২.২ ক্রিয়াপদ ও বেগ
ভাবনাকে বেগ দেবার জন্য, বেগকে সংবেদনতর করবার জন্য ক্রিয়াপদের পুনরাবৃত্তির ধ্বনিকে ব্যবহার করেছেন জীবনানন্দ অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে। দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক:
জলপাইয়ের পল্লবে ঘুম ভেঙে গেল ব’লে কোন ঘুঘু তার,
কোমল নীলাভ ভাঙা ঘুমের আস্বাদ তোমাকে জানাতে আসবে না।
হলুদ পেঁপের পাতাকে একটা আচমকা পাখি ব’লে ভুল হবে না তোমার,
সৃষ্টিকে গহন কুয়াশা ব’লে বুঝতে পেরে চোখ নিবিড় হ’য়ে
উঠবে না তোমার!
প্যাঁচা তার ধূসর পাখা আমলকীর ডালে ঘষবে না এখানে,
আমলকীর শাখা থেকে নীল শিশির ঝ’রে পড়বে না,
তার সুর নক্ষত্রের লঘু জোনাকির মত খসিয়ে আনবে না এখানে,
রাত্রিকে নীলাভতম ক’রে তুলবে না!
সবুজ ঘাসের ভিতর অসংখ্য দেয়ালি পোকা ম’রে রয়েছে
দেখতে পাবে না তুমি এখানে,
পৃথিবীকে মৃত সবুজ সুন্দর কোমল একটি দেয়ালি পোকার মত
মনে হবে না;
প্যাঁচার সুর নক্ষত্রকে লঘু জোনাকির মত খসিয়ে আনবে এখানে,
শিশিরের সুর নক্ষত্রকে লঘু জোনাকির মত খসিয়ে আনবে না,
সৃষ্টিকে গহন কুয়াশা ব’লে বুঝতে পেরে চোখ
নিবিড় হ’য়ে উঠবে না তোমার।
[ফুটপাথে (মহাপৃথিবী)]
নদীর তীক্ষ্ণ শীতল ঢেউয়ে সে নামল-
ঘুমহীন ক্লান্ত বিহ্বল শরীরটাকে স্রোতের রাতের মত একটা আবেগ দেওয়ার জন্য
অন্ধকারের হিম কুঞ্চিত জরায়ু ছিঁড়ে ভোরের রৌদ্রের মত
একটা বিস্তীর্ণ উল্লাস পাবার জন্য;
এই নীল আকাশের নিচে সূর্যের সোনার বর্শার মত জেগে উঠে
সাহসে সাধে সৌন্দর্যে হরিণীর পর হরিণীকে চমক লাগিয়ে দেবার জন্য।
[শিকার (বনলতা সেন)]
গদ্য কবিতা তারই মধ্যে কোথাও কোথাও লুকোনো লয়, হয়তো স্পন্দন। বিশেষ্য-ক্রিয়াপদের পুনরুক্তি অথবা অসমাপিকা ক্রিয়ার পুনরুক্তি বিরল স্থিতি সমন্বিত গতিকে প্রবহমান করে রেখেছে। ধ্বনির প্রবাহ ‘অন্ধকারের হিম কুঞ্চিত জরায়ু ছিঁড়ে ভোরের রৌদ্রের মত বিস্তীর্ণ উল্লাস পাবার জন্য’-এর মতো পঙ্ক্তিতে সূক্ষ্ম যুগ্মশব্দের বিন্যাসে জলের ঘূর্ণির মতো ঘুরপাকে চলিষ্ণু হয়ে উঠেছে।
‘গভীর হাওয়ার রাত ছিল কাল-অসংখ্য নক্ষত্রের রাত’-এই দিয়ে হাওয়ার রাত কবিতাটির শুরু। প্রথম দুই মুভমেন্টে (স্তবকের বদলে মুভমেন্ট বলছি) স্বরের উচ্চাবচতা খুব নেই। প্রথম মুভমেন্ট শেষ হয়েছে, ‘কাল এমন চমৎকার রাত ছিল’ দিয়ে। দ্বিতীয়টির শেষ ‘কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিল’। তৃতীয় মুভমেন্টে ‘বিদিশার,’ ‘কুয়াশায়-কুয়াশায়’ স্বরবর্ণ বিলম্বিত অর্ন্তমিলের ধ্বনি বিস্তৃত হয়ে ‘কাতারে-কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন-মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য? জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য?’ এই প্রশ্নের পুনশ্চ ধাক্কা ‘জন্য’, ‘জন্য’, ‘জন্য’র প্রক্ষেপে আটকে গেছে। তারপরের মুভমেন্ট একটা বিশাল ঢেউয়ের মতো দ্রুতবেগে আছড়ে পড়েছে:
আকাশের বিরামহীন বিস্তীর্ণ ডানার ভিতর
পৃথিবী কীটের মত মুছে গিয়েছে কাল!
আর উত্তুঙ্গ বাতাস এসেছে আকাশের বুক থেকে নেমে
আমার জানালার ভিতর দিয়ে’ শাঁই শাঁই করে,
সিংহের হুংকারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মত!
হৃদয় ভরে গিয়েছে আমার বিস্তীর্ণ ফেল্টের সবুজ ঘাসের গন্ধে
দিগন্ত-প্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে,
[হাওয়ার রাত (বনলতা সেন)]
তিমির হননের গান, এটিও গদ্য কবিতা। ‘কোন হ্রদে’, ‘কোথাও নদীর ঢেউয়ে’, ‘কোন এক সমুদ্রের জলে’-ছোট ছোট তিন লাইনে শুরু। মাঝামাঝি অংশে, ক্রিয়াপদের ধ্বনি এবং ক্রিয়া পেঁচিয়ে উঠেছে ঘোরানো সিঁড়ির মতো:
স্বতই বিমর্ষ হয়ে ভদ্র সাধারণ
চেয়ে দ্যাখে তবু সেই বিষাদের চেয়ে
আরো বেশি কালো কালো ছায়া
লঙ্গরখানার অন্ন খেয়ে
মধ্যবিত্ত মানুষের বেদনার নিরাশার হিসেব ডিঙিয়ে
নর্দমার থেকে শূন্য ওভারব্রিজে উঠে
নর্দমায় নেমে-
ফুটপাথ থেকে দূর নিরুত্তর ফুটপাথে গিয়ে
নক্ষত্রের জ্যোৎস্নায় ঘুমাতে বা ম’রে যেতে জানে
[তিমির হননের গান (সাতটি তারা তিমির]
মন্বন্তরের এই ছবি ক্রিয়াপদের ক্রমপারস্পর্য এবং পারস্পর্যের ধ্বনি হ’য়ে, চেয়ে, খেয়ে, ডিঙিয়ে, উঠে, নেমে, গিয়ে, ম’রে, যেতে, জানে-বিনা কি এটা মর্মস্পর্শী হতে পারতো?
‘উড়ে যাওয়া পদধূলি’-অসমাপিকা ক্রিয়ার ঢুলে পড়া ধ্বনি অপছন্দ করে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সারাটা দিন কাটিয়ে দিয়েছিলেন ‘উড্ডীন’ শব্দের পুনরাবিষ্কারে। জীবনানন্দ তাঁর সমগ্র কবিতা রচনায় বিস্তর অসমাপিকা ক্রিয়াপদকে, ক্রিয়ার পৌনঃপুনিকতা ব্যবহার করে এক অদ্ভূত লয়ের বাচন সৃষ্টি করেছিলেন। সেই ভাষা ভঙ্গিতে যেমন চিত্রগুণ ক্ষমতা প্রকাশ পেয়েছে তেমনি সম্ভব হয়েছে ধ্বনি সম্পূরকতার, যা বক্তব্যকে, ব্যঞ্জনাকে সমূহ বিস্তৃত করেছে। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় যে বহুব্রীহি দূরত্ব-বিস্তৃতি প্রকাশ করেছেন-মানসিক দূরত্ব ও বিস্তৃতি এবং প্রবাহমানতা, ব্যক্তি সম্পর্কের দূরত্ব ও বিস্তৃতি এবং প্রবাহমানতা, বাঙলার ইতিহাসের দূরত্ব ও বিস্তৃতি এবং প্রবাহমানতা, সেই সাথে ভৌগোলিক অবস্থানের দূরত্ব ও বিস্তৃতি এবং বিচিত্রতা:
মাঠ থেকে মাঠে মাঠে-সমস্ত দুপুর ভ’রে এশিয়ার আকাশে আকাশে
শকুনেরা চরিতেছে; মানুষ দেখেছে হাট ঘাঁটি বস্তি,-নিস্তব্ধপ্রান্তর
[শকুন (ধূসর পাণ্ডুলিপি)]
সবুজ ধানের নিচে-মাটির ভিতরে
ইঁদুরেরা চ’লে গেছে আঁটির ভিতর থেকে চ’লে গেছে চাষা;
[অবসরের গান (ধূসর পাণ্ডুলিপি)]
আবার কুড়ি বছর পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!
[কুড়ি বছর পরে (বনলতা সেন)]
যে নক্ষত্রেরা আকাশের বুকে হাজার-হাজার বছর আগে ম’রে গিয়েছে
তারাও কাল জানালার ভিতর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে ক’রে এনেছে;
[হাওয়ার রাত (বনলতা সেন)]
এইখানে সময়কে যতদূর দেখা যায় চোখে
নির্জন ক্ষেতের দিকে চেয়ে দেখি দাঁড়ায়েছে অভিভূত চাষা;
এখনো চালাতে আছে পৃথিবীর প্রথম তামাশা
সকল সময় পান করে ফেলে জলের মতন এক ঢোঁকে;
[আবহমান (শ্রেষ্ঠ কবিতা)]
সান্তাক্রুজ থেকে নেমে অপরাহ্নে জুহুর সমুদ্রপারে গিয়ে
কিছুটা স্তব্ধতা ভিক্ষা করেছিল সূর্যের নিকটে থেমে সোমেন পালিত;
বাংলার থেকে এত দূরে এসে-সমাজ, দর্শন, তত্ত্ব, বিজ্ঞান হারিয়ে,
প্রেমকেও যৌবনের কামাখ্যার দিকে ফেলে পশ্চিমের সমুদ্র তীরে
ভেবেছিল বালির উপর দিয়ে সাগরের লঘুচোখ কাঁকড়ার মতন শরীরে
ধবল বাতাস খাবে সারাদিন।
[জুহু (সাতটি তারার তিমির )]
সিন্ধুশব্দ বায়ুশব্দ রৌদ্রশব্দ রক্তশব্দ মৃত্যুশব্দ এসে
ভয়াবহ ডাইনীর মত নাচে-ভয় পাই-গুহায় লুকাই;
লীন হতে চাই-লীন-ব্রহ্মশব্দে লীন হয়ে যেতে
চাই। আমাদের দু’হাজার বছরের জ্ঞান এ-রকম।
[ইতিহাসযান (বেলা অবেলা কালবেলা)]
নিচে হতাহত সৈন্যদের ভিড় পেরিয়ে,
মাথার ওপর অগণন নক্ষত্রের আকাশের দিকে তাকিয়ে
কোন দূর সমুদ্রের বাতাসের স্পর্শ মুখে রেখে,
আমাদের শরীরের ভিতর অনাদি সৃষ্টির রক্তের গুঞ্জরণ শুনে
কোথায় শিবিরে গিয়ে পৌঁছলাম আমি।
[সময়ের তীর (বেলা অবেলা কালবেলা)]
(……………………………………………………………………..চলবে)
আগের পর্বগুলোর লিংক:
জীবনানন্দের শ্রুতিকল্প : একটি বিশ্লেষণ (১) http://sonelablog.com/archives/23872
জীবনানন্দের শ্রুতিকল্প : একটি বিশ্লেষণ (২) http://sonelablog.com/archives/23989
জীবনানন্দের শ্রুতিকল্প : একটি বিশ্লেষণ (৩) http://sonelablog.com/archives/24057
জীবনানন্দের শ্রুতিকল্প : একটি বিশ্লেষণ (৪) http://sonelablog.com/archives/24143
৮টি মন্তব্য
শুন্য শুন্যালয়
সত্যি বলতে বিশ্লেষণে কিছুটা ভয়ই এসেছিল, আগের গুলো পড়াও হয়নি, শুধু পড়ে গেলেই যে হবেনা সেটা বুঝতে পেরেই। এটা পড়লাম, ভালোও লেগেছে কিছু বুঝতে পেরেছি বলেই হয়তো।
কবিতাগুলো অনেক সুন্দর, হতেই হবে।
পড়ার চেস্টা থাকবে পরের গুলো। ধন্যবাদ আপনাকে।
সাতকাহন
ধন্যবাদ, শুন্য।
মামুন
সাথেই রইলাম।
শুভ সকাল। -{@
সাতকাহন
ধন্যবাদ, মামুন।
মেঘাচ্ছন্ন মেঘকুমারী
কবিতার বিশ্লেষন। কিছুটা কঠিন আমার জন্য। কবিতা না বোঝার জন্য এটি হতে পারে।
সাতকাহন
পড়তে শুরু করুন, বুঝে যাবেন।
জিসান শা ইকরাম
দারুন বিশ্লেষন
এমন করে ভাবিনি কোনোদিন।
শুভ কামনা।
সাতকাহন
ধন্যবাদ, জিসান ভাই।