জীবনানন্দীয় ধ্বনির শ্রুতিকল্প গঠনের কৌশল নিয়ে কথা বলেছি। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়-কৌশল আগে, না ভাবনা আগে। ভাবনা, মানে কবিতায় হাত দেবার আগে জগৎ, জীবন, ব্যক্তি, সমাজ, ইতিহাস এসব সম্পর্কে ধারণা। আর এ দুয়ের, মানে বোধ ও কৌশলের পারস্পরিক আদান-প্রদান ও নির্ভরতার সূত্র কী? সব কবির বেলায় সেই সূত্র কি একই? নাকি কবি নির্বিশেষে সেই তত্ত্ব পাল্টায়? এসব আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। তবে টেকনিকের সঙ্গে বোধের পারস্পরিক রসায়নে বোধই নিরূপক: মুখ্য ও মৌলিক। কল্পনা-প্রতিভাই নিয়ন্ত্রণ করে কবিতার রূপ। ‘স্মরণীয় বাণী’ নয়, বিশ্ব-রহস্য সম্বন্ধে নতুন ‘দায়িত্বর্পূণ মহদুক্তি’ করবার মতো প্রতিভায় তিলে তিলে জন্মায় কবিতার আত্মা; কবিতার আত্মা জড়িয়ে ওঠে এবং জড়িয়ে থাকে কবিতার রূপ; জড়িয়ে থেকেই বিচ্ছুরিত করে কবিতার আত্মা ও রূপের ঐশ্বর্য্য। তাই অর্ন্তদীপ্ত হয়ে উঠে আমরা অনুভব করি কবি জীবনানন্দ দাশের জগৎ, জীবন ও কালকে বুঝে ওঠার প্রতিভা, অবলোকন ও অবগাহন থেকে পরিস্রুত সারাৎসার পরিগ্রহণের প্রতিভা। এবং এই অর্ন্তদৃষ্টির আলোকেই তাঁর পৃথিবী তাঁর পূর্বজনদের পৃথিবীর থেকে পৃথক এবং তাঁর সহচরদের থেকে তিনি কতো বেশি প্রভাস্বর।
দুর্ঘটনায় আহত জীবনানন্দ যখন হাসপাতালে, জীবনাবসানের দুদিন আগে খুব ভোরে জেগে গিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন:
“এখন ক’টা বাজে?”
‘ভোর পাঁচটা।’
‘লিখে রাখ আজকের তারিখটি, আজ থেকে গত এক-বৎসর খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। এখন ভোর না সন্ধ্যে? আমি কি দেখতে পাচ্ছি জান? বনলতা সেন-এর পাণ্ডুলিপির রঙ।’
জীবনানন্দ কি সেই পাণ্ডুলিপির সঙ্গে সঙ্গে শুনেছিলেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে, থেমে, চলে, বেঁকে উপল এড়িয়ে তাঁর কবিতার অন্তঃসার স্রোতের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি?
তথ্যপঞ্জি:
১. শঙ্খ ঘোষ, নির্মাণ ও সৃষ্টি, বিশ্বভারতী, ২২ শে শ্রাবণ, ১৩৮৯ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা: ২.২:
‘জলের উচ্ছ্বাসে পিছে ধূ-ধূ জল তোমারে যে ডাকে’ বা নক্ষত্রের মতন হৃদয়/পড়িতেছে ঝরে’র মত কথার স্বাদ যে জানবে সকলে, জীবনানন্দ তা জানেন, কেননা ‘জান নাকো তুমি তার স্বাদ,/তোমারে নিতেছে ডেকে জীবন অবাধ,/জীবন অগাধ।’ কিন্তু রবীন্দ্রনাথও কি জানবেন না? ‘যে নক্ষত্র মরে যায়, তাহার বুকের শীত/লাগিতেছে আমার শরীরে’, জীবনানন্দের এই ছবি ও গান কি রবীন্দ্রনাথের থেকে এতই দূরের? তারকার আত্মহত্যা’র মতো কবিতায় যেখানে ‘শত মৃত তারকার মৃতদেহ রয়েছে শয়ান’, সেখান থেকেই কি একদিন শুরু হয়নি এই কবিরও চলা?’
ধ্বনিগতভাবে সন্ধ্যাসঙ্গীত থেকে জীবনানন্দীয় সুর কতোটা আলাদা, কেনো আলাদা, কীভাবে আলাদা-সে কথা বলেছি, লক্ষ করার বিষয়, নির্মাণ ও সৃষ্টির ২০২ পাতা ছাড়া অন্য কোথাও শঙ্খ ঘোষের এই ভাবনার পুনরুক্তি শুনিনি; ছন্দের বারান্দা’ বইতেও না। বুদ্ধদেবের পরে শঙ্খ ঘোষের ‘শত জলঝরনার ধ্বনি’ ছন্দের বারান্দা প্রবন্ধটি জীবনানন্দের ছন্দ-ধ্বনি বিষয়ে প্রবলভাবে গূঢ় এবং অর্ন্তভেদী রচনা।
২. জীবনানন্দের ধ্বনি-চারিত্র্য বিষয়ে মৌলিক আলোচনা করেছেন:
২.ক. বুদ্ধদেব বসু, প্রকৃতির কবি, কবিতা, চৈত্র ১৩৪৩ বঙ্গাব্দ।
২.খ. শঙ্খ ঘোষ, শত জলঝরনার ধ্বনি, ছন্দের বারান্দা, অরুণা প্রকাশনী, ষষ্ঠ মৃদ্রণ, ১৩৯৮ বঙ্গাব্দ।
২.গ. দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, ছন্দ-গদ্যছন্দ, জীবনানন্দ বিকাশ-প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, দ্বিতীয় সংস্করণ, ভারত বুক এজেন্সি, ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ।
২.ঘ. দেবেশ রায়, গন্ধের কথাও তুলিনি, বিভাব, জীবনানন্দ জন্মশতবর্ষ সংখ্যা, ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ।
৩. Charles Baudelaire, The Flowers of Evil, A Selection edited by Marthid and Jackson Mathews, New Directions. 10th Printing.
৪. Ed. Bradford Cook, Mallarme:Selected Prose, Essays and Letters, The Johns Hopkins University Press, 1956
আগের পর্বগুলোর লিংক:
জীবনানন্দের শ্রুতিকল্প : একটি বিশ্লেষণ (১) http://sonelablog.com/archives/23872
জীবনানন্দের শ্রুতিকল্প : একটি বিশ্লেষণ (২) http://sonelablog.com/archives/23989
জীবনানন্দের শ্রুতিকল্প : একটি বিশ্লেষণ (৩) http://sonelablog.com/archives/24057
জীবনানন্দের শ্রুতিকল্প : একটি বিশ্লেষণ (৪) http://sonelablog.com/archives/24143
জীবনানন্দের শ্রুতিকল্প : একটি বিশ্লেষণ (৫) http://sonelablog.com/archives/24290
জীবনানন্দের শ্রুতিকল্প : একটি বিশ্লেষণ (৬) http://sonelablog.com/archives/24372
জীবনানন্দের শ্রুতিকল্প : একটি বিশ্লেষণ (৭) http://sonelablog.com/archives/24510
৮টি মন্তব্য
মামুন
অনেক ধন্যবাদ।
সুন্দর একটি তথ্যসমৃদ্ধ নান্দনিক সিরিজ সফল ভাবে শেষ করার জন্য অভিনন্দন রইলো। -{@
সাতকাহন
ধন্যবাদ মামুন।
লীলাবতী
প্রথম পর্ব থেকে আর একবার পড়া আরম্ব করতে হবে। (y)
সাতকাহন
ধন্যবাদ, লীলাবতী।
স্বপ্ন নীলা
আগের পর্বগুলোর লিংক দিয়ে ভাল হয়েছে —– শুভকামনা রইল
সাতকাহন
ধন্যবাদ, স্বপ্ন নীলা।
জিসান শা ইকরাম
এত দ্রুত শেষ হয়ে যাবে ভাবিনি।
কবিতার এমন বিশ্লেষন এই প্রথম পড়লাম।
যে কোন কবিতাই এখন হতে এমন ভাবে দেখার চেষ্টা করবো।
ধন্যবাদ আপনাকে।
সাতকাহন
অসংখ্য ধন্যবাদ জিসান ভাই।