মায়ের মুখ...
মায়ের মুখ…

আনন্দ-উৎসবের জন্যে প্রতিটি মানুষ অপেক্ষায় থাকে। একেকটি উৎসব আমাদের জীবনে ভোরের শিশিরের মতো দ্যুতি ছড়ায়। ফুরিয়ে গেলেও রেখে যায় তার রেশ। যেমন আশ্বিন আসার আগে থেকেই পুজো পুজো গন্ধ বাতাসে। তারপর ঢাক-ঢোল বাজনার সাথে, শঙ্খ এবং উলুধ্বনি দিয়ে মা দূর্গাকে বরণ করে নেয়া হয়। এক এক করে ষষ্ঠী-সপ্তমী-অষ্টমী-নবমী এবং সবশেষে দশমী। অবশেষে ছুটি শেষ। আবার পরেরদিন থেকেই একই রকম জীবন-যাত্রা। পুজোর আনন্দ বিজয়া দশমীর মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যায়। যে অপেক্ষা থাকে পুজোর, আর তো মাত্র কয়েকটা দিন, ওই তো মা আসছে। সেই অপেক্ষার পালা শুরু হয় নতূন করে পরের বছরের জন্য। চাকরী পাবার পর দ্বিতীয় দূর্গাপুজো আমার। গতমাসেই ছুটির এপ্লাই করেছিলাম। সেই ছুটির আনন্দ উপভোগ করলাম টরেন্টোতে। আর আজ সেই গল্পই বলতে এসেছি।

২০ অক্টোবর তারিখে সকাল সাড়ে সাতটার বাস ধরে গেলাম জ্যাকসন স্কয়ারের টিম হর্টনে আমি আর তীর্থ। ওখানে ঊর্মী আর ওর মেয়ে কাঁকন এলো। ঊর্মী আর আমি কফি-পিনাট বাটার কুকি খেলাম। তীর্থ-কাঁকন ওদের জন্য আলাদা খাবার নিলো। অবশেষে হ্যামিল্টন গো স্টেশন থেকে বাসে করে অলডারশট গো ট্রেন ষ্টেশনে, তারপর ট্রেনে টরেন্টো।সঞ্জয়দা(ঊর্মীর বর) অপেক্ষায় ছিলেন আমাদের। ওহ বলে নেই দাদা আমার বান্ধবীর বর শুধু না, আমার ভাইও। তাই ছোট বোন হিসেবে স্নেহ পাই উনার। গিয়ে পৌঁছে রেডি হলাম মন্দিরে যাবার জন্যে। শুধু অষ্টমীর অঞ্জলি নেবার জন্যেই অনেক ভোরে উঠে রওয়ানা হতে হয়েছিলো টরেন্টোর পথে। যাক অবশেষে বাংলাদেশ-কানাডা হিন্দু কালচারাল সোসাইটির পুজোতে গেলাম। ওখানে অঞ্জলী নেবার পর বেশ খাওয়া-দাওয়া হলো। আর অবশ্যই ফটোশেসন। এবারকার ছবিগুলো এতো দারুণ তুলেছে তীর্থ। সকলেই বললো ও নাকি ভালো ফটোগ্রাফার হবে। আসলে আমি তো জানি ওর ছবি তোলায় কোনো শখই নেই। তবে ও আজকাল নিজের সেলফি তোলে :p । ঘটনা কি সেটা বুঝতে পারছিনা ;?।

যাক অনেকের সাথে দেখা-গল্প-কথা। তবে আমি আবার সবার সাথে সেভাবে কথা বলতে পারিনা। যাদেরকে চিনি তাদের সাথেও ওই হাই-হ্যালো ছাড়া আর বেশীদূর চলেনা। টরেন্টোর পুজোর একটা অদ্ভূত মিল খুঁজে পাই দেশের সাথে। ঢাক-ঢোল বাজে, আরতি হয়। আর অনেক জায়গাতেই পুজো দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। জাপানে একদিন পুজো আর তাও হল ভাড়া করে। একদিনেই সব আনন্দ উপচে পড়তো আর তার রঙ ছড়াতে না ছড়াতেই শেষ। বেলজিয়ামে মন্দিরে পুজো হলেও তেমন আপন লাগেনি আমার। কেমন জানি কৃত্রিম। টরেন্টোতে কাউকেই সেভাবে চিনিনা, কিন্তু ভালো লাগে। এখানে মন্দিরটা অনেক পরিচ্ছন্ন এবং অনেক ভীড় হলেও ধাক্কাধাক্কি নেই। তাছাড়া খুবই সুশৃঙ্খলভাবে অঞ্জলী নেয় এমনকি খাবার লাইনেও একই। মন্দিরের পাশের রুমেই শাড়ী-জামা-কাপড়-জুয়েলারির মেলা বসে। যে যেমন পারে কেনে। আমি কানে পড়ার জন্যে খুবই ছোট্ট একটা ঝুমকা কিনেছি(এবং অবশ্যই গোল্ড নয়, বড়ো অপছন্দের জিনিস গোল্ড)। বান্ধবী ঊর্মীকেও দিলাম কিনে। আমাদের মধ্যে একটা দারুণ ব্যাপার কাজ করে। যেমন ও বলবে, “কিনে দে ওটা।” আমি বলবো, “তোর শ্বশুর কি টাকা দিয়ে গেছে আমায়?” বলে দিতে হবে তোকে। আমাদের কথা কোনো অপরিচিত জন যদি শোনে তাহলে কনফার্ম ভুল বুঝবে। আর যারা পরিচিত তারা জানে ঊর্মী আর নীলা মানিকজোড় নাকি রত্নাজোড়(মানিক আর রত্না :p )?

তবে তীর্থটার জন্যে খারাপ লাগছিলো, কেউ নেই ওর সঙ্গী। একা একা ঝিম মেরে বসে শুধু গান শোনে ওর আইপডে। ওই বয়সটা কাটিয়ে এসেছি আমি, তাই বুঝি। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। কোথায় রেখে আসবো? তরুণ নিউ ফাউন্ডল্যান্ডে চাকরী পেয়ে ওখানে চলে গেছে। আর বাবার সাথে ছেলের ভাব বেশী। যাক মন্দিরে বেশী সময় থাকা হয়নি। আসলে এতো ক্লান্ত ছিলাম। সঞ্জয়দার বাসায় ফিরে রেষ্ট নিলাম। তবে সবাই ঘুমুলো। আমি দুপুরে কিছুতেই ঘুমোতে পারিনা। সেলফোনে সোনেলায় কিছুক্ষণ, ফেসবুকে। বিরক্তি এসে গেলো কেউ কোথায় নেই। একটু পর পর ডাকছি ও ঊর্মী ক্ষিদে পেয়েছে। ঘুমের চোখে বলছে “ডিম ভেঁজে খেয়ে নে।” আসলে খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে অল্প খাবার নিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম প্রতিবার নষ্ট করি এবার কমই নেবো। যাক কিসের কি, ও উঠলো সেই সন্ধ্যা ছয়টায়। উঠতেই বললাম তুই কিন্তু আমার বৌদি, ননদের সেবা করা তোর কর্তব্য। বলে, “প্রণাম কর বড়ো ভাইয়ের বৌ।” বললাম লাত্থি খাবি কিছু খাওয়া। ডিম ভাঁজলো, পরোটা। এরই মধ্যে সঞ্জয়দা চলে এলেন কাজ থেকে সাথে আলুর চপ, পেঁয়াজু, চিকেন ফ্রাই আহ! এত্তো খাবার! পেট ভরা নড়তে পারছিনা। তবু রেডি হতে হবে রাতের অনুষ্ঠান দেখতে হবে যে।

জীবনে অনেক মোহনীয় সন্ধ্যা পার করেছি। সেদিনকার অষ্টমীর সন্ধ্যেটা ছিলো অতুলনীয়। স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনার পর শুরু হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতিনৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা। পরিবেশনায় ছিল ইত্তেলা-মিঠুন ক্রিয়েটিভ ল্যাব আর পরিচালনা করেছেন উমামা নওরোজ ইত্তেলা। অসাধারণ ছিলো পরিবেশনা। চিত্রাঙ্গদার ভূমিকায় বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী অরুণা হায়দার এবং অর্জুনের ভূমিকায় মিঠুন রেজা। প্রবাসের মাটিতে এমন একটি পরিবেশনা অনেক ব্যস্ততার মধ্যে সময় বের করে করা সত্যি কঠিন। কোরিওগ্রাফি এককথায় দারুণ, পোষাক নির্বাচন এক কথায় সবকিছু মিলিয়ে অনবদ্য পরিবেশনা ছিলো। মন ভরা আনন্দ নিয়ে রাতে সঞ্জয়দার বাসায় ফিরে এলাম। দীর্ঘসময় চললো আড্ডা-গান-হাসি। সে গল্প পরের অংশে হবে, কেমন?

নদীর পাড় ভাঙ্গছে সারাটি রাত্রিভর—
ঘুমের নিঃশ্বাস এতো যন্ত্রণার হতে পারে বুঝি?
ফিরে যাবার তাড়া, চোখের পাতা ছুটে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে
যেখানে একেকটি অক্ষর হাসায়-কাঁদায়।
এ কি!
অন্ধকারে লেপের ভেতর হো হো করে হেসে ওঠে পুরোনো অভিশাপ—
অপেক্ষা, অপেক্ষার ভেতরেই শুয়ে থাকে
ওদিকে জেগে ওঠে নতূন ভোর।

(টরেন্টো, কানাডা//২১ অক্টোবর, ২০১৫ ইং। ভোর রাত ৪টার সময় লেখা)

** দাদার আব্দারকে যত্ন করে ঠাঁই দিয়েছিলাম মনে, তাই লেখা সম্ভব হলো।
কিছু ছবির কৃতিত্ত্ব নভোনীল তীর্থের, আর কয়েকটি এখানকারই রিঙ্কু বৌদি, ঊর্মী, লিমা বৌদি, সুমা, ঝুমুদির তোলা।

২৫ অক্টোবর, ২০১৫ ইং
হ্যামিল্টন, কানাডা।

মন্দিরের গেট...
মন্দিরের গেট…
অষ্টমীর অঞ্জলী...
অষ্টমীর অঞ্জলী…
ফটোগ্রাফারের ফটোশেসন - তিন
ফটোগ্রাফারের ফটোশেসন – এক
ফটোশেসন - দুই
ফটোশেসন(তীর্থ-ঊর্মী-কাঁকন) – দুই

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

ফটোশেসন (সঞ্জয়দা-ঊর্মী)
ফটোশেসন (সঞ্জয়দা-ঊর্মী) – চার 
ফটোশেসন - পাঁচ
ফটোশেসন – তিন
অষ্টমীর রাতের ফটোশেসন - এক
অষ্টমীর রাতের ফটোশেসন – পাঁচ

 

 

 

 

 

 

 

 

শাড়ীর মেলায় ফটোসেশন - ছয়
শাড়ীর মেলায় ফটোসেশন – ছয়
চিত্রাঙ্গদা(অরুণা হায়দার) অর্জুন (মিঠুন রেজা)
চিত্রাঙ্গদা(অরুণা হায়দার)
অর্জুন (মিঠুন রেজা)
চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের পোষ্টার...
চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের পোষ্টার…  
৪৪১জন ৪৪১জন
0 Shares

৫৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ