বার্লিন।

ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩

ডব্লিউ ভি এইচ হেডকোয়ার্টার থেকে বেড়িয়ে এসে টিয়ার গারটেন স্ট্রাসের দিকে ছুটে চলেছে ট্রুপস ক্যারিয়ার।

গাড়ি ভর্তি এস এস এর সদস্য এবং গুপ্ত পুলিশ গেস্টাপো সদস্যরা। লক্ষ্য কিছু বডি কালেকশন, টি ফোর প্রপ্রোগ্রামের জন্য । আজকের অপারেশন ভিন্নমতাবলম্বী কিছু জার্মান কে ক্যাম্পে চালান দেওয়া ।

তাদের নেতৃত্বে আছে তরুণ এস এস অফিসার ওবারফুয়েরার (মেজর) পল হাইনরিখ। তিনি মুলত প্যাঞ্জার ডিভিশনের কিন্ত সদ্য বদলি হয়ে এসেছেন ফ্রন্ট থেকে ডেস্কে । এমসগ্রুপ ডি প্রধান রাইখসফুয়েরার (জেনারেল)কার্ল শ্যুটের বিশেষ রেকমেন্ডশনে।

 

জার্মান হাই কমান্ড হেডকোয়ার্টার জসেন এর কাছাকাছি একটা রোডব্লকে গাড়ি রেখে পায়ে হেটে সৈন্যদল এগিয়ে যাচ্ছে নির্দিষ্ট বাড়িটির দিকে । তাদের কাছে খবর আছে এই বাড়িতেই আজ রাতে বাগদানের জন্য উপস্থিত থাকবে ডেযমন্ড হাইঞ্জ। খাটি জার্মান হওয়া সত্বেও হিটলার বিরোধী শিবিরের পান্ডা।

 

 

এইদিকে আইডার বাড়িতে বাজছে মোজার্টের জুপিটার সিম্ফনি, চমৎকার ডিজাইনের পারসিয়ান কার্পেটে মোড়ানো লাউঞ্জে অনেক পুরনো একটা ব্যাভারিয়ান ওয়াইনের বোতল খুলে অপেক্ষায় আছেন আইডা, হাইঞ্জের।দুজনেই দুজনকে প্রচন্ড ভালোবাসেন, দুজনের স্বভাবেও মিল আছে। বই পড়তে অসম্ভব ভালোবাসেন দুজনেই। আজকে দীর্ঘ উনিশ বছরের ভালবাসার সফলতার রাত। যদিও সামান্য দুশ্চিন্তায় আছেন হাইঞ্জের রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য। আদতে তার মতো নরম ও দয়ালু ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ কমই হয়, তাই হিটলারের নিষ্ঠূরতা মেনে নিতে না পেরে প্রতিবাদ করছেন হের হাইঞ্জ, আইডা তাই চিন্তাগ্রস্ত হলেও গর্বিতও তার ফিয়াসে কে নিয়ে।

 

অনেক খানি অপেক্ষার পর এলেন হাইঞ্জ , লম্বা চওড়া সুপুরুষ জার্মান যুবাপুরুষ। আইডা প্রায় ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পরলেন প্রিয়তমের বুকে। উষ্ণ আলিঙ্গনে বাধলেন।

 

এমন সময় সদর দরজায় ভারী বুটের শব্দ, মিলিটারি গ্রেটকোট পরা যমদূতের দল বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। চিৎকার করতেও পারলেন না আইডা, তার আগেই হাইঞ্জকে টেনে হিঁচড়ে রাইফেলের কুঁদোর বারি মেরে বের করে নিয়ে যাওয়া হলো,যমালয়ের উদ্দেশ্যে । সেইযে বজ্রাহতের মতো বসে পরলেন আইডা লাউঞ্জে সে বজ্রাহত ভাব আর কাটেনি ৪৩ এর এক ভোরে এলাইড ফোরস এর বম্বিং এ মাটিতে মিশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত । সবাই এয়ার রেইড শেল্টারে গেলেও উনি যাননি, অথবা যেতে চাননি।

 

হাইঞ্জ সহ আরো কয়েকজন কে নিয়ে যাওয়া হলো কুখ্যাত বুশেনওয়ার্ল্ডে।

প্রথম দফা জিজ্ঞাসাবাদের সময়ই রাইফেলের কুদো দিয়ে মেরে মেরে  তার কোমড়ের হাড় ভেঙ্গে দেওয়া হয়। এবং স্রেফ মারা যাওয়ার জন্য ফেলে রাখা হয় চার বাই চার একটা অন্ধকার সেলে। তার হৃদয় জুড়ে থাকা আইডার প্রতি ভালোবাসার তীব্রতাই তাকে বাচিয়ে তোলে। ভাঙা কোমড় এমনিতেই জোড়া লাগে, কিন্ত জীবনে আর কখনোই সোজা হয়ে দাড়াতে পারেননি হাইঞ্জ।

 

ভয়ঙ্কর সব অভিজ্ঞতা হয় তার বন্দীশিবিরে, যেমন অনাহারে একের পর এক সহস্রাধিক বন্দীর মৃত্যু দেখেন চোখের সামনে। ইহুদীদের পোকামাকড়ের মত খুন হতে দেখেন স্বজাতি জার্মান দের হাতে।একদিনের ঘটনা তার সারাজীবনের জন্য কুকুরের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মিয়ে দিয়েছিলো… দুজন এস এস গার্ড বন্দীদের সামনে পায়চারী করতে করতে স্রেফ বিরক্ত হয়ে পরছিল, বিকৃত আনন্দ পাওয়ার লক্ষে এক ইহুদী বন্দীর উপর সঙ্গের রটওয়াইলার কে ঝাঁপিয়ে পরার নির্দেশ দেয়। বিশালাকৃতি খুনে জার্মান কুকুর হাইঞ্জের চোখের সামনে অসহায় লোকটাকে আক্ষরিক অর্থেই ছিরে টুকরো টুকরো করে ফেলে পাচ মিনিটের ভেতর। এরপর অনেক রাত ঘুমের ভেতরেও তিনি বন্দীর আর্ত চিৎকার আর গার্ডদের পৈচাশিক উল্লাসধ্বনি শুনতে পেয়েছেন।

 

পয়তাল্লিশে মুক্তি পেয়ে বার্লিনে ফিরে আসেন , আইডার কাছে। বুশেনওয়ার্ল্ডের নরক অত্যাচার থেকে আগের সেই সাহসী ন্যায়নিষ্ঠ ভালোমানুষটা অক্ষতই বেড়িয়ে এসেছিলো, তবে শারীরিক নয় মানসিক ভাবে অক্ষত। কিন্ত হায় বন্দীশিবিরের চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছিল বার্লিনে। তার আইডা মিশে গেছে বম্বিং এ। যে বম্বিং হিটলারের কবল থেকে জার্মানি তথা মানবতা বাচানোর জন্য করেছিল এলাইড ফোরস। যেটা তার স্বপ্ন ছিলো

 

 

ক্লান্ত অবসন্ন বিধস্ত হাইঞ্জ মনের দুঃখে  চলে যান আমেরিকায়, আর কোনদিন ফিরে যাননি জার্মানিতে।

জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কলোরাডোর এক ছোট্ট পাহাড়ি শহরে একটা বইয়ের দোকান চালাতেন।

বিক্রি করতেন বই ,কেননা আইডার অনেক পছন্দের জিনিস ছিলো এই বই, তাই বইয়ের মাঝে ডুবে থেকে প্রিয়তমাকে অনুভব করতেন তিনি।

সংগী ছিলো আইডার সাথে কাটানো মধুরতম সময়গুলোর স্মৃতি।

৪২৬জন ৪২৬জন
0 Shares

১৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ