়ি মার মুখের ওপর নাকি কথা বলতে নেই।

–বৌমা,আমি যে বলে ছিলাম তোমরা এমন হুট হাট ঘুরতে চলে যাবে না–ঘরের বাইরে বের হতে গেলে একটু বলেকয়ে বেরোতে হয়,এটাও কি তুমি জান না?

–না মা,আপনার ছেলে বলে রোজ রোজ বলার দরকার নেই–

–তুমি থামো,ছেলের দোষ দিয়ে তুমি পার পেতে যেও না কো !

আবার কোন দিন হয় তো শাশুড়ি বললেন,তোমার মত বউ তো দেখিনি ! তুমি সব কথা নিয়ে দেখি ছেলের কান ভরো ! এখন থেকেই লাগানো ভাঙানো শিখে গেলে ?

–না মা,আপনি বলেছেন সেটাই–

–জানি,জানি,আমার ছেলেটার আর কান ভারী কর না–মা ছেলের সম্পর্কটুকু আর নষ্ট কর না।

শাশুড়ির এমনি খোটা চলতেই থাকে। বৌ মনোরমা অনেক দিন চুপ করে শুনেছে। আজকাল দু চারটে কথা তার মুখ দিয়েও বের হয়ে যায়। আর তা হলেই শাশুড়ি যেন তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন,দেখে শুনে কি বউ আমি ঘরে তুললাম গো ! এ দেখি মুখে মুখে চোপা করে !

শাশুড়ি মনোরমার মা বাবাকে শোনান,আপনারা দেখছি মেয়েকে কিচ্ছু শিক্ষা দেন নি–চলন বলন কিছুই তো ভাল দেখি না মেয়ের!

–আপনাদের ঘরে দিয়েছি আপনারাই শিখিয়ে পরিয়ে নেবেন–বৌয়ের মা বাবার কথন।

–এই বয়সে আর কি শিখবে গো–যার হয় না নয়তে তার হবে নব্বুইতে ?

খুব খারাপ লেগেছিল মনোরমার,শাশুড়ি তার সম্বন্ধে চলন বলব শব্দটা কি করে বলতে পারলেন?

কিম্বা শাশুড়ি তাঁর ছেলেকে ডেকে বললেন,শোন রে দিলীপ,তোর বৌয়ের কথা শোন,আমায় বলে কি না রান্নাঘর ছেড়ে যেতে–সেই নাকি সব কাজ করে নেবে। এখন তো তোর বউ রান্না ঘর ছাড়তে বলছে—আর দুদিন পর তো ঘর ছেড়ে যেতে বলবে ! সারা জীবন অনেক সহ্য করেছি,আর সহ্য করবো না ! এমনটা হলে আমি তোকে বলে দিচ্ছি,হয় আমায় ঘর থেকে বের করে দিবি,আর তা  না হয়,বৌকে বাপের বাড়ি দিয়ে আসবি–এই আমার শেষ কথা।

স্বামী বেচারার অবস্থাও অনেকটা বেসামাল থাকে–মা বৌকে ব্যালেন্স রাখতে সেও কম হিমসিম খায় না!

মাঝে মাঝেই ঝাঁঝিয়ে ওঠেন শাশুড়ি,বউ কাপড়টা ছাড়–তোমার কি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নের বালাই নেই?

মনোরমা রেগে গিয়েছিল,আর কতদিন সহ্য করা যায়। দশবারটা বছর তো অনেক অনেক সহ্য করেছে,ও রেগে গিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে ফেলে ছিল,সব কিছু তো করছি,মা–আপনি আপনার কাজ নিয়ে থাকুন না–যান ঠাকুর ঘরের কাজ সারুন।

ব্যাস,আর বলার সুযোগ পায় নি মনোরমা। শাশুড়ি ঘরের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে চীৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলেন,ওরে দিলীপ দেখে যা,তোর বউ আমায় কি কথা না শোনাচ্ছে–সে বিরাট হই চৈ ব্যাপার। দিলীপ রেগে গিয়ে বৌকে থাপ্পড় মারতে হাত উঠায় আরকি। চ্যাঁচামেচি,সোরগোল,হই হট্টগোল।পাড়ার লোকজন ঘরে এসে হাজির হয়ে যায়।

অগত্যা মনোরমাকে বাপের বাড়ি যেতে হল। তাও পাঁচ ছ বছরের ছেলেকে শাশুড়ি জোর করে নিজের কাছে রেখে দিলেন।

বৌয়ের প্রতি শাশুড়ির এ হেন অত্যাচার উৎপীড়ন আজ যেন ঘরে ঘরের চিত্রগাঁথা। কোথাও বেশী,কোথাও কম। আবার অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে বউ হত্যার ব্যাপারে শাশুড়ির প্ররোচনাই প্রধান হয়ে থাকে। এমনটা যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে–এ যেন আমাদের দেশের অভিশাপ হরে দাঁড়িয়েছে!

বললে হয় তো খারাপ শোনাবে,বধূ নির্যাতনের অনেকটাই স্ত্রী জাতির প্ররোচনাতেই ঘটে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় স্ত্রী জাতিই স্ত্রী জাতির পরম শত্রু। এ কথা নিয়ে অন্তর থেকে মনন করা উচিত। এর প্রতিকার একমাত্র স্ত্রীজাতির দ্বারাই সম্ভব।

বাকি ঘটনায় আসা যাক–

মনোরমার মধ্যে সময়ের সাথে সাথে নিজের অজান্তেই শাশুড়ির লক্ষণগুলি অঙ্কুরিত হতে লাগলো। একমাত্র ছেলে,অমিতের বিয়ে হল। ঘরে ফুটফুটে এক বউ এলো। কয়েক দিন বৌমা আর শাশুড়ির মিলমিশ চলল। তারপর সেই একই চলচ্চিত্রের রিল ঘুরে যেতে লাগলো!

–বউ মা,তুমি তো রান্না ঘরে ঢুকতেই চাও না…

বৌমা,অনিমা চুপ করে থাকে,কিছু বলে না।

–বৌ,তোমরা না বলে হুট হাট ঘুরতে চলে যাও–ঘরে কত কাজ পড়ে থাকে,একটু বলেও তো যাও না!

ছেলে অমিত মাঝ রাতে দেখে অনিমা জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে—কোন গভীর ভাবনায় সে মগ্ন।

অমিত বলে ছিল,কি হল তুমি ঘুমাও নি?

অনিমা হাউ হাউ করে কেঁদে বলেছিল,তুমি আমায় বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দাও গো !

–সে কি ! কি হল তোমার?

–আমার কিছু শিক্ষা দীক্ষা নেই,আমার মা বাবা নাকি আমায় কিচ্ছু শিক্ষা দেয় নি…আমি আর সহ্য করতে পারছি না গো !

–কে বলেছে একথা–মা বলেছে?

মা ছেলের বচসা হল। অনিমা তার মধ্যে কিছু একটা বলে ছিল, অমনি মনোরমা চেঁচিয়ে উঠলেন,দেখ অমিত,দেখ,তোর বৌকে দেখ,আমায় কেমন কথা শোনাচ্ছে। মা ছেলের কথার মধ্যে ওর আসার কি দরকার,তুই বল ? সারাটা জীবন অনেক সহ্য করেছি আর করতে পারব না বলে দিচ্ছি !…

সেই এস.ওয়াজেদ আলীর‘ভারতবর্ষ’গল্পের মত বলতে হচ্ছে সেই ট্র্যাডিশন আজও চলেছে। কিন্তু এই ট্র্যাডিশন,জীবনের দুঃখময়,কলঙ্কময় এক ধারাবাহিক।

সমাপ্ত

৬১৫জন ৬১৪জন
0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ