(১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ )
আমার নাম ডানোস । বাস ইজিয়ান সাগর এর তীরে উত্তর দিকে আসুয়া আর হিটটাইট দের পাশের ছোট রাজ্য কাস্কিয়ান এ,
ছোট বেলা থেকে অন্ধ দাদী আর খালাসি দাদা এর কাছে মানুষ । দাদা মারা গেছেন আজ প্রায় ৬ চান্দ্র বছর আগে । দাদী কাজ করতে পারেন না । ভিক্ষা করে কোনভাবে দিন চালিয়েছেন আমাদের । তাই ১২ বছর বয়স থেকেই সংসার নামের জোয়াল টা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি আমি । কাজ করি একটা মাছ ধরা নৌকাতে । নৌকার মালিক কাহুন । জাতিতে হিটটাইট । কুঁচকানো বলিরেখা তে ঢাকা মুখ , সমুদ্রের নোনা জল লেগে কড়া হয়ে গেছে । সেই মুখ এ একরাশ বিরক্তি নিয়ে আমার হাত জাল গোটানো দেখেন আর বলেন “তোকে দিয়ে কিছুই হবে না রে ; শুধু তোর দাদা আমার বন্ধু না হলে কবে তোকে তাড়িয়ে দিতাম আমার নৌকা থেকে ”
ভালো আসলে আমারাও লাগে না । সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরেও হয়ত এক ঝুড়ি মাছ ও জোটেনা ঠিক ভাবে । অনেক দিনই নিঃস্ব আর রিক্ত হাতে ফিরে আসতে হয় । দাদি ঘুরে বেড়ান বন্দর এর কাছের কিছু এলাকাতে , ওইখানের নাবিকরা বড্ড রুক্ষ আর বদমেজাজি ।
ভিক্ষা দেয় না তাদের অনেকেই । কিন্ত বন্দর ছাড়া আর কোথাও ভরসাও নাই । শহর এ আরুনা* এর মন্দির আছে । তবে সেখানে দেবদাসী আর পুরোহিত দের ভিড় লেগেই থাকে । সেখানে একজন অন্ধ ভিখারিনী গেলে পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা পড়বে ।
আর এর আরও একটা কারণ ও আছে । সারাদিন নোনাজল নিংড়ে যখন বিকেলে আমি ফিরে আসি তটে তখন কাঁচের মত দুটি চোখ মেলে বসে থাকেন তিনি সমুদ্রের ধারে ।
আমি আসি , কেমন করে যেন আমার পায়ের শব্দ টের পেয়ে যান দাদি ।
এরপরে দুইজন অতি দরিদ্র মানুষ ফিরে যায় তাদের ঝুপড়ি এর দিকে ।
বন্দর ঘেঁষেই আমাদের চামড়া আর মাটির বাড়িটা । সেখানে যাবার পথে চোখে পড়ে মস্ত মস্ত সব জাহাজ নিজেদের মাস্তল এ পাল গুটিয়ে নোঙর ফেলেছে , দেখে মনে হয় যেন একেকটা পাহাড় ,
ঢেউ কেটে এরা চলে যায় সুদূর ইজিপ্ট , এলাম আর ফ্রিজিয়া তে ।
কেমন দেখতে দেশ গলো কে জানে । কেমন তাদের ভাষা তাদের চলন । কেউ জানে কিনা সেটাও দেখা উচিত ।
তবে আমার মত একটা আনাড়ি জেলের জন্য এই কথাটা ভাবা বিলাসিতা ।
দেবতারা আমার ভাগ্যে কি লিখে রেখেছেন কে জানে ?
এসব ভাবতে ভাবতে কখন নিজের ঝুপড়িতে চলে আসি সেটা খেয়াল ও থাকে না রাতের খাবার টা তাড়াতাড়ি সেরে নেই আমরা । যদিও এখানে সন্ধ্যাতেই শেষ খাবার টা খায় সবাই ।
বেশির ভাগ দিনেই পোড়া মাছ , আর বুনো যব চূর্ণ দিয়েই খেতে হয় ।
মাছ না পেলে । তখন পানির কাছের ছোট ছোট ফল কুড়িয়ে আনি আমি । সেটা দিয়েই পেটের জালা নেভাই ।
নিজের হাত পা আর পেটের কাছে গোঁজা পাথর এর ছোট চাকুটা ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছু আছে বলে জানা নাই আমার।
দাদা ছিলেন ফ্রিজিয়ার একটা জাহাজ এর খালাসি , তখন আর যাই হোক তিনবেলা ভুট্টা আর শালুক দিয়ে পেটপুরে খেতে পেতাম ।
তার কাছ থেকেই শুনেছিলাম বিভিন্ন দেশ এর গল্প । আর শুনতাম তারা দের দিক পরিবর্তন এর কাহিনী
কেমন করে তারা চলে যেতেন সুদূর আবিসিনিয়া , মেলুহা আর ইজিপ্টে ।
বাবা-মা কে কোন দিন দেখিনি আমি । কোন দিন তাদের ব্যাপারে প্রশ্নও করিনি । হয়ত ততখানি জ্ঞান আমার মাথাতেই দেননি মহান সূর্য দেবী ।
এরপরে এল সমুদ্রের সেই প্রবল পরাক্রান্ত ঝড় । যেন সবগুলো দানব নেমে আসল পৃথিবীর বুকে । এই ঝড় এর সময়ে নাকি দাদার জাহাজ টা ছিল একেবারে ভু-মধ্য সাগর এর বুকে , জল্পাই এর ছাইয়ে তৈরি সাবান সহ প্রায় ৩০ জন নাবিক এর প্রাণ হরন করে এনলিল কে ঠাই দিল নিজের বুকে সাগর।
সেই থেকেই আমি আর দাদি কোনভাবে বেঁচে আছি । জানি না কতদিন থাকতে পারব।
বন্ধু বলতে শুধু আছে শ্যামাক ।
আর কেউ না , আর কিছুই না ‘
রাত এর আঁধারে শুয়ে শুয়ে তারাদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ি প্রতিদিন । এইসব নিয়েই কাটে আমার জীবন ।
“আজকের দিনটা কিছুটা ভালো কাটবে বলে মনে হচ্ছে” কাহুন কে উদ্দেশ্য করে বললাম আমি; “মাছ উঠছে মন্দ না।”
মুখ বাঁকাল সে , “এটা ভরা মউসুম রে ছোড়া । প্রতি বছর সতিশ* তারা উঠে এই সময়ে , যদি একবার মিসরে নিয়ে যেতে পারতাম ,তাহলে দেখতি কত মাছ”।
“আর যদি একবার গভীরে গিয়ে ধরতে পারতাম” চকচক করে উঠল তার চোখ দুইটা ।
“কিন্ত ওইখানে বড্ড ভয়, সমুদ্রের দানোরা তো আছেই; এর সাথে আছে ঝড় আর জলদস্যু, আপন মনেই বলল সে “।
দেখলাম নিচে নীল রঙের ইজিয়ান আর উপরে চকচকে সূর্য । সেই সাথে নৌকার ডেকে রাখা সারিসারি রুপালি মাছ । মাছেরা শুন্য চোখে তাকিয়ে আছে যেন আমার দিকে ।
ইজিয়ান এর পৃথিবী দুইটা । পানির উপরে গ্রীক দের , আর পানির নিচে হিত্তাইট দের ।
গ্রীক রা মাছ খায় না , সমুদ্রের কোন খাবার পছন্দ ও করে না ,তাদের সুখ দিগন্তজোড়া ফসল এর মাঠে , জেলেরা সমাজ এর সবথেকে নিচু শ্রেণী ।
দাদার কাছে শুনেছি আমি নাকি জাতে গ্রীক । এরপরেও মাছ ধরাকেই পেশা বানাতে হয়েছে ।
সমুদ্রের নীল পানিতে আমার মুখের প্রতিবিম্ব এর দিকে দেখলাম । মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করে উঠল ; মনে হল পানিতে কেউ কালি গুলিয়ে দিয়েছে চারিদিকে কেমন একটা বদ্ধ ভাব এসে গেল যেন আমার দম কে কেউ আটকে দিচ্ছে । খচ করে একটা যন্ত্রণা অনুভব করলাম আমি ,
তড়িৎ গতিতে পেছনে ফিরে তাকালাম ,
কিছুই দেখলাম না । শুধু নীল পানিতে আমার প্রতিবিম্ব ছাড়া
নীল নাকি কষ্টের রঙ ।
গ্রীক রা বলে তাই । কিন্ত আমার কাছে সেটা মনে হয় না , তাহলে তো আকাশ এর রঙ নীল হত না দেবতা এনলিল এর রঙ নীল হত না ।
ভাবতে গিয়ে ফিরে এলাম কাহুন এর ধমক খেয়ে । “ ওই ছোঁড়া ! তাড়াতাড়ি জাল গুটা , জাল পেঁচিয়ে গেছে , ফেঁসে গেলে বললাম তোর পিঠের চামড়া আস্ত রাখব না”
নিজের কাজে মন দিলাম ।
আজ সকাল থেকেই মনটা কেমন করছে । মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই । জানি না কি কিন্ত সেটা থেকে একবারও মন কে সরাতে পারছি না ।
বিকেলে দুইটা মাছ নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে গেলাম নিজের বাড়ির দিকে ।
আজ বন্দর দিয়ে গেলাম না , একটু ঘুর পথে সোজা গিয়ে হাজির হলাম বাড়িতে , মনে হল দাদী যেন কিছু একটা বলতে চাচ্ছে আমাকে দূর থেকেও সেটা শুনতে পাচ্ছিলাম যেন আমি ।
কিন্ত বাড়িতে গিয়ে কাউকে পেলাম না । স্যাতসেতে নোনা মেঝেতে ছড়িয়ে আছে কাঁচা চামড়া এর বিছানা আর খড়কুটো , কিন্ত বুড়ীকে কোথাও পেলাম না ।
তাহলে কি আমার মন ভুল বলল?
বুড়ি কি এখনও বন্দর এই আছে ?
আমার অপেক্ষা করছে ?
কিন্ত তাহলে তো আসার পথেই দেখতে পেতাম ওকে ।
দাদিমা – চেঁচিয়ে উঠলাম আমি , এটা কখনই হবার মত না ।
অন্ধদের নিজস্ব অনুভূতি অনেক অনেক বেশী থাকে , এই ভুল হবার কথা তো তার না ।
নাকি এনলিল এর মন্দিরের দিকে চলে গেছেন-
খুজতে যাব বলে মনস্থির করলাম ; নিজের কুঁড়েটা ছেড়ে বাইরের দিকে এলাম , রাস্তার উপরে বেশ কয়েকটা বাচ্চা খেলছে নিজের মনে ।
আমিও এগিয়ে চললাম আমার একমাত্র আপনজন এর খোঁজে ।
বাবা-মা পরিচয় টা কখনও পরিস্কার ছিল না আমার কাছে । জন্ম থেকেই এই দুইজন বুড়ো এর সাথে আছি । এরা না থাকলে আমার নিজের বলার কেউ থাকবে না ।
এনলিল এর মন্দির টা শহর এর একদম মাঝখানে ।
পথিমধ্যে বাজার টা পড়ে , নানা রকম এর পন্য নিয়ে বসে আছে সব বিক্রেতারা , সিন্ধু থেকে আসা জিপ্সাম আর লবন।
হিটটাইট দের বানানো চাদর আর গ্রীক দের নিপুন হাতের মাটির পাত্র, যেখানে বহু বীরেরা তাদের কীর্তি খোদায় করে রাখেন ।
একপাশে পানশালা , সেখানে দেখলাম একটা ছোটখাট জটলা বেধে আছে । মাতাল দের মারামারি , হেঙ্কেত*খেয়ে মনে হয় লেগে গেছে দুই পক্ষের মধ্যে ।
মাছের বাজার এ আমার পরিচিত কিছু ব্যবসায়ী কে দেখলাম , তাদের কাছে জিজ্ঞেস ক্রএও কোন লাভ হল না – কেউ দেখেনি বুড়িকে ।
তখনই দেখতে পেলাম আনিতাস কে , নতুন ব্যবসা শুরু করেছে ছেলেটা ।
মাঝারি গড়ন এর গাড় চামড়ার রঙ । চোখ দুইটা ব্যবসায়ীদের ধূর্ত চোখ এর সাথে মিলে না ।
বড় বেশী চঞ্চল , অভিযাত্রী নাবিকের চোখ ওইদুটো ।
কাছে গিয়ে বললাম ওকে আমার বুড়িমার কথা ,
সে নিজেও তেমন জানে না কিন্ত আমার সাথে খুঁজে দেখতে রাজি হল । এমনিতেও এখন আর বাজারে বসবে না । কিছুক্ষন আগেই বিক্রি বাট্টা শেষ ওর ।
এনলিল এর মন্দির টা বিশাল , সারি সারি রোদে শুকানো ইট দিয়ে বানানো মোচাকৃতি ভবনটা
৮টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
সোনেলায় স্বাগতম -{@
আপনার লেখার উপস্থাপনায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম।নিজকে ডানোস থেকে আলাদা ভাবতে পারিনি একটুও।আমাকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন বন্দর এলাকায়, জীর্ণ বাড়িটিতে, বৃদ্ধা দাদির কাছে।
পরের পর্বের অপেক্ষায় আছি। দাদি চলে গেলে খারাপ লাগবে।
লিখুন নিয়মিত,অন্যের লেখাও পড়ুন। নীতিমালায় একটু চোখ বুলিয়ে নিবেন প্লিজ।
# পোষ্ট দেয়া,বিভাগ নির্বাচন সহ অন্য যে কোন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হলে মন্তব্যে জানাবেন
এখানের কেউ না কেউ আপনার সমস্যা সমাধানের পরামর্শ দিবেন।
শুভ কামনা।
ইমরান হাসান
আপনাকেও ধন্যবাদ , আসলে তো আমাদের গল্প গুলো আমাদেরই প্রতিচ্ছবি । নিজের চিন্তা নিজের চেতনা কে আমরা বুনে চলি একটা সাতনরি সুতার বন্ধনে । মন্তব্য টা আমার লেখার থেকেও বেশী ভালো লেগে গেছে ।
নীলাঞ্জনা নীলা
বাহ!
এমন গল্প নিয়ে সোনেলায় এসেছেন, আপনাকে স্বাগতম জানাচ্ছি।
১২০০ খ্রীঃপূঃ চলে গিয়েছিলাম পড়তে পড়তে।
জিসান শা ইকরাম নানা যা বলেছেন উনার মন্তব্যর থেকেই বলছি সকলের লেখাও পড়ুন। আর পোষ্ট দিয়েই চলে যাবেন না যেনো।
ইমরান হাসান
এটা ইজিয়ান এপক্যালিপ্স কে নিয়ে লেখা , ব্রোঞ্জযুগ এর সমাপ্তি কে নিয়ে রুপায়ন করা হয়েছে দ্যা সি পিপল কে । -{@
মোঃ মজিবর রহমান
ভাল লাগলো নতুন আঙ্গিগে লেখাটা।
শুভেচ্ছা রইল।
অপার্থিব
ভাল লেগেছে লেখাটি। পরের পর্বের অপেক্ষায়…
অনিকেত নন্দিনী
লেখার ধরণ সহজ ও সাবলীল। গল্প পড়তে গিয়ে যেনো সত্যি সত্যি কাস্কিয়ানেই চলে গিয়েছিলাম! চোখের সামনে দেখতে পেলাম নীল ইজিয়ান সাগর, গ্রিক আর হিটটাইটদের পৃথিবী, চামড়া আর মাটির তৈরি ঝুপড়ি, পানশালা, বাজার, মাছের বাজার আর এনলিলের মোচাকৃতি মন্দির।
দাদীর খোঁজ হলো কিনা জানার অপেক্ষায় রইলাম।
সোনেলায় স্বাগতম। -{@
ইমরান হাসান
ধন্যবাদ আপনাকেও পড়ার জন্য , সোনেলা তে এসে সত্যিই ভাল লাগছে , অনেক আন্তরিকতা আছে সবার মাঝে । 🙂