পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে থাকা হয়েছে, এবং ঘুরেছিও। তার মধ্যে সূর্যোদয়ের দেশ জাপান অন্যতম। আমার বর তরুণ জাপানের ইয়োকোহামার কিও ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি পড়ার সুযোগ পাওয়াতে আমি আর তীর্থ ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে ওখানে যাই। প্রায় পাঁচ বছর জাপানে ছিলাম। সেই সূত্রে বহু জায়গা বেড়ানো হয়েছে এবং প্রচুর কিছু দেখেছিও। সত্যি বলতে কী জাপানের মতো আর কোথাও এতো ঘুরে, বেড়িয়ে ভালো লাগেনি।
জাপানের একটা বিশেষ উৎসব হলো “হানামি(ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করা),” চেরি ফুল ফোটার উৎসব। “হানা” অর্থ ফুল, আর “মি” অর্থ হচ্ছে দেখা। জাপানের জাতীয় ফুল হলো সাকুরা(চেরি গাছের ফুল)। ওই ফুল ফোটার মানেই হলো “বসন্ত এসে গেছে।” আর তখনই আবেগী মন নেচে ওঠে, “বসন্তে ফুল গাঁথলো আমার জয়ের মালা।” ফুলের উৎসবে নাম-না-জানা পাখী গান গেয়ে ওঠে, আর প্রেমিক মন “কান পেতে” থাকে তার ভালোবাসার পায়ের শব্দ শোনার জন্য, তার একটুকু ছোঁয়া”র জন্য। এক কথায় বলা যায়, আমাদের দেশের বসন্ত উৎসব, আর জাপানীদের সাকুরা উৎসব, অর্থাৎ “হানামি।” জাপানের মানুষেরা চেরি ফুলকে খুবই পবিত্র ভাবে। এদের যে কোনো ডেকোরেশনে চেরি ফুল থাকবেই। এমন কোনো রাস্তা নেই, এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে চেরি গাছের উপস্থিতি নেই।
মার্চের মাঝামাঝি থেকে সম্পূর্ণ এপ্রিল জুড়ে চেরি তার পাঁপড়ি মেলে রাখে। অবশ্য প্রতি বছরই আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে হানামি উৎসবের তারিখ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। আমি প্রথম চেরি ফুলের এই উৎসব দেখি ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসের কোনো এক রবিবারে টোকিওর Ueno পার্কে। চেরি ফুলের সৌন্দর্য অবলোকন করার সবচেয়ে জনপ্রিয় এই পার্ক। এতো বেশি লোক সমাগম হয়ে থাকে যে, চোখে না দেখলে নয়! সেই প্রথম চেরি ফুল দেখে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে খেয়ালই করিনি আর কিছুই। আমার দুই বছরের ছেলেটার ছুটে এসে এই স্তব্ধতা ভেঙ্গে দিলো। তখন চেয়ে দেখি আমার চারপাশে প্রচুর মানুষ। প্রত্যেকেই মাদুর নিয়ে এসেছে, সাথে খাবার এবং পানীয়। ঠিক যেনো পিকনিক চলছে। আমরা প্রথমবার গিয়েছি, তাই অনেককিছুই জানা নেই। তীর্থ খুবই মজা পেলো। এদিক-ওদিক ছুটছে, পড়েও যাচ্ছে। কেউ কেউ গিটার নিয়ে এসেছে, গান গাইছে। একটা কথা না বললেই নয়, পরবর্তীতে শুনেছিলাম, ফুল দেখার সাথে পানীয়ও পান করতে হয়, তাতে নাকি সৌভাগ্যলক্ষ্মী সাথে থাকে। আমরা তিনজন তরুণ, আমি ও তীর্থ গিয়েছিলাম। ফুলের প্রচুর ছবি তোলা হলো।
তখন আমাদের ডিজিটাল ক্যামেরা ছিলোনা। পার্কের মাঠে মেলা বসেছে। খাবারের বিভিন্ন স্টল আছে, যে যার মতো খাবার কিনে খাচ্ছে। ভাবলাম আমরাও খাবো, কিন্তু আমি যেহেতু সুসি, সাসিমি খাইনা, তাই তরুণ আর তীর্থ খেলো। আমরা বিকেল থেকে রাত প্রায় আটটা পর্যন্ত ছিলাম। উফ সে যে কী অসাধারণ দৃশ্য! ফুল নয় যেনো একেকটি তারা জ্বলে আছে গাছে। স্বর্গের নাম শুনেছি, মনে হচ্ছিলো এটাই যেনো সেই স্বর্গীয় উদ্যান। কিন্তু ফিরে তো যেতেই হয়। কারণ পরেরদিন অনেক ভোরে তরুণকে যেতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাই চলে এলাম। আসার সময় মনে মনে বলতে বলতে এলাম, আবার আসবো।
পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে চার’শ জাতের চেরি ফুল আছে। তবে হাল্কা গোলাপি ও সাদা চেরি ফুলটাই বেশি জনপ্রিয় জাপানে। আমি মনে করেছিলাম চেরি ফুলের এই গাছ থেকেই বুঝি চেরি ফল হয়ে থাকে। আসলে কিন্তু তা নয়। চেরি ফলের গাছ আলাদা। এই সাকুরা বা চেরি ফুল গাছ জাপানের সর্বত্র দেখা যায়। এই গাছকে সকলেই পবিত্র বলে মনে করে। যাক সেসব কথা। তারপর ওই পাঁচটি বছরই হানামি উৎসবে সাকুরা/চেরি ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। সাথে খাবার নিয়ে গেছি। মাদুর বিছিয়ে খেয়েছি, খোলা আকাশের নীচে বসে গান গেয়েছি। শুয়ে শুয়ে আকাশও দেখেছি। আজও মিস করি চেরি ফুলের ওই উৎসবটাকে। তারপর কতো জায়গাতেই চেরী ফুল দেখেছি, কিন্তু জাপানের মতো আনন্দ কখনোই হয়নি। একদিন হয়তো আবার দেখা হবে, সেই অপেক্ষাতেই আছি।
হ্যামিল্টন, কানাডা
১২ ডিসেম্বর, ২০১৮ ইং।
:– সেই ২০০৪ সালের বেড়ানোর গল্প অনেকটাই ভুলে গেছি। যতোটুকু মনে আছে ততোটুকুই লিখেছি। আসলে ছবিগুলো হঠাৎ পেয়ে যাওয়াতেই লিখতে পেরেছি। দেখতে দেখতে সোনেলায় ছয়টি বছর কাটিয়ে দিলাম। এটা আমার ৩০১ তম পোষ্ট। ভাবতেই কেমন লাগছে, সময় বুঝি এভাবেই যায়!
২২টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
সব কিছু ঠিক আছে,
চাইলাম নূতন কবিতা
পাইলাম ছবিতে কিছু-কথা!!
রোজ এক গণ্ডা কবিতা দ্যান না ক্যা!!
নীলাঞ্জনা নীলা
এক গন্ডা কবিতা চাষ করবো, সার কেনার টাকা নেই। যে বীজ পুঁতেছিলাম, তার থেকে ফসল হয়নি। এখন আপনি যদি সার কেনার জন্য কিছু কবিতা-সার আমার নামে পাঠিয়ে দিতেন, হেব্বি কুবিতা পাইতেন। 😃😀
ছাইরাছ হেলাল
আচ্ছা,
আপনি চাইলে তো ত
না করতে পারি না।
ডাইনী পাঠালাম, যত্নআত্তি করলেই হবে।
আর কিছু না।
নীলাঞ্জনা নীলা
অতো যত্নয়াত্তি করতে পারবো না। এমনিতেই দুই চাকার উপর নির্ভর করে হাঁটি।
মাহমুদ আল মেহেদী
অস্বাধারন । মনে হচ্ছিলো যেন আমরাও সাথে ছিলাম এত চমৎকার করে লিখছেন সত্যিই সুন্দর লেখা ও চেরি ফুল
নীলাঞ্জনা নীলা
চেরী ফুল দেখার পর মুগ্ধতা এতোটাই বেড়ে গিয়েছিলো যে এখনও মিস করি চেরীর সৌন্দর্য।
যদি কখনো পারেন জাপান ঘুরে আসবেন। এতো সুন্দর একটা দেশ আমি কোথাও দেখিনি।
স্বপ্ন নীলা
যখন পড়ছিলাম তখন মনে হচ্ছিল আমার সামনে যেন ফুলগুলো ভাসছে– আর লেখনী ! সেতো অসাধারণ, চেরি ফুল আপনার লেখনীতে সত্যি আরো সুন্দর করে ধরা দিয়েছে দিদি —–
নীলাঞ্জনা নীলা
আপনি প্রশংসায় অকৃপণ। তাই এভাবেই বলছেন। আমি আর কই লিখতে পারি!
দেশে চেরী ফুল কি লাগানো যায়? ধারণা নেই। তবে একবার পারলে জাপান যাবেন। মুগ্ধ হয়ে ফিরবেন, কথা দিলাম।
জিসান শা ইকরাম
কত দেশে গেলাম, জাপানই যাওয়া হয়নি।
যাব একবার, আর তা হানামি উৎসব দেখার জন্যই।
এত ভাল করে বর্ননা দিলি না যেয়ে পারি?
তিনশততম পোস্টের জন্য শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনল।
সময় কিভাবে চলে যায়!
নীলাঞ্জনা নীলা
নানা জাপান গেলে তুমি আর কোনো দেশেই যেতে চাইবে না। তরুণ তো চীন, কোরিয়া আরোও অনেক দেশ ঘুরেছে। গিয়ে থেকেছেও ১-২ মাস। সেও বললো জাপানের মতো সুন্দর এবং সাজানো দেশ হয়না। বিশেষ করে মানুষের ব্যবহার, তুলনা হয়না। কেউ যদি বলে কানাডা নাকি জাপান নাকি ইয়্যূরোপ। আমি বলবো জাপান এবং অবশ্যই জাপান। তবে অনুরোধ রইলো নানা জাপানে কখনো গেলে অবশ্যই নানীকে নিয়ে যেও।
অনেক ভালো থেকো।
মায়াবতী
ছয়টি বছর পার করে ফেলেছেন আপু সোনেলার সাথে! ইশ আমি ও যদি আরো আগে আপনাদের কাছে আসতে পারতাম আরো কত কিছু ই না জানতাম 🙁 আপনার লেখা যেদিন থেকে পড়ি সে দিন থেকে ই দেখেছি সব কটি লেখায় বিভিন্ন বৈচিত্র্য থাকে, খুব ভাল লাগে আপু। ভাল থাকুন সব সময়, দোয়া রইলো। -{@
ওহ আরেক টা কথা, চেরি ফুল কখনওই দেখা হইনি সচোক্ষে তাই আপনার চোখে দেখে নিলাম নয়ন ভরে। খুব খুব খুব সুন্দর!!!
নীলাঞ্জনা নীলা
দেখতে দেখতে ছয়টি বছর! আমারও ভাবতে কেমন জান লাগে! এইতো সেদিন নানা আমাকে নিয়ে এলো। ইস তখন যদি এই মায়ায় ভরা মায়াবতীও থাকতো! তাহলে কতো দারুণ হতো! যাক দেরী হলেও দেখা তো পেয়েছি এই মায়াবতীর।
আপনি অনেক ভালো লেখেন। চেষ্টা করি লেখার, আজও ভালোভাবে মনের মতো করে লিখতে পারলাম না।
ভালো থাকুন প্রিয় মায়াবতী।
সাবিনা ইয়াসমিন
চেরী ফুল দেখলাম।অনেক সুন্দর।আপনার লেখনীতে পুরো উৎসবটাই যেন চোখের সামনে দেখা দিলো।
৩০১তম পোষ্টের জন্যে অনেক অনেক অভিনন্দন।খুব ভালো থাকুন।শুভকামনা রইলো। (3 -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
শুভকামনা বহমান থাকুক।
আসলেই চেরীর উৎসব এমনই যে আমি আজও ভুলিনি। একবার জাপান বেড়িয়ে আসবেন যদি সম্ভব হয়।
অনেক ভালো থাকুন। 🌹
তৌহিদ ইসলাম
এত সুন্দর ভাবে লিখেছেন যেন আমি নিজেই উপস্থিত ছিলাম সেখানে। আল্লাহ চাহেতো জীবনে একবার হলেও আমি যাব দেখতে এ উৎসব।
নীলাঞ্জনা নীলা
ঈশ্বর আপনার এই ইচ্ছে পূর্ণ করুক। শুভকামনা।
ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশী হোলাম।
মোঃ মজিবর রহমান
চেরিফুলের মেলার বর্ণনায় মনে হল চেরিফুল স্বচক্ষে দেখলাম আপু।
নীলাঞ্জনা নীলা
মজিবর ভাই চেরীফুলকে আমি খুব মিস করি।
একবার হলে চেরীফুলটাকে ছুঁয়ে দেখবেন, কী যে মিষ্টি, আদুরে ফুল!
ভালো থাকুন নিরন্তর।
মোঃ মজিবর রহমান
ভাগ্যদেবী সহায় হলে অবশ্যই ছুয়ে দেখব।
নীলাঞ্জনা নীলা
সদিচ্ছায় জোর থাকলে নাকি আশা পূর্ণ হয়।
ভালো থাকুন মজিবর ভাই।
রিমি রুম্মান
এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে নিউইয়র্কের বোটানিকেল গার্ডেনে ‘চেরী ব্লসম’ উৎসব হয়। প্রকৃতি প্রেমীরা দলে দলে ২৫ ডলারের টিকেটের বিনিময়ে সেখানে ঘুরে দেখবার সুযোগ পায়। সে এক বিস্ময়কর পরিবেশ!
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু চেরি ফুলের রাজ্য জাপানে কতো কতো যে চেরি উৎসব, সব ফ্রি। কৃত্রিমতা নেই একটুকুও। প্রকৃতির সাজ এমনই। যদি কোনোদিন সম্ভব হয়, জাপান বেড়িয়ে এসো। এতো সুন্দর আমি ইয়্যুরোপ, কানাডাতেও দেখিনি।
ভালো থেকো।