দু’ধারে বিশাল বিশাল বিল্ডিংয়ের মাঝ খানে সরু পথ দিয়ে হেটে যাওয়া এক ভদ্রলোকের কানে এলো মেয়েলি কণ্ঠে কে যেন ডাকছে তার নামটি ধরে….।
-ঐ মইন্না চুরা!
আশ্চর্য ভদ্রলোক,নামতো ঠিক আছে কিন্তু সাথে ঐ চোর সূরটাতো আর কারো নয়।একান্ত আপন জনের কিন্তু এখানে কেন?এখানেতো আমার আপন জন বলতে কেউ আছে বলে মনে হয় না।আবারো ঐ একই ডাকের শব্দ।এদিক সে দিক তাকিয়ে ভদ্রলোক অবশেষে পেলেন তাকে।একটি পুরনো বিল্ডিয়ে চার তলার বারান্দায় দাড়িয়ে আছেন এক নারী। নীচের তার দিকে তাকিয়ে ডাকছেন।উচ্চতা আর মেয়েদের বয়স বাড়ার সাথে দেহের গঠন প্রণালী বাড়ার কারনে ভদ্রলোকটি তাকে তেমন চিনতে পারছেন না তাই সে না শুনার অভিনয়ে চলে যাচ্ছেন।মুহুর্তে আবারো বিকট শব্দে… ঐ মইন্না চুরা…এ দিকে..।ভদ্রলোক আবারো থমকে গেল…কণ্ঠটা যেন বেশ পরিচিত।উপর দিকে ভাল করে তাকালেন।দেখলেন ভদ্র মহিলাটি হাতের ইশারায় তাকে ওখানেই দাড়াতে বলল।কিছুক্ষণের মধ্যে একটি পিচ্চি এসে তাকে বাড়ীর ভিতরে নিলেন।এবার কাছে আসলেন সেই ভদ্র মহিলাটি।
-কি রে চিনতে পারস নাই?
তখনও তার সন্দেহ!
-আরে আমি মহুয়া(ছদ্ম নাম)
-ও আইচ্ছা তুই!একে বারে বদলে গেছিস!
-হুম শুধু কি আমি বদলাইছি!তুই বদলাইস নাই?আমিতো প্রথমে আইডিয়ায় ডাক দিয়েছি যখন তুই দাড়ালি তখন সিউর হলাম হ্যা এটা তুইই।তা কেমন আছিস?
-আছি!ভালই,,,তুই কেমন আছিস?
অতৃপ্তির স্পষ্ট ছাপ ওর মুখবয়ে তবুও বলতে হল…আছি এই তো ভাল।
ভদ্র লোকটি ওর বিষন্ন ভরা মুখটি দেখে নিজেকে সামলে নিলেন।চাপা কষ্টের সুখে একটু রশিকতা করলেন।…কি রে এতো গুলো বছর পর দেখা বাহিরে দাড় করিয়েই রাখবি?ভিতরে যেতে বলবি না।
-ও হ্যা তাইতো আয়।
ঘরের ভিতরে কি নেই!সব আছে যেমন আছে রাজপ্রসাদে অন্দর মহলে তেমনি জিনিসপত্র আর সাজসজ্জায় ষোল আনায় পরিপূর্ণ।ভদ্রলোকটি এসব দামী জিনিসপত্র গুলো দেখে ভাবেন প্রচুর ধন সম্পদ থাকলেই যে সুখ থাকে তার কোন নিয়ম নেই।দুজনে ড্রইং রুমের সোফায় বললেন।সে তার বন্ধবীর মুখমন্ডল দেখে কিছুটা আচ করলেন “সে সুখি হতে পারেনি।
-তারপর কি খবর তোর দৈনন্দিন সংসার?
-আছি এইতো ভা..লই,,,।
ভাল শব্দটি যেন উচ্চারণে কষ্ট হল তার বান্ধবীর।
-তোর কি অবস্থা,মাঝ খানে দেশের বাহিরে ছিলি শুনেছিলাম,তা এখন কি স্থায়ী ভাবে এ দেশে থেকে যাবি?
-হ্যা কি আর করব।
-বিয়ে করিসনি?
-বিয়ে!,,,হ্যা এ,,,!!!
-এমন করে বললি যেনো বিয়ে করে তুই ভুল করেছিলি!তা এ দেশের মেয়ে নাকি ভিন দেশী?
-নাহ এ দেশেরই ছিলো!
-ছিলো মানে,,,এখন নেই?
-তেমনটিই!
-কি হয়েছিলো?
-শখ করে নিয়ে গিয়েছিলাম বিদেশের মাটিতে,,,বছর খানেক যাবার পর ও’খোলস পাল্টায় ওর।আমিও বাধা দেইনি তুইতো জানিস আমি অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করি না।….তোর খবর কি?শুনেছিলাম মাঝ খুব ঝামেলা হয়েছিলো?
-হ্যা হয়েছিলো তবে নিজেকে সামলে নিয়েছি এখন।তোর জন্য কষ্ট লাগছে !আর যখনি এমন ঘটনা শুনি আমি অবাক হই!আমিওতো মেয়ে মানুষ কৈ আমিতো ওদের মতন বদলাইনি!হাজার দোষ থাকলেও ও’আমার স্বামী আবার গুরুতর অপরাধী হলেও আমি তার সহধর্মীনি।আমরা একে অপরকে বুঝতে শিখে গেছি।যদিও প্রথম প্রথম আমার দিকটি ছিলো একটু বেশী অহংকারী,বে-হিসাবী আর সন্দেহ প্রবন কেননা আমার ওনি বিদেশী এক কোম্পানীতে মার্কেটিং অফিসার যার কারনে অনেক ভিন দেশী মেডামদের সাথে তার সখ্যতা ছিলো হিংসে করার মতন।আমি যতই সন্দেহ করতে শুরু করলাম ততই যেন ওর কাছ থেকে আমি দুরে সরে যেতে থাকলাম।আমিও শুরু করলাম গুলসান ধানমন্ডির বড় বড় ক্লাবগুলোতে যাতায়াত,আনন্দ ফুর্তিতে মেতে থাকতাম দিন রাত,,একদিন আমার ওনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলো,আমি কেন এমন বেপরোয়া চলছি,আমি বলেছিলাম,..
-তোমার করনে,তুমি অন্য নারীদের সাথে মিশতে পারো আমি পারবো না কেন?
সে শুধু বলেছিলো,,
-দেখো আমি পুরুষ আর তুমি নারী।
আমি পাল্টা প্রশ্ন করি,
-সো হুয়াট?আমি নারী বলে আমার কি কোন স্বাধীনতা স্বাদ আল্লাদ নেই?
তখন হতেই সে আর কোন প্রশ্ন বা বাধা দেয়নি।এক দিন…ক্লাবে আমি মাতাল অবস্থায় হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে জ্ঞান হারালাম।জ্ঞান ফিরে দেখি আমি হাসপাতালে।আমার চারপাশে দাড়িয়ে আছে আমার আপনজনরা আর আমার শিয়রে বসে অনবরত মাথায় হাত বুলাচ্ছেন আমারি জান।তার পাশেই দাড়ানো ছিলো সেই বিদেশী মেডামকে যাকে আমি সন্দেহ করে বিপদগামী হয়েছিলাম।সে কিছু রজনীগন্ধ্যার ফুল দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানালেন যে আমি মা হতে চলছি।আমিতো অবাক অন্য সবার মুখের দিকে তাকালাম সবারই দেখি হাসি মুখ।
তখন হতেই প্রায়ই নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতাম…আমি বাঙ্গালী নারী,আমার নারীত্বেও থাকতে হবে পুরো বাঙ্গালীয়ানা নতুবা এ সমাজ হতে আমি হব বিচ্ছিন্ন তখন আমার জন্মদাতাও আমাকে তার ঘরে জায়গা দিবে না।কলেজ লাইফে কোথায় যেনো শুনেছিলাম “পুরুষ যদি জিদ করে তবে হয় রাজা আর নারী জিদ করলে হয় বেশ্যা।কথাটা তৎক্ষণাত মনে পড়ে ভাবলাম এ দুনিয়ার এ সমাজ! তেমনি আদলে গড়া।
কিছু ক্ষণ চুপ করে থাকল বান্ধুবীটি,অতপর তৃপ্তির মুচকি হেসে বলল-জানিস!আজ আমার খুব ভাল লাগছে,আমার ভিতরটা অনেকটা হালকা হালকা লাগছে,মনে হচ্ছে মনের গহীনে স্থির জমাটবদ্ধ একটি কঠিন শিলা এ মাত্র গলে জলের ঝর্ণার মতন গড়িয়ে পড়ল বাহিরে।
-মানে?
-মানেটা হল এ সব কষ্টের কথাগলো এমন ভাবে কাউকে এতো দিন বলতে পারিনি!
-হা হা হা…মনে পড়ছে স্কুল জীবনের কথা “তুইতো তখনো কোন ঘটনা ঘটলে কাউকে না বলা পর্যন্ত তোর মন শান্ত হত না।
-হুম ঠিক বলেছিস,,,,তারপর তোর সেই বউ কি এখনো বিদেশেই আছে?
-হুম বিদেশেই আছে তবে একই ছাতার তলে নেই।
-মানে?
-যাকে সে বিয়ে করেছিলো শুনেছি সেও নাকি তাকে তালাক দিয়েছিলো।যতটুকু জানি সে এখন নিঃসঙ্গতা আর হতাশায় দিন কাটাচ্ছে।
-তুই আবার যোগাযোগ করেছিলি?
-না,কষ্ট লাগলেও যে অধিকার ছেড়ে এ দেশে চলে এসেছি তাকে ফিরে পাবার কোন আগ্রহই আর মনে জাগাতে পারি না।কেবলি মনে হয় এ জগতে নারীরা কেবলি বিশ্বাস ঘাতক!তাইতো এখনো আর বিয়ে করিনি।
-তাই বলে জীবনটাকে এ ভাবে নষ্ট করবি?
-নষ্ট কইরে,,,এটাও এধরনের উপভোগ্য জীবন।পিছু টানহীন জীবন ভালইতো আছি।জীবনে মৃত্যুই যখন অবধারিত তখন আর এ শেষ বয়সে সূখ সম্মৃদ্ধির আশা করে কি লাভ।ভবঘুরে এই আমি,এইতো বেশ আছি! ভাল আছি।আজ উঠিরে বাসা যখন চেনা হলো আসবো মাঝে মাঝে।
-অবশ্যই আসবি…কতটা বছর পর তোকে দেখলাম,,,অন্যরা যারা তারা কেমন আছে জানিস?
দু’জনেই সোফা হতে উঠে বাহির পথে যাবার দরজার সামনে দাড়াল।
-কেউ চলে গেছে পরপারে,কেউ বা যাবার পথে,কেউ আছে খুব সূখে,কেউ বা অশান্তিতে…।
-তোর সব সময় কেবল তত্ব কথা…বাশার কেমন আছে?
-পরপারে খুব শান্তিতেই আছে।
-মানে?
-নেই,গত ১২ জুন ২০১৪ সালে সবাইরে পর করে চলে গেছে তার আপন দেশে।
বান্ধবীর দুচোখ বেয়ে জলের ধারা প্রবাহিত।ক্লাশের ফাষ্ট বয়,সিটি কলেজের ট্যালেন্টটেড ছাত্র,রাজনৈতিক অঙ্গনে বলিষ্ট বক্তা,কারো আদর্শবান স্বামী,শিশু দু সন্তানের গর্বিত পিতা!এ ভাবে অকালে চলে যাবে পরপারে ভাবতেই অবাক লাগে।দু’জনের মুখের ভাষা এক সময় হারিয়ে যায়।শুধু ইশারায় “খোদা হাফেজ” হলেন ভদ্রলোকটি।
১৫টি মন্তব্য
ইঞ্জা
মন ভারাক্রান্ত হলো। 🙁
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
হুম
ধন্যবাদ
ইঞ্জা
(3
খসড়া
ছোটবেলার বন্ধু ফিরে পাওয়া মানে স্বর্গ পাওয়া। কিন্তু শেষটা বড় মন খারাপ করে দিল।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
ঠিক তাই অন্য রকম এক অনুভুতি।ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
জীবন এমনই, যা চাই তা পাইনা, আর যা পাই তা চাইনা।
আপনার বন্ধু ভাল থাকুক।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
জীবনের হয়তো এটাই নিয়ম
পৃথিবী ত্যাগ করব আমি
স্বরণ করবে অন্য জন।
ধন্যবাদ -{@
মৌনতা রিতু
ছোটোবেলার ক্লাসমেট বন্ধুদের আমরা কতো নামে ডাকি, আজ তা মনে পড়ে গেলো।
সত্যি, নারী সে নারীই।
শেষটা পড়ে মন খারাপ হলো। কফি হাউজের গানটা এখানে মানাবে বেশ।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
হুম
সেই দিনগুলো আর ফিরে আসবে না।
ধন্যবাদ
আগুন রঙের শিমুল
জীবন, আহারে জীবন 🙁
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
কচু পাতাই পানি যেমন রে
ও জীবন টলমল টলমল করে
সেই মত মানুষের দেহ
কখন ঝরিয়া পড়ে জীবন রে
জীবন রে
ও জীবন ছাড়িয়া না জাস মোরে,
তুই জীবন ছারিয়া গেলে আদর করবি কাই
জীবন রে
তুই জীবন ছারিয়া গেলে আদর করবি কাই
জীবন রে
ধন্যবাদ
-{@
তৌহিদ ইসলাম
মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল, সুন্দর প্রকাশ ভাই।
মোঃ মজিবর রহমান
আমি সব ছেড়ে দিয়েছি যা হবার হবে। মনে দুঃখও যেমন ধারন করতে পারে দুখের পর দুঃখ জমা হয়ে দুখের পাহাড় হয়েও যেতে পারে। তাই দুঃখও করে লাভ কি জীবন ঐ রকমও। কষ্ট আর কষ্ট।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সহমত।আমিও আর ভাবি না তবে ভাবাতে ভাল লাগে মন চায় যদি এ ভাবনাগুলো কারো মনে গেথে যায়।ধন্যবাদ।
মোঃ মজিবর রহমান
হ্যাঁ তা ঠিক মনির ভাই, এই দেশে তারাই পরিবরতন করতে পারে যারা ক্ষমতাসীন।
আর বাস্তব হল সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যে পরিবরতন করতে তা সকলের বোধগম্য হয়। এবং আপনা আপনি পরিবরতন হল বড়দের(ভাই, দাদা, বাবা, মা, দাদী, শিক্ষক, মানে অল মুরুব্বী) দেখে, শুনে, শিখে তা কারোর নিকট কষ্টের বা দুর্ভেদ্য নয়।