শরৎকাল মানেই শারদীয়া দুর্গাপূজা! তাই প্রকৃতি ধীরে ধীরে মেতে উঠেছে শরতের সাজে। আর এ শরতে বাঙালি সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় পূজা হচ্ছে দুর্গাপূজা। এ পূজাকে ঘিরে কত প্রস্তুতি, পরিকল্পনা আর আনন্দ ইতিমধ্যে সাড়া জাগিয়ে তুলেছে সবার মনে। চারদিক ফুলের ঘ্রাণে সুবাসিত। শরতের ছোঁয়ায় কাশগাছ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। ইতিমধ্যে কুমোরটুলি কিংবা কুমোরপাড়ায় প্রতিমা তৈরির ধুম পড়েছে। অনেকে আবার অপেক্ষার প্রহর গুনছেন কবে আসছেন সকলের মাঝে দশধারিণী মা দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা!
তাই আসুন আজ জানি, কে এই দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গা ও কোন দেবতার তেজ বা শক্তিতে মহাদেবী দুর্গার দেহের কোন অঙ্গ গঠিত হয়েছিল তার ইতি কথাঃ
আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ট থেকে দশম দিন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় এই পূজা। একে বলা হয় দেবীপক্ষ।
আর এ দেবীপক্ষের সূচনা হয় মহালয়া দিয়ে।
তবে তার আগে জানি, মহালয়া কি।
কেন এই মহালয়া? মহালয়া কি গুরুত্ব ধারন বা পালন করে!
আমরা জানি, মহালয়া থেকে দুর্গাপূজার দিন গোনা। আকাশে আকাশে সাদা মেঘের ভেলা
আর ঢাকের তালে তালে মেতে উঠে দেবীর আগমনী বার্তা। নদীর তীর জুড়ে শুভ্র কাশফুলের সমারোহ। শীতভোরে শিশির ভেজা ঘাসের উপর শিউলি ফুল কুড়িয়ে দেবীর পায়ে পুষ্পাঞ্জলি।
এ যেন “দেবতার পায়ে লুটিবার তরে, হাসিছে ফুল প্রাণখোলে”!
মহালয়াঃ ২৫ সেপ্টেম্বর, বাংলা ৮ আশ্বিন।আর এ মহালয়ার ৫ দিন পর মহাষষ্ঠী।সায়ংকালে দেবীর বোধন, আমন্ত্রণ অধিবাস। এই দিনে দেবী দুর্গার চক্ষুদান করা হয়।
১৪২৯ বঙ্গাব্দ, ২০২২ইং দুর্গাপূজার সময়সূচীঃ
মহাপঞ্চমীঃ ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলা ১৫ আশ্বিন।
মহাষষ্ঠীঃ ১লা অক্টোবর বাংলা ১৬ আশ্বিন। মহাসপ্তমীঃ ২রা অক্টোবর বাংলা ১৭ আশ্বিন।
মহাষ্টমীঃ ৩রা অক্টোবর বাংলা ১৮ আশ্বিন।
মহানবমীঃ ৪ঠা অক্টোবর বাংলা ১৯ আশ্বিন।
বিজয়া দশমীঃ ৫ম অক্টোবর বাংলা ২০ আশ্বিন।
★১৫ আশ্বিন শ্রী শ্রী শারদীয়া দুর্গাদেবীর শুক্লা পঞ্চমীবিহিত পূজা প্রশস্তা।
★১৬ আশ্বিন শ্রী শ্রী শারদীয়া দুর্গাদেবীর ষষ্ঠ্যাদি কল্পারম্ভ ও ষষ্ঠীবিহিত পূজা।
★১৭ আশ্বিন শ্রী শ্রী শারদীয়া দুর্গাদেবীর নবপ্রত্রিকা প্রবেশ, স্থাপন, সপ্তম্যাদি কল্পারম্ভ ও সপ্তমী বিহিত পূজা।
★১৮ আশ্বিন শ্রী শ্রী শারদীয়া দুর্গাদেবীর মহাষ্টম্যাদি কল্পারম্ভ বিহিত পূজা।
★১৯ শ্রী শ্রী শারদীয়া দুর্গাদেবীর মহানবমী কল্পারম্ভ ও মহানবমী বিহিত পূজা।
★২০ শ্রী শ্রী শারদীয়া দুর্গাদেবীর দশমী পূজা সমাপনান্তে বিসর্জন।
সংস্কৃতে দুর্গা কথার অর্থ যিনি দুর্গ বা সংকট থেকে রক্ষা করেন। হিন্দু শাস্ত্রে দুর্গা শব্দটি ব্যাখ্যা করলে জানা যায়, দ অর্থে দৈত্য বিনাস, উ অর্থে বিঘ্ন নাশ, রেফ অর্থে রোগ নাশ, গ অর্থে পাপ নাশ, এবং আ কার অর্থে শত্রু নাশ। অর্থাৎ দুর্গার অর্থ যিনি দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ, ও শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেন।
পুরাণ মতে, দেবী দুর্গার স্বামী শিব। কন্যা লক্ষ্মী ও সরস্বতী যারা ধন- সম্পদ ও বিদ্যার দেবী হিসেবে পূজিত। অপরদিকে কার্তিক, গণেশ তাঁর পুত্র।
গণেশ হলেন বিঘ্ননাশকারী, শিল্প ও বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক এবং বুদ্ধি ও জ্ঞানের দেবতা রূপে পূজা করা হয়। বিভিন্ন শুভকার্য, উৎসব ও অনুষ্ঠানের শুরুতে তাঁর পূজা প্রচলিত আছে। কার্তিক হলেন দেবসেনাপতি। দেবী দুর্গার বাহন সিংহ।
দেবী দুর্গা দশভুজা। তার দশটি ভুজ বা হাত বলেই তার এই নাম। তার দশটি হাত তিনটি চোখ রয়েছে। এ জন্য তাঁকে ত্রিনয়না বলা হয়। তাঁর বাম চোখ চন্দ্র, ডান চোখ সূর্য এবং কেন্দ্রীয় বা কপালের উপর অবস্থিত চোখ – জ্ঞান বা অগ্নিকে নির্দেশ করে। দেবী হিসেবে দুর্গার গায়ের রং অতসী ফুলের মতাে সােনালি হলুদ। তিনি তার দশ হাত দিয়ে দশদিক থেকে সকল অকল্যাণ দূর করেন এবং আমাদের কল্যাণ করেন।
দেবীর আগমনঃ
হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী মনে করা হয়, দেবী দুর্গার মর্তে আগমন ও গমন যে বাহনে, তার উপর নির্ভর করে গোটা বছরটা পৃথিবীবাসীর কেমন কাটবে।
দেবী গজে আগমন।
ফলম্ -গজে চ জলদা দেবী শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা।
অর্থাৎঃ দেবীর আগমনে বসুন্ধরা শস্য পরিপূর্ণ থাকিবে।
গমনঃ দেবী নৌকা গমন।
ফলম্ – শস্যবৃদ্ধি, জলবৃদ্ধি।
অর্থাৎঃ দেবীর গমনে শস্যবৃদ্ধি এবং জলবৃদ্ধি হবে।
শ্রী রামচন্দ্র শরৎকালে সীতাকে উদ্ধারের জন্য রাবণের সাথে যুদ্ধের আগে ১০৮ টি নীল পদ্ম সহযোগে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন বলে জানা যায়।
আসল দুর্গা পূজা হলো বসন্তে, সেটাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়।
চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের বাসন্তী পুজোই বাঙালির আদি দুর্গাপূজা।
পুরাণ অনুযায়ী, সমাধি নামক বৈশ্যের সঙ্গে মিলে রাজা সুরথ বসন্তকালে ঋষি মেধসের আশ্রমে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। যা পরে বাসন্তী পূজা নামে প্রসিদ্ধ হয়। দেবী দুর্গার প্রথম পূজারি হিসাবে চণ্ডীতে রাজা সুরথের কথা উল্লেখ রয়েছে।
সুরথ সুশাসক ও যোদ্ধা হিসেবে বেশ খ্যাত ছিলেন। কোনও যুদ্ধে নাকি তিনি কখনও হারেননি। কিন্তু প্রতিবেশী রাজ্য একদিন তাঁকে আক্রমণ করে এবং সুরথ পরাজিত হন। এই সুযোগে তাঁর সভাসদরাও লুটপাট চালায়। কাছের মানুষের এমন আচরণে স্তম্ভিত হয়ে যান সুরথ। বনে ঘুরতে ঘুরতে তিনি মেধাসাশ্রমে পৌঁছেন।
ঋষি তাঁকে সেখানেই থাকতে বলেন।
কিন্তু রাজা শান্তি পান নি। এর মধ্যে একদিন তাঁর সমাধির সঙ্গে দেখা হয়। তিনি জানতে পারেন, সমাধিকেও তাঁর স্ত্রী এবং ছেলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তবুও তিনি বৌ-ছেলের ভালোমন্দ এখনও ভেবে চলেছেন।
তাঁরা দুজনেই তখন ভাবলেন, যাদের কারণে তাদের সব কিছু হারিয়েছে, তাদের ভালো আজও তারা চেয়ে যাচ্ছেন। ঋষিকে এ কথা বলায়, তিনি বলেন সবই মহামায়ার ইচ্ছা। এরপর ঋষি মহামায়ার কাহিনী বর্ণনা করেন। ঋষির উপদেশেই রাজা কঠিন তপস্যা শুরু করেন।
পরে মহামায়ার আশীর্বাদ পেতেই বসন্ত কালের শুক্ল পক্ষে রাজা পূজা শুরু করেন। শুরু হয় বাসন্তী পুজো।
শারদীয়া দুর্গাপূজাঃ
শ্রীরামচন্দ্র অকালে-অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে শরতের পূজাকে দেবীর অকাল-বোধন বলা হয়।
আর এ পূজায় পুরোহিত্য করেন স্বয়ং লঙ্কার রাজা রাবণ!
মহালয়ার গুরুত্বঃ
সনাতন ধর্মে কোন শুভ কাজ করতে গেলে বা বিবাহ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বপুরুষরা, যাদের পিতা-মাতা তাদের পিতা-মাতার জন্য, সাথে সমগ্র জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়, কার্যাদি-অঞ্জলিপ্রদান করতে হয়। আর এ তর্পণ মানে খুশি করা।
ভগবান শ্রী রামচন্দ্র লঙ্কা বিজয়ের আগে এইদিনে এমনই করেছিলেন।
সেই অনুসারে এই মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্ব পূরূষের স্মরন করে। পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তি কামনা করে তিল, জল দ্বারা অঞ্জলি প্রদান করেন। সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াতদের আত্মাকে মর্তলোকে পাঠিয়ে দেয়া হয়,।
প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাঁহাকে মহালয় বলা হয়। মহালয় থেকে মহালয়া শব্দটি।
পিতৃপক্ষের শেষদিন এটি ।
তারপর শুরু হয় দেবীপক্ষ বা মাতৃপক্ষ।
সনাতন ধর্ম অনুসারে বছরে একবার প্রয়াত পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে পিন্ড দান করতে হয়, সেই তিথিতে করতে হয় যে তিথিতে উঁনারা প্রয়াত হয়েছেন ।
সনাতন ধর্মের কার্যাদি কোন তারিখ অনুসারে করা হয় না। তিথি অনুসারে করা হয়ে থাকে।
মহালয়াতে যারা গঙ্গায় অঞ্জলি প্রদান করেন পূর্বদের আত্মার শান্তি কামনার জন্য, তাহারা শুধু পূর্বদের নয়।
বরং পৃথিবীর সমগ্র কিছুর জন্য প্রার্থনা ও অঞ্জলি প্রদান করেন ।
এ নিয়ে পুরোহিত দর্পনে উল্লেখ আছে,
যে-অবান্ধবা বান্ধবা বা যেন্যজন্মনি বান্ধবা।
অর্থাৎঃ যারা বন্ধু নন, অথবা আমার বন্ধু, যারা জন্ম জন্মজন্মান্তরে আমার আত্নীয় ও বন্ধু ছিলেন তারা সকলেই আজ আমার অঞ্জলি গ্রহন করুন।
এমনকি যাদের পুত্র নেই, যাদের কেউ নেই আজ স্মরন করার তাদের জন্যও অঞ্জলী প্রদান করা হয়।
যেষাং, ন মাতা, ন পিতা, ন বন্ধু –
অর্থাৎ যাদের মাতা-পিতা-বন্ধু কেউ নেই আজ স্মরন করার তাদেরকে ও স্মরন করছি ও প্রার্থনা করছি তাঁদের আত্মা তৃপ্তিলাভ করুক।
তর্পণ যে কেবল পূর্বপুরুষদের জন্য তা নয়, পৃথিবীর সামগ্রিক সুখ
যে কেবল পূর্বপুরুষদের জন্য তা নয়, পৃথিবীর সামগ্রিক সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যে, উত্তোরণের উদ্দেশে এই প্রথা। সেই কারণেই তর্পণ মন্ত্রে বলা হয়ে থাকে, “তৃপ্যন্তু সর্বমানবা”।
আর এই এ বিশেষ তিথিতে তর্পন করলে পিতৃপুরুষেরা আমাদের আশীর্বাদ করেন।
এ ছাড়াও এদিনে দেবী দুর্গার বোধন করা হয়।
বোধন অর্থ জাগরণ। তাই মহালয়ার প্রচারিত।
উল্লেখ্য যে বাংলাদেশের রাজশাহীতে প্রথম দুর্গা পূজার প্রচলন হয়। বাংলাদেশে প্রথম কবে দুর্গা পূজা শুরু হয়, তা নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে।
কারো কারো মতে, পঞ্চদশ শতকে শ্রীহট্টের (বর্তমান সিলেট) রাজা গণেশ প্রথম দুর্গা পূজা শুরু করেন।
তবে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে কিছু জানা যায় নি। বিভিন্ন গবেষকের লেখা থেকে জানা যায় ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহীর তাহেরপুর এলাকার রাজা কংস নারায়ণ প্রথম দুর্গা পূজার প্রবর্তন করেন। রাজা কংস নারায়ণ ছিলেন বাংলার বারো ভূঁইঞার এক ভূঁইঞা।
সনাতন হিন্দুরা বিভিন্ন শক্তির পূজারী।
আসুন জানি কে এই অসুরবিনাশিনী, দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাঃ
সনাতন হিন্দুরা বিভিন্ন শক্তির পূজারী।
কিন্তু অনেক সনাতন ধর্মাবলম্বীই জানেন না যে, আমাদের আরাধ্যা জগন্মাতা দেবী দুর্গার প্রকৃত রূপ কেমন।
কেন তাঁকে দশভুজা বলা হয়।
দেবী দুর্গা অনন্ত অসীম।
এই অসীমকে ভক্তির বাঁধনে অর্চনা করার জন্য চাই তাঁর রূপের কল্পনা, যাঁকে শাস্ত্রে বলা হয় “ধ্যান”।
আসুন আজ দেখি শাস্ত্রে দেবী দুর্গার ধ্যানের বর্ণনা –
ওঁ কাত্যায়নীং প্রবক্ষ্যামি রূপং দশভুজাত্মকাং।
হ্রীং জটাজুটসমাযুক্তাং অর্দ্ধেন্দুকৃতশেখরাম্।
লোচনত্রয় সংযুক্তাং পূর্ণেন্দুসদৃশাননাম্।।
অতসীপুষ্পবর্ণাভাং সুপ্রতিষ্ঠাং সুলোচনাম্।
(তপ্তকাঞ্চনবর্ণাভাং সুপ্রতিষ্ঠাং সুলোচনাম্।)
নবযৌবন সম্পন্নাং সর্ব্বাভরণ ভূষিতাম্।।
সূচারুদশনাং তদ্বৎ পীনোন্নত পয়োধরাম্।
ত্রিভঙ্গস্থানসংস্থানাং মহিষাসুরমর্দ্দিনীম্।।
মৃণালায়াত সংস্পর্শ দশবাহুসমন্বিতাম্।
ত্রিশুলং দক্ষিণেধ্যায়েৎ খড়্গং চক্রং ক্রমাদধঃ।।
তীক্ষ্ণবাণং তথাশক্তিং দক্ষিণেন বিচিন্তয়েৎ।
খেটকং পূর্ণচাপঞ্চ পাশং অঙ্কুশমেবচ।।
ঘণ্টাং বা পরশুং বাপি বামতঃ সন্নিবেশয়েৎ।
অধস্থান্মহিষং তদ্বদ্ধিশিরস্কং প্রদর্শয়েৎ।।
শিরোশ্ছেদোদ্ভবং তদ্বদ্দানবং খড়্গপাণিনম্।
হৃদিশূলেন নির্ভিন্নং নির্য্যদন্ত্রবিভূষিতম্।।
রক্তারক্তীকৃতাঙ্গঞ্চ রক্তবিস্ফুরিতেক্ষণম্।
বেষ্টিতং নাগপাশেন ভ্রূকুটিভীষণাননম্।।
সপাশবামহস্তেন ধৃতকেশঞ্চ দুর্গয়া।
বমদ্রুধিরবক্ত্রঞ্চ দেব্যাঃ সিংহং প্রদর্শয়েৎ।।
দেব্যাস্তু দক্ষিণং পাদং সমং সিংহোপরিস্থিতম্।
কিঞ্চিদূর্দ্ধং তথা বামমঙ্গুষ্ঠং মহিষোপরি।।
স্তুয়মানঞ্চ তদ্রূপমমরৈঃ সন্নিবেশয়েৎ।
প্রসন্নবদনাং দেবীং সর্ব্বকাম ফলপ্রদাং।।
উগ্রচণ্ডা প্রচণ্ডা চ চণ্ডগ্রা চণ্ডনায়িকা।
চণ্ডাচণ্ডবতী চৈব চণ্ডরূপাতিচণ্ডিকা।।
অষ্টাভিঃ শক্তিভিস্তাভিঃ সততঃ পরিবেষ্টিতাম্।
চিন্তয়েজ্জগতাং ধাত্রীং ধর্মকামার্থমোক্ষদাম্।।
বঙ্গানুবাদ:
কাত্যায়ন ঋষির কন্যা দশভুজা দেবী দুর্গার রূপের বর্ণনা এইরূপ-
দেবীর মাথায় জটা, অর্ধচন্দ্রের মত কপাল।
পূর্ণিমার চাঁদের মত মুখ, অতসীফুলের মত (তপ্ত স্বর্ণের মত) তাঁর গায়ের রঙ। তিনি সদ্য যৌবনপ্রাপ্তা এবং তাঁর সর্বাঙ্গ নানারকম অলঙ্কার দ্বারা ভূষিত। তাঁর দাঁত সুন্দর এবং ধারালো, বক্ষদেশ উন্নত।
তিন ভাঁজে দাঁড়িয়ে তিনি দৈত্য নিধন করছেন। পদ্মফুলের বোঁটার মত তাঁর দশটি হাতে রয়েছে নানারকম অস্ত্র। ডানদিকের উপরের হাতে আছে ত্রিশুল, তারপর ক্রমান্বয়ে খর্গ এবং চক্র। ডানদিকের সর্বনিম্ন দুই হাতে আছে ধারালো তীর এবং বর্শা।
দেবীর বাম দিকের সবচেয়ে নিচের হাতে আছে ঢাল ও তার উপরের হাতে ধনুক। এর উপরের হাতে আছে সর্প, অঙ্কুশ এবং কুঠার (ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে)।
দেবীর পায়ের কাছে মহিষাসুরের মাথার অবস্থান। মহিষের কাটা মাথা থেকে মহিষাসুরের দেহ অর্ধেক বেরিয়ে এসেছে, হাতে তাঁর খর্গ এবং বুকে দেবীর ত্রিশূল দ্বারা বিদ্ধ। তাঁর পেট থেকে নাড়িভূঁড়ি নির্গত হয়েছে। শরীর রক্তলিপ্ত। দেবীর হাতে ধরা সাপ অসুরের দেহকে বেষ্টিত করেছে। তবে উত্থিত ভ্রূ’তে দৈত্যের রূপও ভয়ঙ্কর।
দেবী তাঁর বাম হাত দিয়ে দৈত্যরাজের চুল টেনে রেখেছেন। দেবীর ডান পা তাঁর বাহন সিংহের উপরে এবং বাম পা সামান্য উর্ধে মহিষের উপরে অবস্থিত।
প্রবল যুদ্ধরত অবস্থাতেও দেবী তাঁর শান্তিপূর্ণ মুখাবয়ব ও আশীর্বাদী রূপ বজায় রেখেছেন এবং সমস্ত দেবতা দেবীর এই রূপের স্তুতি করেন।
নবদুর্গা ( দেবনাগরী: ) বলতে আভিধানিক ভাবে দেবী পার্বতীর দুর্গার রূপের নয়টি রূপকে বোঝানো হয়। হিন্দু পুরাণ অনুসারে এগুলো দেবী পার্বতীর নয়টি ভিন্ন রূপ ৷
এই নয় রূপ হল যথাক্রমে – শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী এবং সিদ্ধিদাত্রী ৷
উপনিষদে আছে, দেবী পার্বতী মহাশক্তির আধার। সব দেবতা দেবী পার্বতীর শক্তির মহিমায় মুগ্ধ হয়ে অবনত মস্তকে স্বীকার করেন যে ভগবান ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবসহ সব দেবতা পার্বতীর শক্তিতে বলীয়ান।
১) ব্রহ্মচারিণী : দেবী দুর্গার দ্বিতীয় রূপ ব্রহ্মচারিণী, দেবী ব্রহ্মচারিণীর মূর্তি খুবই চাকচিক্যমণ্ডিত। দেবীর ডান হস্তে পদ্মফুল, বামহস্তে কমণ্ডলু। দেবী ব্রহ্মচারিণী আনন্দময়ী, সুখের আধার। দেবী ব্রহ্মচারিণী তার পূর্বজন্মে ছিলেন হিমালয় কন্যা দেবী পার্বতী-হেমবতী।
২) চন্দ্রঘণ্টা : দেবী দুর্গার তৃতীয় রূপ হচ্ছে চন্দ্রঘণ্টা। তার কপালে অর্ধাকৃতি চন্দ্র শোভা পায়। দেবী চন্দ্রঘণ্টা অত্যন্ত উজ্জ্বল এবং মোহময়ী। গাত্রবর্ণ স্বর্ণোজ্জ্বল, ত্রিনয়নী দেবী চন্দ্রঘণ্টার দশ হাত।
৩) কুশমণ্ডা: দেবী দুর্গার চতুর্থ রূপ কুশমণ্ডা। দেবী কুশমণ্ডা অমিত শক্তির অধিকারী, তার মৃদু হাসির রেশে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে। দেবী কুশমণ্ডার আট হাত, আট হাতের সাতটি হাতে শত্রুনিধন মারণাস্ত্র শোভা পায়, ডান পাশের এক হাতে ধরা থাকে পদ্মফুল। দেবী কুশমণ্ডার বাহন ‘সিংহ’।
৪) স্কন্দমাতা : দেবী দুর্গার পঞ্চম রূপ হচ্ছে দেবী স্কন্দমাতা। পর্বতরাজ হিমালয়ের কন্যা তিনি, শিবের ঘরণী। তার পুত্রের নাম ‘স্কন্দ’, স্কন্দ দেবতাদের সেনাবাহিনীর অধিনায়ক। স্কন্দদের মা, তাই স্কন্দমাতা।
৫) কাত্যায়নী : দুর্গার ষষ্ঠতম রূপটি হচ্ছে দেবী কাত্যায়নী। ঋষি কাত্যায়নের প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী দুর্গাকন্যা ‘কাত্যায়নী’ রূপে ঋষি কাত্যায়নের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।
দেবী কাত্যায়নীর আট হাত, প্রতি হাতে ধরে আছেন শত্রু নিধনের জন্য মারণাস্ত্র।
দেবী কাত্যায়নী ত্রিনয়নী, তাঁর বাহন সিংহ।
৬) দেবী কালরাত্রি : দুর্গার সপ্তম রূপ হলো ‘কালরাত্রি’। দেবী কালরাত্রির গায়ের রং নিকষ কালো, মাথার চুল খোলা। গলার মালায় বিদ্যুৎ চমকায়। দেবী কালরাত্রি ত্রিনয়নী অর্থাৎ তিনটি চোখ এবং তিনটি চোখের গড়ন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মতো গোলাকার।
৭) মহাগৌরী : দুর্গার অষ্টম রূপের নাম ‘মহাগৌরী’। আট বছর বয়সী দেবী মহাগৌরীর গাত্রবর্ণ শঙ্খ, চাঁদ অথবা জুঁই ফুলের মতো সাদা। শুধু গাত্রবর্ণই নয়, তার পরিধেয় বস্ত্র, অলঙ্কারও শ্বেত-শুভ্র। দেবী মহাগৌরীর বাহন ষাঁড়, ষাঁড়ের পিঠে উপবিষ্ট অষ্টমবর্ষী মহাগৌরী দেবী ত্রিনয়নী, প্রতি পাশে দুই হাত মিলিয়ে তার হাতের সংখ্যা চার।
৮) সিদ্ধিদাত্রী-মহাশক্তি : দুর্গার মায়ের নবম রূপটি সিদ্ধিদাত্রী হিসেবে পুজিত হয়।
সিদ্ধির আট প্রকার : অনিমা, মহিমা, গরিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রকাম্য, ঈষিতভা, (ঈষিত্ব) ভাষিতভা (ভাষিত্ব)। মহাশক্তি এই আটটি সিদ্ধি পূরণ করেন। ‘দেবীপুরাণে’ বলা হয়েছে, স্বয়ং শিব দেবী মহাশক্তির সাধনা করে সকল সিদ্ধি লাভ করেছেন, সিদ্ধিলাভের পর দেবী মহাশক্তির ইচ্ছায় শিবের দেহের অর্ধেক নারীত্ব লাভ করে, যে কারণে শিব ঠাকুর ‘অর্ধনারীশ্বর’ রূপে বিখ্যাত।
৯) দুর্গা শৈলপুত্রী : শৈলপুত্রী মানে পাহাড়ের কন্যা। পর্বতরাজ হিমালয়ের কন্যা হচ্ছেন শৈলপুত্রী, দেবী দুর্গার নয় রূপের প্রথম রূপ। শৈলপুত্রী তার পূর্বজন্মে ছিলেন দক্ষরাজার কন্যা, নাম ছিল সতী, ভবানী। সতীদেবীর বিয়ে হয়েছিল ভোলানাথ শিবের সঙ্গে। ভোলানাথ শিব বেখেয়াল, সংসারে মন নেই, তাই সতীদেবীর পিতা দক্ষরাজ জামাতার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন না। পিত্রালয়ে স্বামীর অপমান সতীদেবী সইতে পারেননি, যজ্ঞের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দেন।
পরের জন্মে সতীদেবী হিমালয় রাজের কন্যা হয়ে জন্মগ্রহণ করেন, নাম হয় পার্বতী-হেমবতী। এই জন্মেও শিবের সঙ্গেই পার্বতীর বিবাহ হয়।
উপনিষদে আছে, দেবী পার্বতী মহাশক্তির আধার। সব দেবতা দেবী পার্বতীর শক্তির মহিমায় মুগ্ধ হয়ে অবনত মস্তকে স্বীকার করেন যে ভগবান ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবসহ সব দেবতা পার্বতীর শক্তিতে বলীয়ান।
প্রতি শরৎকালে নবরাত্রির নয় দিনে প্রতিদিন দেবী পার্বতীর দুর্গা রূপের এই নয় রূপের এক একজনকে পূজা করা হয়।
নব পত্রিকা কিঃ
নবপত্রিকা বাংলার দুর্গা পূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। নবপত্রিকা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ নয়টি গাছের পাতা তবে বাস্তবে নবপত্রিকা নয়টি পাতা নয়, নয়টি উদ্ভিদ।
নবপত্রিকা পূজা মহাসপ্তমী তিথিতে করা হয়ে থাকে। নবপত্রিকা রম্ভা কচ্চী হরিদ্রাচ জয়ন্তী বিল্ব দাড়িমৌ। অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা।
অর্থাৎ: কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মানকচু ও ধান।
একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে একজোড়া বেল সহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয় তারপর সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবী প্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়।
প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম কলা বউ।
নয়টি উদ্ভিদের অধিষ্টাত্রী দেবী।
নবপত্রিকার নয়টি উদ্ভিদ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে কল্পিত হয়ঃ
কদলী বা রম্ভা (কলা গাছ): কদলি গাছ এর অধিষ্টাত্রী দেবী ব্রক্ষ্মণী।
কচু (সাধারন): কচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কালিকা।
হরিদ্রা (হলুদ গাছ): হরিদ্রা গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী উমা।
জয়ন্তী: জয়ন্তী গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কার্তিকী।
বিল্ব (বেল গাছ): বিল্ব গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শিবা।
দাড়িম্ব (ডালিম/বেদানা গাছ): দাড়িম্ব গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা।
অশোক: অশোক গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শোকরহিতা।
মানকচু: মানকচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী চামুণ্ডা।
ধান: ধান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী লক্ষ্মী।
এই নয় দেবী একত্রে “নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা” নামে নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ মন্ত্রে পূজিতা হন।
কুমারী পূজাঃ
পৌরাণিক উপাখ্যান বা কুমারী পূজার ইতিহাস ও পটভূমি।
শাস্ত্রমতে কুমারী পূজার উদ্ভব হয় বানাসুর বা কোলাসুরকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য, কোলাসুর নামক অসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করে নেয়। কোলাসুর স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করায় বাকি বিপন্ন দেবগণ মহাকালীর শরণাপন্ন হন। সে সকল দেবগণের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী দেবতাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী মানবকন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করেন কুমারী অবস্থায় কোলাসুরকে হত্যা করেন। পুনর্জন্মে কুমারীরূপে কোলাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয়।
প্রতিবছর দুর্গাদেবীর মহাষ্টমী পূজাশেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। মতান্তরে নবমী পূজার দিনও এ পূজা অনুষ্ঠিত হতে পারে!
কুমারী পূজায় কোন ধরনের কুমারীর পূজা করা যাবে? পুরোহিতদর্পণ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি এবং মাহাত্ম্য বিশদভাবে বর্ণিত হযে়ছে। দেবীজ্ঞানে যে-কোন কুমারীই পূজনীয়। তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত হলেও কোথাও বলা নেই যে ব্রাহ্মণ কন্যাই কেবল পূজ্য। এক্ষেত্রে এক থেকে ষোলো বছর বয়সী যে-কোনো কুমারী মেয়ের পূজা করা যায়। অনেকের মতে দুই বছর থেকে দশ বছরের মেয়েদের পূজা করা যায়।
বয়সের ক্রমানুসারে পূজাকালে সকল বয়সের কুমারীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়, এগুলো নিচে উল্লেখ করা হলো—
১) এক বছরের কন্যাকে বলা হয় সন্ধ্যা।
২) দুই বছরের কন্যাকে বলা হয় সরস্বতী।
৩) তিন বছরের কন্যাকে বলা হয় ত্রিধামূর্তি।
৪) চার বছরের কন্যাকে বলা হয় কালীকা।
৫) পাঁচ বছরের কন্যাকে বলা হয় সুভগা।
৬) ছয় বছরের কন্যাকে বলা হয় উমা।
৭) সাত বছরের কন্যাকে বলা হয় মালিনী।
৮) আট বছরের কন্যাকে বলা হয় কুব্জিকা।
৯) নয় বছরের কন্যাকে বলা হয় কালসন্দর্ভা।
১০) দশ বছরের কন্যাকে বলা হয় অপরাজিতা।
১১) এগারো বছরের কন্যাকে বলা হয় রূদ্রাণী।
১২) বারো বছরের কন্যাকে বলা হয় ভৈরবী।
১৩) তেরো বছরের কন্যাকে বলা হয় মহালক্ষ্মী।
১৪) চৌদ্দ বছরের কন্যাকে বলা হয় পীঠনায়িকা।
১৫) পনেরো বছরের কন্যাকে বলা হয় ক্ষেত্রজ্ঞা।
১৬) ষোলো বছরের কন্যাকে বলা হয় অন্নদা বা অম্বিকা।
কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্বঃ
নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। পৌরাণিক কল্পকাহিনিতে বর্ণিত আছে, এ ভাবনায় ভাবিত হওয়ার মাধ্যমে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শী জ্ঞানে পূজা করেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের মতে— সব স্ত্রীলোক ভগবতীর এক একটি রূপ। শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশি প্রকাশ।
মনু সংহিতায় বলা হয়েছেঃ
যেখানে নারীরা পূজিত হন সেখানে দেবতার প্রসন্ন। যেখানে নারীরা সম্মান পান না, সেখানে সব কাজই নিষ্ফল।
দুর্গাপূজার অষ্টমী বা নবমীতে সাধারণ ৫ থেকে ৭ বছরের একটি কুমারীকে প্রতিমার পাশে বসিয়ে পূজা করা হয়।
চণ্ডীতে বলা হয়েছে—
“যা দেবী সর্বভূতেষু; মাতৃরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্য মধ্যে মায়ের রূপ”
হিন্দু ধর্মে বলা হয়ে থাকে- দেবকী কুমারী প্রতীকে হিন্দুদের মাতৃরূপে অবস্থিত। সর্বব্যাপী ঈশ্বরেরই মাতৃভাবে আরাধনা করার জন্য কুমারী পূজা করা হয়। আবার কুমারী পূজার মাধ্যমে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ নিজেকেই শ্রদ্ধা জানায়।
..
কোন দেবতার তেজ বা শক্তিতে মহাদেবী দুর্গার দেহের কোন অঙ্গ গঠিত হয়েছিল তার ইতি কথাঃ-
সনাতনী বন্ধুগণ মহাদেবী দুর্গার ধরাধামে আগমনের আর খুব বেশী সময় বাকী নেই।
কোন দেবতার তেজে মহাদেবী দুর্গার দেহের কোন অঙ্গটি গঠিত হয়ে ছিল। তা ছাড়া কেনই বা সকল দেবতাগণ মহিষাসুরের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। সে বিষয়টি আমাদের সকলের জেনে রাখা বিশেষ প্রয়োজন।
মহিষাসুরের জঘন্যতম অত্যাচার যখন দিনের পর দিন আরো কঠিন থেকে কঠিনতর হতে হতে লাগলো।
ঠিক সেই সময়ে মহিষাসুরের এ হেন নির্মম অত্যাচার দেবতাগণ কোন ক্রমেই আর সহ্য করতে পারলেন না। অবশেষে অত্যাচারী মহিষাসুরের প্রতি সকল দেবতাগণ অতিশয় ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলেন। অতঃপর অত্যাচারী মহিষাসুরকে নিধন করার নিমিত্ত ক্রমান্বয়ে সকল দেবতাগণেরই মহিষাসুরের প্রতি একে একে রুষ্টতার প্রতিফলন ঘটতে আরম্ভ হলো। যার ফলশ্রুতিতে সকল দেবতাগণের স্ব স্ব বদন থেকে একে একে স্বীয় তেজ অর্থাৎ শক্তি নির্গত হতে লাগলেন।
অত্যাচারী মহিষাসুরের প্রতি যে সমস্ত দেবতাগণ অতিশয় ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন।
সে সমস্ত দেবতাগণের মধ্যে সর্ব্ব প্রথমেই রুষ্টতা প্রকাশ করলেন ভগবান শ্রীমহাবিষ্ণু। ভগবান শ্রীমহাবিষ্ণু রুষ্ট হওয়ার ফলে তাঁর ভ্রূকুটি-কুটিল মুখ থেকে প্রথম তেজ নির্গত হতে লাগলো। অতঃপর রুষ্টতা প্রকাশ করলেন ভগবান শ্রীমধুসূদন । তিনি মহিষাসুরের প্রতি রুষ্ট হওয়ার ফলে ভিষণ কোপ প্রকাশ করতে লাগলেন। ফলে তখন ভগবান শ্রীমধুসুদনের ভ্রূকুটি-কুটিল মুখ থেকে তেজ নির্গত হতে লাগলো।
তারপর মহিষাসুরের প্রতি কুপিত হলেন ভগবান শম্ভু (দেবাদিদেব মহাদেব )।
তখন ভগবান মহেশ্বরের মুখ থেকে অতিশয় তেজ নির্গত হতে লাগলো। অতঃপর অতিকোপ পূর্ন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মুখ থেকে এবং ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতাগণের শরীর থেকে মহৎ তেজ নির্গত হতে লাগলো। সেই তেজ একত্রীত হয়ে এক সময়ে মহাশক্তিরূপিনী মহাদেবী ভগবতী দুর্গার শরীরের এক একটি অঙ্গ গঠিত হয়েছিল।
পাঠক বন্ধুগণের জ্ঞাতার্থে কোন দেবতার তেজে মহাদেবী দুর্গার দেহের কোন অঙ্গটি গঠিত হয়েছে,
তাঁর পূর্ণ বিবরণ নিম্নে প্রদান করা হলো–
১) দেবাদিদেব মহাদেবের তেজে মহাদেবী দুর্গার মুখ গঠিত হয়েছিল।
২ ) ধর্মরাজ বৈবস্বত যমের তেজে মহদেবী দুর্গার কেশ গঠিত হয়েছিল।
৩ ) ভগবান শ্রীমহাবিষ্ণুর তেজে মহাদেবী দুর্গার বাহু সমূহ গঠিত হয়েছিল।
৪ ) চন্দ্র দেবের তেজে মহাদেবী দুর্গার স্তনদ্বয় গঠিত হয়েছিল।
৫ ) দেবরাজ ইন্দ্রের তেজে মহাদেবী দুর্গার দেহের মধ্যভাগ গঠিত হয়েছিল।
৬ ) বরুণ দেবের তেজে মহাদেবী দুর্গার দেহের জঙ্ঘা ও ঊরূ গঠিত হয়েছিল।
৭) পৃথিবীর তেজে মহাদেবী দুর্গার নিতম্ব গঠিত হয়েছিল।
৮) প্রজাপতি ব্রহ্মা দেবের তেজে মহাদেবী দুর্গার পদযুগল গঠিত হয়েছিল।
৯) বসুগণের তেজে মহাদেবী দুর্গার করাঙ্গুলি গঠিত হয়েছিল।
১০) কুবেরের তেজে মহাদেবী দুর্গার নাসিকা গঠিত হয়েছিল।
১১) ব্রহ্মা দেবের তেজে মহদেবী দুর্গার দন্ত গঠিত হয়েছিল।
১২) সন্ধ্যার তেজে মহাদেবী দুর্গার ভ্রূদ্বয় গঠিত হয়েছিল এবং
১৩) পবন দেবের তেজে মহাদেবী দুর্গার কর্ণদ্বয় গঠিত হয়েছিল।
* ‘দুর্গা’ শব্দটিকে যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে আমরা দেখব এটি,
দ+উ+র+গ+আ – এই ভাবে সৃষ্ট। প্রতিটি বর্ণ নিজস্ব অর্থ বহন করছে।
১.দ অক্ষর – দকারং দুর্গতিহারং দুরন্তব্যাধিনাশনং দুর্গমেদুঃখদারিদ্রনাশায় দকারায় নমো নমঃ।
(অর্থাৎ যিনি দুর্গের নাশকারিনী, দুর্গতিহরণকারিনী , দুরন্তব্যাধিনাশকারিনী , দুঃখদারিদ্রনাশকারিনী, ভবরোগ বিনাশকারিনী সেই ‘দ’ কারকে নমস্কার)
২.উ অক্ষর – উকারং উগ্রতারেষং উগ্রশক্তিসমন্বিতং উচ্চৈঃপদপ্রদাতারং উকারায় নমো নমঃ।
(মহা-উগ্রশক্তিসমন্বিত উগ্রতারা যিনি , যিনি নিজ উচ্চপদ অর্থাৎ পরমপদপ্রদাত্রী, সেই ‘উ’ কারকে নমস্কার)
৩.র অক্ষর – রকারং রণমত্তারং রতিসন্তাপহারকং রসনারসসংযুক্তং রকারায় নমো নমঃ।
(যিনি রণমত্ত, রতিসন্তাপহারক, রসনাতে রস সংযোগকারিনী ‘র’কারকে নমস্কার)
৪.গ – গকারং গুণসম্পন্নং গ্রহদোষনিবারকং গুহ্যপদপ্রদাতারং গকারায় নমো নমঃ।
(গুণসম্পন্না, গ্রহদোষনিবারণকারিনী , যিনি পরম গোপনীয় নিজ ব্রহ্মপদপ্রদাত্রী সেই ‘গ’কারকে নমস্কার।
৫.আ – আকারং আত্মনাসক্তং আপদাপদবিগ্রহং আশুসন্তোষণং দেবং আকারায় নমো নমঃ।
(তদগতমনা, আত্মতত্ত্বে আসক্ত ব্রহ্মস্বরূপা , সর্ব আপদেরও আপদস্বরূপবিগ্রহ , কালেরও কাল যিনি, আশু অর্থে শীঘ্র সন্তোষকারিনী ‘আ’কারকে নমস্কার।
দুরন্ত ব্যাধিনাশকারিনী, দুর্গতি হরণকারিনী, শীঘ্র সন্তোষকারিনী, মায়া দুর্গের নাশকারিনী, সমস্ত বিপদেরও বিপদ যিনি, কালেরও কাল যিনি, যার চরণ ব্রহ্মপদ, সেই হলো ভগবতী দুর্গার স্বরূপ l
দেবী দুর্গার অস্ত্রের মাহাত্ম্য।।
ত্রিশুল: মহামায়ার হাতে ত্রিশূল তুলে দিয়েছিলেন মহাদেব৷ শোনা যায়, ত্রিশূলের তিনটি ফলার আলাদা আলাদা অর্থ রয়েছে। মানুষ তিনটি গুণ, তমঃ, রজঃ ও সত্যকে ব্যাখ্যা করে এই তিন ফলা৷
গদা: যমরাজ দিয়েছিলেন দিলেন কালদণ্ড বা গদা৷ যা আনুগত্য, ভালবাসা এবং ভক্তির প্রতীক।
বজ্রাস্ত্র: দেবরাজ ইন্দ্র দিয়েছিলেন বজ্রাস্ত্র৷ মায়ের হাতের এই অস্ত্র দৃঢ়তা এবং সংহতির প্রতীক।
সাপ: শেষ নাগ দিয়েছিলেন নাগহার৷ বিশুদ্ধ চেতনার প্রতীক হল এই সাপ।
অগ্নি: অগ্নিদেব দিয়েছিলেন এই অস্ত্র৷ জ্ঞান এবং বিদ্যার প্রতীক এই অগ্নি।
শঙ্খ: বরুণ দিয়েছিলেন শঙ্খ৷ যা জীব জগতে প্রাণের সৃষ্টি করে।
চক্র: মায়ের হাতে চক্র তুলে দিয়েছিলেন বিষ্ণু৷ যার অর্থ হল সমস্ত সৃষ্টি ও জগতের কেন্দ্রে অধিষ্ঠান রয়েছেন দেবী দুর্গা ।
তির-ধনুক: বায়ু দিয়েছিলেন ধনুক ও তির৷ উভয়ই ইতিবাচক শক্তির প্রতিক৷
পদ্ম: দেবীর হাতে ব্রহ্মা তুলে দেন পদ্ম৷ পাঁকে জন্মায় পদ্ম। কিন্তু তবু সে কত সুন্দর। তেমনই মায়ের আশীর্বাদে যেন অন্ধকারের মধ্যেও আলোর আবির্ভাব হয় সেই বার্তাই দেয় পদ্ম ফুল।
তলোয়ার: তলোয়ার হল মানুষের বুদ্ধির প্রতীক৷ যার জোরে সমস্ত বৈষম্য এবং অন্ধকারকে ভেদ করতে পারে মানুষ৷
অত্যাচারী ব্যাক্তি যত প্রবল শক্তিধরই হোক না কেন তার ধ্বংস অনিবার্য। আমাদের সকলের দাম্ভিকতা পরিহার করে সহজ সরল জীবন যাপন করা একান্ত প্রয়োজন। অন্যথায় শেষ পরিনতি কি ভয়ানক হতে পারে এই জাগতিক বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে মহিষাসুরই তার প্রকৃষ্ট প্রমান রেখে গেছেন। এমনি ভাবেই সময়ের বিশেষ প্রয়োজনে অত্যাচারী পরম বিক্রমশালি মহিষাসুরকে বধ করার নিমিত্তে, সকল দেবতাগণের সন্মিলিত প্রচেষ্টায় মহাশক্তিরূপিনী দেবী দুর্গার আবির্ভাব হয়েছিল। সেটিও আবার সকল দেবতাগণের স্ব স্ব শক্তি বা তেজের সমন্বয়ের মাধ্যমেই তিনির শুভাবির্ভাব হয়েছিল।
জয় মা আদ্যাশক্তি মহামায়া দেবী ভগবতী দুর্গা। পূনরায় ধরাধামের অসুর নিধনে আবির্ভূত হও মা। তুমি সকলের মঙ্গল করো, রক্ষা করো এ জগত সংসার।
তামসিকতা পরিহার করে সাত্ত্বিকভাবে পূজার্চনা করুন।
ঔঁ সর্বে ভবন্তু সুখিন:,সর্বে সন্তু নিরাময়া:,সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু,মা কশ্চিদ দুঃখ মাপ্নুয়াত, ঔঁ শান্তি শান্তি শান্তি।
অর্থাৎঃ সবাই যেন সুখী হয়,সকলে যেন নিরাময় হয়, সকল মানুষ পরম শান্তি লাভ করুক,কখনো যেন কেহ দুঃখ বোধ না করেন।
সকলকে আগাম শারদীয়া দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা।
..
তথ্যসূত্র উইকিপিডিয়া। সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত উপস্থাপন।
ছবিঃ সংগৃহীত।
১০টি মন্তব্য
আলমগীর সরকার লিটন
অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল কবি দা
প্রদীপ চক্রবর্তী
ভালো থাকবেন।
নার্গিস রশিদ
অনেক কিছু জানতে পারলাম। দুর্গা পূজার ঢাক বেজে উঠলে ছোটবেলায় সবায় মেতে উঠতাম। দেখতে যেতাম কোনটা কেমন হয়েছে। ডুবাতে যাওয়ার সময় সব ভাইবোন মিলে পিছে পিছে যেতাম। মেলা বসতো। খেলনা কিনে আনতাম মার দেয়া পয়সা দিয়ে । সাপটিবাড়ি বাজারের কাছে বিরাট পুকুরে ডুবানো হত। অনেক শুভেচ্ছা ।
প্রদীপ চক্রবর্তী
আহা!
তখন শৈশব ছিলো কত আনন্দে মেতেছেন।
কত স্মৃতি আজ।
সত্যিই শরৎ আসলে মনে এক আনন্দ বিরাজ করে।
আর এ আনন্দ পূজাকে নিয়ে।
ভালো থাকবেন।
সাধুবাদ আপনাকে।।
নিতাই বাবু
অনেক মহামূল্যবান পোস্ট। যেসব সনাতনী হিন্দু ভাই-বোনদের দুর্গাপূজা সম্বন্ধে বিস্তারিত মাহাত্ম্য জানা নেই, তাদের জন্য এই পোস্টই যথেষ্ট।
প্রদীপ চক্রবর্তী
হ্যাঁ, দাদা।
আমাদের সকলের এ বিষয়ে জানা উচিত।
পূজা হোক সাত্ত্বিকভাবে তামসিকতায় নয়।
ভালো থাকবেন।
পড়েছেন বলে আমি ধন্য হলাম।
সাবিনা ইয়াসমিন
তোমার সেরা পোস্ট, এবং এই লেখা দিয়ে তুমি সোনেলাকেও সমৃদ্ধ করেছো।
এমন একটা তথ্যবহুল পোস্ট লিখতে কতটা ধৈর্য, মেধা আর প্ররিশ্রম করতে হয়েছে বুঝতে পারছি।
তোমার লেখক স্বত্তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তোমার লেখার জগৎ আরও অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তার লাভ করুক, অনেক অনেক শুভ কামনা তোমার জন্য।
ভালো থেকো প্রদীপ 🌹🌹
প্রদীপ চক্রবর্তী
আমার সামান্য লেখালেখির প্রতি আপনার এই ভালোবাসা আমাকে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করে।
ভালো থাকবেন অনেক, দিদি।
খাদিজাতুল কুবরা
প্রতিটি ধর্মের খুঁটিনাটি জানলে মানুষ সমৃদ্ধ হয়। পড়ে যদি ও বুঝিনি তেমন কিছু।
সুন্দর সাবলীলভাবে তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ
প্রদীপ চক্রবর্তী
প্রতিটি ধর্ম সত্য ও সুন্দরের কথা বলে।
আর এ সত্য ও সুন্দরকে মননে ধারণ করতে হয়, বুঝতে হয় তবেই সমৃদ্ধির প্রসারতা!
সাধুবাদ আপনাকে।