ছুটি বা অবসর সময় পেলেই ছুটে যাই বনে। রাজধানী ঢাকার খুব দূরে নয়। ফলে হবিগঞ্জ জেলার সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান আমার খুব প্রিয় একটি জায়গা। হবিগঞ্জের রাতের বাস ধরে খুব ভোরে পৌঁছানো যায় সেখানে। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে রওনা হলাম সাতছড়ির উদ্দেশ্যে। খুব ভোরে নেমে পড়লাম জগদীশপুর মোড়ে। ভোরের আলো ফোটার পর একটি সিএনজি নিয়ে রওনা হলাম সাতছড়ির দিকে। ভোর সাড়ে ছ’টার দিকে বনের প্রবেশ মুখে নামতে হলো। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে রওনা দিলাম বনের ভিতর ওয়াচ টাওয়ারের উদ্দেশ্যে।
১০০ ফুট উঁচু টাওয়ারে ওঠার পর শুরু হলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। বৃষ্টির পানিতে সবুজের সজীবতা বেড়ে গেছে। গাছের সবুজ পাতাগুলি যেন তাদের যৌবন ফিরে পেলো। এ এক নয়নাভিরাম দৃশ্য! কোনো অবস্থাতেই চোখ বন্ধ করতে পারছিলাম না। সবুজের রূপে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম প্রকৃতির মাঝে। আধা ঘণ্টা পর বৃষ্টি থামলো। বৃষ্টি থামার সঙ্গে সঙ্গে বনের হরেক প্রজাতির পাখির কিচির-মিচির শব্দে মুখরিত হয়ে উঠলে পুরো বন। ডালে বসে ভিজে যাওয়া পাখিরা তাদের ঠোঁট দিয়ে চিরুনীর মত আঁচড়ে পালকগুলো রোদে শুকিয়ে নিচ্ছে। প্রকৃতির অলঙ্কার বনের পাখির এই অপরূপ দৃশ্য নিজ চোখে অবলোকন করার শান্তি যেন ভিন্নতর। এদের কার্যকলাপ দেখার সময় চোখের সামনে গাছে এসে বসলো একটি সবুজ রঙের পাখি। যে পাখিটি আগে কখনো দেখিনি। নাম ‘পাতা বুলবুলি’।
এরা Chloropsis পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ১৮- ২০ সে.মি. দৈর্ঘ্যরে ২৮ থেকে ৩০ গ্রাম ওজনের ছোট আকারের একটি বৃক্ষচারী পাখি। ৭টি উপপ্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে Chloropsis aurifrons প্রজাতির পাখিটি পাওয়া যায়। পূর্ণবয়স্ক ‘পাতা বুলবুলির’ দেহের উপরি ভাগ ও নিচের অংশ সবুজ। মুখ ও গলা থেকে থুতনি পর্যন্ত কালো বর্ণের। গলার উপরি অংশ বেগুনী-নীল। ঘাড়ের পাশ ও বুকের উপরি অংশে কালো রঙের, বাইরে হলদে-সোনালী রঙের একটা বেড় আছে। কপাল সোনালী-কমলা বর্ণের। এদের কাঁধে উজ্জ্বল নীল বর্ণের পট্টি দেখা যায়। ঠোঁট বাঁকানো ও কালো। চোখ কালো-বাদামী। সবকিছু মিলিয়ে পাখিটিকে অপরূপ সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। খালি চোখে দেখলে মনে হবে এ যেন চিত্রশিল্পীর তুলির আঁচড়ে রঙ করা একটি ছবি।
পাতা বুলবুলি পাতাঝরা বন, বৃক্ষবহুল বাগান অপ্রধান বন ও চিরসবুজ বনে বিচরণ করে। সচরাচর জোড়ায় জোড়ায় এক বৃক্ষ থেকে অন্য বৃক্ষের ডালে বসে। মাঝে মাঝে ছোট দলেও থাকে। এরা লোকালয়ে খুব একটা আসে না। গাছের ঘন পাতায় ও উচুঁ ঝোপ-ঝাড়ে এরা খাবার খুঁজে বেড়ায়। এদের খাদ্য তালিকায় পোকা-মাকড়, ফুলের রস বা মধু, রসালো ফল ও পাকড় ফল রয়েছে। নিজেরাই নিজেদের খাবার খুঁজে খায়। অন্য কারো খাবারে হানা দেয় না। মোটামুটি শান্ত স্বভাবের পাখি। এরা সিংহরাজের মত অন্য পাখির ডাক অনুকরণ করতে পারে।
জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত এদের প্রজনন সময়। প্রজননের সময় বনের ভিতরে ছোট গাছ বা ডালে ঘাস, পাতা ও মাকড়সার জাল দিয়ে বাটির মতো করে নিজেরাই বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়ে পাখিটি ২-৩টি ডিম পাড়ে। পুরুষ ও মেয়েপাখি উভয়েই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। বাচ্চাদের লালন-পালন বা যত্নাদি দুজনে মিলে করে থাকে। এরা বাংলাদেশে বিপদমুক্ত আবাসিক পাখি। সব বনে বা চিরসবুজ বনে পাওয়া যায়। সিলেট, রাঙামাটি, কাপ্তাই, চট্টগ্রামের বন ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, মিয়ানমার ও ভিয়েতনামসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এদের বিচরণ রয়েছে।
বাংলা নাম: পাতা বুলবুলি
ইংরেজি নাম: Golden-fronted Leafbird
বৈজ্ঞানিক নাম: Chloropsis aurifrons
ছবিগুলো সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান থেকে তোলা।
১৫টি মন্তব্য
নাজমুল হুদা
আপনার লেখা প্রকৃতি প্রেম জাগিয়ে তুলে । লেখার মাঝে প্রকৃতিকে অনুভব করা যায়।
সুস্থ থাকবেন ভাইয়া 😍
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ নাজমুল ভাই। সময় নিয়ে আগ্রহ করে আমার লেখা পড়ার জন্য। আপনারাই আমার উৎসাহের যোগান দাতা।
মাসুদ চয়ন
প্রকৃতি বিলাস_মুক্ত জীবন।আপনার লেখার মূল উপজীব্য।ভালো লাগে।ডুবে থাকা যায়।
শামীম চৌধুরী
কৃতার্থ সুহৃদ।
শিরিন হক
অসাধান ভাবে লিখেন আপনি। পাঠক মুগ্ধ।
তৌহিদ
পাতা বুলবুলিকে ছোটবেলায় আমি ভাবতাম টিয়া পাখি। সবুজ বলে এমন মনে করতাম। অনেকদিন দেখিনি এই পাখি। গল্পের মধ্যদিয়ে পাখির বর্ণনার সাথে সুন্দর একটি পাখি পাতা বুলবুলি নিয়ে লিখলেন, সত্যিই মুগ্ধ হলাম ভাই।
শুভকামনা রইলো।
শামীম চৌধুরী
এই ভুলটা তৌহিদ অনেকেই করে। একবার আমার সাথে সাতছড়ির সবুজবনে চলো। নিজ চোখে দেখে আসবে।
শামীম চৌধুরী
অনেক ধন্যবাদ আপু উৎসাহ দেবার জন্য।
ছাইরাছ হেলাল
এ পাখির সাথে ফুলের কালার কম্বিনেশন মারাত্মক লাগে।
মুগ্ধতা।
শামীম চৌধুরী
জ্বী হেলাল ভাই। অনেকটা লাল সবুজের বাংলাদেশ।
মনির হোসেন মমি
বরাবরের মত চমৎকার লেখা ও ছবি।চলুক।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ মমি ভাই। চলছে অবিরাম।
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ অয়েলডান।
শাহরিন
অনেক সুন্দর পাখি। এসব নিয়ে ভাবিনি বা জানতে চাইনি কখনো কিন্তু আপনার লেখা পড়তে ভালো লাগে।
আরজু মুক্তা
পাখি, ফুল, ফল অনন্য দান প্রকৃতির। আপনার লিখার মাধ্যমে আরও অনেক কিছু জানতে পারছি।