মায়ের সাথে তুমুল ঝগড়া চলছে, সাদা মাটা ঝগড়া না, একেবারে সাপে নেউলে (বেজি) ঝগড়া যাকে বলে! কেউ কাউকে ছাড় ছাড় দিতে রাজি নয় কিন্তু ঝগড়ার এক পর্যায়ে এসে মা ছেলে দুজনেই ভুলে গেছি আমরা কি নিয়ে ঝগড়া শুরু করেছিলাম। ঘরের অন্যান্য সদস্যরাও এসে আমাদের ঘিরে ফেলেছে কিন্তু কেউই ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করছেনা, হয়তো তাদের মজা লাগছে এই ঝগড়া দেখে। মা’কে কিছুটা ক্লান্ত মনে হচ্ছে, তিনি পাশে থাকা সোফায় বসে পড়লেন; সোফার হাতলে ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে তবলার বোলের মতো তেরে কেটে তাক তাক করতে করতে কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করছেন বলেই মনে হলো। আমিও নতুন করে কিছু বলছিনা কারণ এই মুহুর্তে আমাকে ডিফেন্সিভ মুডে থাকতে হবে, কারণ পরিবারের সব সদস্যরা আমার বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। হঠাৎ যেন মায়ের কন্ঠে ক্লান্তি দূরে গিয়ে জোর ফিরে এলো, মা এবার চেঁচিয়ে বলতে শুরু করলেন, “এ্যাঁই তুই আমার সাথে ঝগড় করবি? ঝগড়া করবি? পুঁচকে ছাওয়াল কোথাকার! এখনো নাক টিপলে দুধ বেরোয়, মুখে তুলে খাইয়ে দিতে হয়, নিজের কাপড় চোপড় ইস্ত্রি দেয়া শিখেছিস? আর তুই কিনা আমার সাথে ঝগড়া করবি! কত বড় স্পর্ধা! আমার সাথে ঝগড়া করবে, এই তুই কি দেখেছিস এই জীবনে? বল আমার থেকে বেশি দেখেছিস কিছু? …” বুঝলাম মা এবার দেখা না দেখা প্রসঙ্গে বিষয় ভিত্তিক ঝগড়া করতে চাইছেন।

এই পর্যায়ে মা’কে থামালাম, মা’কে বেশী দূর যেতে দেয়া যাবেনা যুক্তি দিয়ে আটকাতে হবে। আমি তখন মা’কে বললাম মা তোমার বয়স পঞ্চাশের উপরে হলেও তুমি তোমার জীবন কাটিয়েছো নির্দিষ্ট একটা গন্ডির ভেতরে, আত্মীয় স্বজনের বাড়ি ছাড়া ক’বার তুমি বাড়ির বাইরে বেরিয়েছো? তোমার জীবনটা এই দেয়াল ঘেরা বাড়ির চার সীমানার মাঝেই বন্দি! আমার থেকে দ্বিগুণ সময় তুমি পেয়েও আমার থেকে বেশি কিছু দেখোনি। মা এবার গলার স্বরে শব্দের ডেসিবল বাড়িয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন “কি বললি আমার থেকে তুই বেশি দেখেছিস? আরে এইতো ক’দিন আগেও তুই তেনার মধ্যে ছিলে (সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় তেনা মানে হলো সূতীর নরম কাপড়, নবজাতক বাচ্চাদের টাওয়ালের উপরে তেনা বিছিয়ে দেয়া হয় যাতে বার বার টাওয়াল না পাল্টিয়ে তেনা পাল্টানো যায়) আর আজ লায়েক হয়ে গেছিস, আমার থেকে বেশি দেখে ফেলেছিস! এ্যাঁই, তুই কি ঢেঁকি দেখেছিস? দেখেছিস ঢেঁকি দিয়ে কিভাবে ধান ভানে? গরুর গাড়িয়ে দেখেছিস? চড়েছিস? ডাঙ্গুলি, গোল্লাছুট, কানা-মাছি, খেলতে দেখেছিস? খেলেছিস?” মা একটার পর একটা বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে আমাকে যুক্তি প্রয়োগ করার কোন সুযোগই দিচ্ছেন না। কিন্তু আমিও কি কম দেখেছি? কম দেখছি? আমরা বা আমাদের এই প্রজন্ম দেখা দেখির সর্বোচ্চ শিখরে বাস করছি। মা এখনো থামছেন না, আমিও তাকে অগ্রাহ্য বলতে শুরু করলাম কি কি আমি দেখছি…

বয়স ত আর কম হলো না, একবিংশ শতাব্দী যখন প্রসূতি কালের গর্ভে শুয়ে নড়া চড়া করতে করতে ভূমিষ্ট হবার জন্য চিৎকার করছে ঠিক তখন বার্ধক্যগ্রস্থ বিংশ শতাব্দীকে জমকালোপূর্ণ মৃত্যুর আয়োজন করতে দেখেছি। সদ্য প্রসূত একবিংশ শতাব্দীকে নিয়ে আনন্দ উল্লাসের মুহুর্তকাল আগেই বিংশ শতাব্দীকে প্রসূতি কালের অতল গর্ভে দাফন হতেও দেখেছি। দেখার তালিকা মোটেও কম নয় সব দেখা উল্লেখ করা যেমন সম্ভব তেমনি কিছু দেখা প্রকাশ না করেও থাকা সম্ভব হলোনা। আশির দশকের শেষ প্রান্তে স্বৈরাচার পতনের লক্ষ্যে শীর্ষ দুই নেত্রীর জোটবদ্ধ আন্দোলন দেখেছি, রাজপথে গুলিবিদ্ধ নূর হুসেনকে শহীদ হতে দেখেছি, নব্বই দশকের শুরুতে স্বৈরাচার পতন দেখেছি, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে দেখেছি, পতন হতেও দেখছি। প্রথম বারের মতো দেশের শীর্ষ পদে নারীকে অধিষ্ঠিত হতে দেখেছি, প্রথম নারী হিসেবে বিরোধীদলের প্রধান হতেও দেখেছি, প্রেসিডেন্ট বা মন্ত্রী হওয়া রাজাকার দেখেছি। লগি বৈঠা হাতে নিয়ে রাজনীতির নামে মানুষ মারার রাজকীয় মহড়া দেখেছি, তরুণীর ছাব্বিশ টুকরো লাশ দেখেছি, ধর্ষণের সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে মিষ্টি বিতরণ করে আনন্দ-উল্লাস করতে দেখেছি, থার্টি ফার্ষ্ট নাইটের নামে বেহায়াপনা দেখেছি, দেশের শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো রাজনীতি আর সন্ত্রাসের করাল গ্রাসে ডুবতে দেখছি, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হতে দেখেছি, কোটি টাকার দূর্নীতির কলঙ্ক নিয়ে মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করতে দেখেছি, একই মন্ত্রীকে কলঙ্ক ঘাড়ে নিয়ে আবারো দপ্তরবিহীন মন্ত্রীর আসনেও আসীন করতে দেখেছি। রাস্তা থেকে, ঘর বাড়ি থেকে জলজ্যান্ত মানুষদের ধরে নিয়ে গুম করে ফেলতে দেখেছি, ফুটপাতে আশ্রয়হীন না খাওয়া মানুষ দেখেছি আরো কত কি দেখছি… নব্বই দশকের শেষের দিকে যখন একা একা ঢাকায় যাতায়াত করা শিখে গেছি তখন ঢাকার বেশির ভাগ দেয়ালে আইজুদ্দিনের কষ্টে থাকা দেখেছি, একই কায়দায় দেখেছি নাজিরের অপেক্ষা। মায়ের মুখে এখন আর কথার খই ফুটছেনা, আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন, মনে হচ্ছে তিনি আরোও কিছু শুনতে চাচ্ছেন। আমিও সুযোগ বুঝে থামছিনা… এবার তবে একটু অন্য দিকে দেখা দেখির প্রসঙ্গ নিয়ে গেলাম।

পরিবারের সবাইকে ট্রানজিস্টারের (রেডিও) সামনে গোল হয়ে বসে গান শুনতে দেখেছি, কলের গানের (গ্রামোফোন) চাকা ঘুরতে ঘুরতে দেখেছি, কাঠের বাক্সের টেলিভিশন দেখেছি, স্পুল মেশিনে ফিতা ঘুরতে দেখেছি, ক্যাসেট প্লেয়ার দেখেছি, সিনেমা হলে বসে সর্বাধিক ব্যবসা সফল ছবি বেদের মেয়ে জোৎস্না দেখেছি, ডিশের ছাতা দেখেছি, সিডি দেখেছি, ডিভিডি দেখেছি, প্রজেক্টরের আলোতে দেয়াল জুড়ে বিশাল পর্দার ছবি দেখেছি, ডেক্সটপ কম্পিউটার দেখেছি, ল্যাপটপ দেখেছি, আই-পড দেখেছি, এম.পি.থ্রি প্লেয়ার দেখেছি, ট্যাবলেট কম্পিউটার দেখেছি, থ্রিডি টিভি দেখেছি, ইন্টারনেট দেখেছি, গুগল ম্যাপে গোটা বিশ্ব দেখেছি, ব্লু রে ডিস্ক দেখেছি। টেলিফোনের তিন প্রজন্ম (এ্যানালগ, ডিজিটাল ও মোবাইল) দেখেছি, কর্ডলেস দেখেছি, এ্যালকন সেভেন ওয়ার্লেস ফোন দেখেছি। এতো দেখা দেখির কথা শুনে মায়ের মুখ কিছুটা ভোঁতা হয়ে আসছে! তিনি কপাল কুঁচকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছেন। আমি মায়ের দিকে তাকাচ্ছিনা, না তাকিয়েই অনর্গল বলেই চলেছি। মা এবার আমাকে ছোট্ট একটা ধমক দিয়ে থামালেন, বললেন ওসব যন্ত্রপাতির কথা বাদ দে, আমাদের সামাজিক বন্ধনের কি দেখেছিস বল? মা তার মুখটা কিঞ্চিত উজ্জ্বল করে আমার দিকে তাকিয়ে বসে পড়লেন, আমি আবারো বলতে শুরু করলাম; আত্মীয় স্বজনের পারস্পরিক বন্ধন দেখেছি, দাদা-দাদী, নানা-নানীর ভালোবাসা দেখেছি, মামীর হাতের দুধ ভাত দেখেছি। সন্তানের প্রতি মা-বাবার অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখেছি, আবার ক্ষুধার যন্ত্রণায় গর্ভজাত শিশুকে বিক্রি করতে দেখেছি, ডাস্টবিনের ময়লা আবর্জনায় শিশু সন্তানকেও ফেলে দিতে দেখেছি। শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের শ্রদ্ধা দেখেছি, দেখেছি ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের প্রবল স্নেহ আর ভালোবাসা, আবার শিক্ষকরূপী পশুকেও দেখেছি, দেখেছি একজন শিক্ষক কিভাবে তার ছাত্রীকে হাত পা বেঁধে ধর্ষণ করে, আর সেই ধর্ষণের দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করতেও দেখেছি। মা এবার আমাকে থামালেন, প্রচন্ড রাগে তার গা জ্বলে উঠছে; তিনি প্রায় হুংকার দিয়ে বললেন ঐ শিক্ষক নামের জানোয়ারটাকে দঁড়ি দিয়ে বেঁধে সারা দেশে চক্কর দেয়া উচিত ছিলো! আমি তখন বলে উঠলাম সেটাও দেখেছি মা। মা কিছুটা চোখ মুখ উজ্জ্বল করে বললেন তাই নাকি? তাহলে বল সেটা কিভাবে দেখেছিস, আমি বলতে শুরু করলাম…

গত ৫ অক্টোবর চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ থানার গন্ধ্যর্বপুর ইউনিয়নের মৈশামুড়া গ্রামের বালুর মাঠ এলাকায় সত্তর বছরের অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক তৈয়ব মাস্টারকে পিঠমোড়া করে বেঁধে শত শত লোকের সামনে সারা গ্রাম ঘোরানো হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মৈশামুড়া গ্রামের রহমত উল্লার ছেলে আব্দুল্লাহ দুবাই যাওয়ার জন্য তৈয়ব মাস্টারের ছেলে মোস্তফাকে ২ লাখ ৫২ হাজার টাকা প্রদান করে। আব্দুল্লাহ দুবাই গিয়ে বিমানবন্দরে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয় এবং ২৬ দিন জেল খেটে দেশে ফেরত আসে। তখন আব্দুল্লাহ ও তার বাবা তৈয়ব মাস্টারের কাছে গিয়ে মোস্তফার নেয়া টাকা ফেরত দেয়ার দাবি করেন, কিন্তু এই সময়ে ফেরত দেয়ার মতো তার হাতে এতো সংখ্যক টাকা ছিলোনা এবং তাৎক্ষণিক ভাবে উল্লেখিত পরিমান টাকা দিতে না পারায় আব্দুল্লাহ ও তার বাবা রহমত উল্লা মিলে তৈয়ব মাস্টারকে পিঠমোড়া করে বেঁধে শতাধিক লোকের সামনে সারা গ্রাম হাঁটায়, বয়সের ভারে নূয়ে পড়া তৈয়ব মাস্টার হাঁটতে না পারলে তার উপর চালানো হয় অমানবিক শারীরিক নির্যাতন। রহমত উল্লা এই গ্রামে প্রতাপশালী হওয়ার কারণে তাদের এই ঘৃণ্য ও পৈচাশিক আচরণের প্রতিবাদ তখন কেউ করতে পারেনি। এই ন্যাক্কার জনক ঘটনা সম্পর্কে আমি আরোও কিছু যখন বলতে যাবো ঠিক তখনি মা প্রচন্ড রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আমার গালে কষে একটা থাপ্পড় মারলেন, তার এই থাপ্পড়ের চোটে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। আমি বিছানায় উঠে বসলাম, আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। খাটের পাশে টেবিলে থাকা পানির গ্লাস হতে এক ঢোকে গ্লাসের সব পানি খেয়ে আমার ঘরে চার পাশে তাকালাম, ঘরের সব কিছুই ঠিক ঠাক আছে, শুধু নেই স্বপ্নে দেখা আমার অগ্নিমূর্তিমান মা! ঘুম ভাঙ্গার আগেই তিনি মিলিয়ে গেছেন, যদি তাকে এখন হাতের কাছে পেতাম তাহলে আরো একটা থাপ্পড় দেবার জন্য অনুরোধ করতাম। তার এই থাপ্পড়ে সাধারণ ঘুম নয়; যে বিবেক, যে মানবতা দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ শতাব্দীর পর শতাব্দী ঘুমিয়ে আছে সেই ঘুমন্ত বিবেক বা মানবতা যেন এক মুহুর্তে জেগে উঠে। দেখা না দেখার প্রাত্যহিক তালিকায় অনেক কিছু যুক্ত হচ্ছে রোজ রোজ, এবার শুধু দেখতে চাই মানুষের ঘুমন্ত বিবেকের জাগরণ। সভ্যতার শিখরে পৌছে আমরা যেন স্বগর্বে বলতে পারি আমরা এক সভ্য জাতি, মানুষের তরে এই প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে হাসি মুখে মরতে মরতে যেন বলতে পারি আমি এই সভ্য সমাজের শ্রেষ্ঠ মানব সন্তান।

জবরুল আলম সুমন
সিলেট।
২১শে অক্টোবর ২০১২ খৃষ্টাব্দ।

কোন সভ্যতা প্রজনন করি কি আমার দায়ভার?
৭৭৯জন ৭৭৯জন
0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ