আয় স্পর্শ করি মেঘের জল…

সবাইকে অবাক করে দিয়ে একই কলেজে চাকরী আমাদের। এখানেও ছাত্র-ছাত্রীদের প্রিয় শিক্ষিকা তুই।এতো ভালোবাসা দেখে আমার হিংসের চেয়ে কান্না পেতো, জানিস? সুখের কান্না। শুধু সৃষ্টিকর্তাকে বলতাম তোর ওই হাসিটুকু যেনো আজীবন রাখে। একদিন এ কথাটা তোকে বলায় তুই বলেছিলি, “শোন দক্ষিণাটা আমায় দে, আমি আমার হাসি তোকে সবসময় দেবো। সৃষ্টিকর্তাকে ডেকে কিছুই হবেনা, সে তো বসে আছে কখন ছিনিয়ে নেয়া যায়।”  আমি রেগে যেতাম, ভয় হতো। যদি কিছু হয়ে যায়! আর হয়েছিলোও তো। পল্লবের প্রতারণা তোকে কি করেনি। কিন্তু সেটাকেও হাসি মুখেই পার করে গেছিলি। কোথায় পাস এতো শক্তি মনে জিজ্ঞাসা করতেই বললি, “কাঁদবো? কেন কাঁদবো? জীবন থেমে থাকেনা। আর শোন ওটার সাথে বিয়ে হলে আমার আরোও সর্বনাশ হতো।”  ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে রইলাম কি বলিস এসব? তুই চোখ নাচিয়ে বললি “দেখ কেঁদে তো কিছু পাবোনা। তবে দেখিস আমার মনকে জড়িয়ে নিতে একজন আসবে। যার কাছে আমি নিজেকে আটকে নেবো কোনো আশা না করে।”  কিসব যে পাগল পাগল কথা বলতি তুই। পুলকের সাথে দেখা হতেই বললাম সব। হেসে বললো, “ওর মনের গভীরে ডুব দিতে যাসনা, তল খুঁজে পাবিনা। বরং কষ্ট বাড়বে তোর। আর ক্ষতি হবে তোর্ষার।”

একদিন ঠিক করলাম একটা গেট টুগেদার করবো আমাদের গ্রুপের। তখন আমাদের গ্রুপের সকলেরই চাকরী হয়ে গেছে। একটা অন্যরকম সময় চলছিলো জীবনে। যারা প্রেম করছিলো, তারা ভাবছিলো এবার বিয়েটা করেই নেবে। যাদের কোনো প্রেম ছিলোনা, বাবা-মা উঠে পড়ে পাত্র-পাত্রী দেখা শুরু করে দিলো। তখন আমার বিয়ের কথা চলছিলো। আর তূর্য চাকরী পেয়েই পরিণীতাকে বিয়ের জন্যে তোড়জোড় শুরু করলো। পরিণীতা বিশাল বড়ো লোকের মেয়ে, আমার ওকে কখনোই ভালো লাগেনি। কেমন জানি ভন্ড ভন্ড লাগতো। এদিকে আমায় কোত্থেকে কে যে এসে দেখে যায়, নিজেও জানিনা। তালিকা বিশাল। তুই বললি, “পৌলমী এ সমাজে তুই মেয়ে হিসেবে ভাগ্যবতী। সবাই পছন্দ করে যাচ্ছে।” এরপর সবার দিকে চেয়ে বললি,  “এই শোন তোরা এখন একটা কাজ কর, পৌলমীর জন্য স্বয়ম্বর সভার আয়োজন কর। ওর পায়ের স্যান্ডেল যার কাছে গিয়ে খুলে যাবে, তার গলাতেই মালা পড়াবে।”  এ কথা শুনে সবাই হেসে গড়াগড়ি। তোর এমন বিদ্রূপাত্মক কথাতে কেউই তোকে ভুল বোঝেনি। তখনও তোর বিয়ের কোনো খবরই হয়নি। কলেজের গ্রীষ্মের ছুটিতে বেড়াতে গেলি, তাই তোর ফিরে আসার অপেক্ষায় রইলাম আমরা সবাই। তোকে ছাড়া গেট টুগেদার, এ যে কেউ ভাবতেই পারেনা। পনেরো দিন থেকে এলি, তোর চোখের নীচে কেমন জানি একটা স্যাঁতস্যাঁতে ছায়া পেলাম। বললি, “আমায় দেখতে কি সার্কাসের জোকার লাগছে, ওভাবে চেয়ে আছিস কেন? গেট টুগেদারটা কবে করবি? তারিখ ঠিক করেছিস?” বললাম তোর আসার অপেক্ষা করছিলাম আমরা সবাই। যাক তারিখ ঠিক হলো, তোকে ফোন দিয়ে জানাতেই উল্টে বললি, “নিজেকে উৎসর্গ করার তারিখ পড়ে গেলো রে।”  আমি বুঝিনি। আবার বললি, “ওরে গাধী আমার বিয়ে ওইদিন। তাই তারিখ বদল কর।” কিন্তু আমাদের সেই গেট টুগেদার আর হলোনা। তোর গায়ে হলুদে অনুষ্ঠানটা করলাম আমরা বন্ধুরা। ওই প্রথম তোকে এতো শান্ত দেখেছি। ভালো লাগছিলো না। এখন তো সব বিয়ের অনুষ্ঠানেই বর-কনে নাচে। আমাদের সময়ে এসব কই ছিলো? তারপরে সব অতিথি চলে যাবার পর তোকে টেনে এনেছিলাম। হাসি ছিলো, উচ্ছ্বলতা ছিলোনা। সবাই চলে গেলো, আমি থেকে গেলাম। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিয়ে বাড়ীর আলোকসজ্জ্বা দেখে বললি, “সব মেয়েদের বুঝি এমন স্বপ্ন থাকে?” আমি বললাম, ও মা এটা কি কথা! থাকবেনা কেন? আমারও আছে। তুই বললি, “আমাদের পৌলমী তো লক্ষ্মী মেয়ে। আমার মতো পাজির পা-ঝাঁড়া না!” তারপর হো হো করে হাসি। বিয়েবাড়ীর আত্মীয়-স্বজনেরা চোখ ট্যাঁটাচ্ছে এ কেমন মেয়ে রে লজ্জ্বা-শরম নেই! আর সেদিন প্রথম অনুভব করলাম তোর অসহায়তা। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল তোকে কতোটা দূর্বল করে সেটা আমরা সব বন্ধুরাই জানি। জানতে চাইলাম, কষ্ট সাজাস না মনের ভেতর। তোর স্পেশ্যাল হাসি ওই যে ঘাড় আলতো করে ঘুরিয়ে আড়চোখে চেয়ে নাকটা উচিয়ে হাসি দেয়ার চেষ্টা করলি। জিজ্ঞাসা করলি, “পৌলমী আচ্ছা যদি আমি এখন কাঁদি সামলে নিতে পারবি আমায়?” একেবারে কাঠ হয়ে গেলাম কথাটা শুনে। সঙ্গে সঙ্গে তুই জড়িয়ে নিয়ে বললি, “ওরে বোকা আমি কবে কাঁদবো জানিস? যেদিন তোর বিয়ে হবে। এমনিতেই ভয়ে আছি বরের সাথে যাবার সময় কান্না যদি না আসে, পৃথিবীর সবাই তো নির্লজ্জ্ব বেহায়া মেয়ে বলবে।” তোর্ষা তোকে কেউ নির্লজ্জ্ব বেহায়া বলেনি রে। বরং সবাই কেঁদেছিলো তোর সেদিনের কান্নায় এই কাঁদুনে আমি ছাড়া।

এরপর অবশ্য চাকরীর জন্যেই আবার ফিরে এলি, যতোদিন না তোর বরের শহরে চাকরী হয়। ঠিকই চলছিলো, সেই হাসি-আনন্দ-গল্প-আড্ডা। হঠাৎ এসে বললি, “পি.এইচ.ডি করার সুযোগ পেলাম।” আচ্ছা তোর্ষা বল তো উচ্চশিক্ষা কি না নিলে খুব ক্ষতি হয়ে যেতো তোর? ওভাবে কলেজের চাকরীটা ছেড়ে দিলি, প্রিন্সিপালেরও সুবিধা হলো আর কেউ প্রতিবাদ করার মতো নেই। তোর ছাত্র-ছাত্রীরা এসে আমায় বললো তোকে কি ফিরিয়ে আনা যায়না? কি করে বোঝাবো আমি সেই মুহূর্তে সবচেয়ে অসহায় ছিলাম? কিন্তু পি.এইচ.ডি শেষ হলোনা, হলো দুটি সন্তান। তোর ওই সময়টা আমার সেভাবে দেখা না হলেও, মাঝে-মধ্যে যে আসতি তখন বুঝতাম সন্তানের জন্য এখন তোর সমস্ত জীবন, আর কিছু না। অন্য যা কিছু সে সবই অসহ্যতম সময়। হাঁপিয়ে যাসনি তবুও,হাসিটুকু থেকেই গিয়েছিলো। যশোর থেকে ঢাকায় এলেই দেখা হতো। আমি সুখে না থাকলেও অসুখী ছিলাম না, একটা স্বস্তি ছিলো জীবনে। তুই বলতি, “কিরে ফ্যাঁচু কান্দুনী মনে হয় বরের অনেক আদর পাচ্ছিস?” আমার যে কি লজ্জ্বা লাগতো। বয়স যতোই হোক লজ্জ্বা বোধ হয় বয়সের মতোই বেড়ে চলে। আসলেই নির্ঝর আমায় কখনো সেই অভিভাবক স্বামীত্ত্ব দেখায়নি। একটা বন্ধু পেয়েছিলাম ওর মধ্যে। নির্ঝরের আবেগটুকু আমায় কখনো ক্লান্ত করেনি কিংবা বিরক্তি আনেনি। তুই সেটা ঠিকই বুঝেছিলি। তারপর হাসিটুকু নিভিয়ে জানতে চাইলাম তোর কেমন চলছে? সেই একই হাসি “আরে আমায় খারাপ রাখে কোন ছাগলে?” শুধু চোখের ঝলকানিটা দেখতাম না।

একদিন হঠাৎ পুলকের সাথে দেখা পথে, মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছি তোর কথা বললো। তুই নাকি দেশের বাইরে চলে গেছিস নিউজিল্যান্ডে। অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। একটিবারও জানিয়ে যেতে পারলোনা? অভিমান এমনভাবে জমলো, পুলক পরে বললো আমায়, তুই নাকি যেতে চাসনি। তারপর ভাবলাম একদিকে ভালোই হলো তোর চেঞ্জের দরকার ছিলো, হয়তো এখন সব ঠিক হতে পারে। একদিন লুকিয়ে ফোন দিলি, বুঝিনি চুরী করে যে দিচ্ছিস, যদি না তোর বর এসে জিজ্ঞাসা না করতো, “কাকে ফোন দিয়ে ফালতু টাকা নষ্ট করছো?”  আমি ফোনটা রেখে দিলাম, ভয়ে রে। তুই যদি কেঁদে ফেলিস! তারপর আরোও একদিন ফোন দিলি, বুঝলাম এও চুরী। বললাম আমি দিচ্ছি। তুই মানা করলি আর বললি,  “কেউ যদি জোর করে কর্তৃত্ত্ব ফলায় অন্যায়ভাবে, আর সত্যি নিতে না পারে, তারটা চুরী করাই উচিৎ। তাকেই গোপন আর মিথ্যে দিস যে সত্যি নিতে  জানেনা।” অবাক হয়ে গেলাম তার মানে তুই মিথ্যে বলিস! গোপন করিস!! ওপাশ থেকে সেই হাসির ঝলক। কি পেলি তুই জীবনে? কেন তোর সাথে এমন জীবন? হাসির দমক আর থামেই না। হঠাৎ করে বললি, “পরে আবার ফোন দেবো, ছাড়ছি।”

পাহাড়ী নদীর বুকে পাথরের রাজত্ত্ব...
পাহাড়ী নদীর বুকে পাথরের রাজত্ত্ব…

এক জীবনে কেইবা আর
কতোটুকুই পায়
বে-হিসেবী ক্ষতির কাছে
লাভটুকুই হারায়।
সেসব নিয়ে তারাই ভাবে
বন্ধু যাদের নেই
কিন্তু আমি তোরই আছি
আমার যে তুই সেই।

চলবে—

হ্যামিল্টন, কানাডা
১৭ মে, ২০১৫ ইং।

 তোর্ষা আমার বন্ধু, নদী এবং জল…একটি চিঠি : প্রথমাংশ

৫১৯জন ৫১৯জন
0 Shares

৩১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ