জাতিস্মর…..১

বনলতা সেন ৮ এপ্রিল ২০১৪, মঙ্গলবার, ০৮:৪৩:৫০অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১৬ মন্তব্য

সেবারে একদম হঠাৎ করেই গ্রামের বাড়ীতে বেড়াতে গেলাম,হর হামেশা যদিও যাওয়া হয় না।এই এমন সময় , চৈত্রের শেষাশেষি ,কপালপোড়া গরম শুরু হয়নি তখনো । একদিন হুট করে এসে নাছরিন বলল ” চল না তোদের বাড়ী যাই “।যতই নাচুনে বুড়ি হইনা কেন ‘ওঠ ছেরি তোর বিয়া’এমন তো তৈরি ছিলাম না।তবুও যা হওয়ার তাই-ই হয়। বাসে করে বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছলাম।বাসে যেতে যেতে একটি একাঙ্কিকা হয়ে গেল , কাব্যে নয় নিখাদ গদ্যে।দাঁড়ান দাঁড়ান,আগে সেটা বলে নেই বেশ জমিয়ে।না থাক ওটা জমা থাক।পরে হবে-ক্ষণ।

কাছে এসে বস,বসেছ? চুপটি করে মন দিয়ে শোন,শুনছ তো?শুরু করি তাহলে।
এক দেশে ছিল এক মায়াবতী মেয়ে ,নাম তার বনলতা। আর ছিল তার প্রাণের বন্ধু ,ভীষন দস্যি মেয়ে ,তার নাম নাছরিন।ওরা ছিল যেমন ডানপিটে তেমনি দুষ্টু,দুষ্টদের শিরোমণি,বদের হাড্ডি।একবার হয়েছে কী জান — ক্ষেতের মধ্যে পথের ধারে ভর সন্ধ্যায় এই দু’টোয় মিলে কাকতাড়ুয়া সেজে মানুষদের ভয় দেখিয়ে সে এক মহা কেলেঙ্কারি …………

ছি ছি সব্বাইকে শিশু ভেবে ঠাকুরমার ঝুলি খুলে বসার চেষ্টা!হাত উঁচু,মাফ করে দিন,যেমন করেন আপনারা সব সময়।এই পেছন ফিরে হাঁটছি,এমনটি কস্মিনকালেও আর হবে না।

বেশ বেলা করেই ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে পেছন-দিককার পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম।এদিকটায় বিশেষ প্রয়োজন না হলে কেউ আসে না।বেশ নিরিবিলি।একথা সেকথায় এক সময় ও জানতে চাইল এখানকার বৈঁচি-ফলের বাগানটা দেখছে না কেন । আমি একটু দূরে দেখিয়ে দিয়ে বললাম এখন অনেক কমে গেলেও কিছু অবশিষ্ট আছে।এরপর একটু কাছের মাঝারি আকৃতির একটি নারকেল গাছের ডাব দেখে বললাম ‘ ডাব খেতে পারতে মন্দ হত না।কিন্তু পেড়ে দিতে পারবে এমন তো কেউ নেই । থাক পরে দেখা যাবে ।’ একটু পরে নাছরিন বলে উঠল ‘আমি পেড়ে দেই ‘।নিজের কানকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল না।আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম’কী বললি?’ উত্তরে জানাল সে ডাব পেড়ে দিতে পারে।বলে কী?এই ধাড়ী নারকেল গাছে উঠবে?ও মড়বে আমাদেরও মারবে।রেগে গিয়ে বললাম ‘এমন চড় মারব সব দাঁত নড়ে উঠবে’।চুপ মেরে থেকে বৈঁচি বাগানের দিকে গেল বৈঁচি তুলবে বলে।

ছোট্ট পাখির মিষ্টি ডাক শুনে মনে মনে নয় চোখ দিয়েই খুঁজতে শুরু করলাম,খুঁজতে খুঁজতে মগডালে পাতার ফাঁকে নাম না জানা সুন্দর ছোট্ট পাখিটি দেখতে পেলাম।এক মনে সুর করে ডাকছে।কাকে ডাকছে কেনই বা ডাকছে আনন্দে না বেদনায় ডাকছে নাকি গান করছে কিছুই জানা হল না,তন্ময় হয়ে শুনছি আর শুনছি আর ভাবছি পাখির ভাষা বুঝলে এখন কত আনন্দ হত।

হঠাৎ ছড় ছড় শব্দে সম্বিৎ ফিরে এলে শব্দের উৎসে চোখ গেল।এ আমি কী দেখছি,আমার চোখকে আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না।আমার আত্মা হিম হয়ে এলো,ভয়ে কাঁপতে শুরু করছে সারা শরীর,মুহূর্তেই ঘামতে শুরু করেছি কুল কুল করে।বোবা হয়ে গেছি নিজের অজান্তেই।প্রায় হেঁটে হেঁটে অর্ধেক গাছে উঠে আবার তেমন করেই নেমে এলো কোন সময় ই নিল না যেন।গাছের গোড়ার কাছ থেকে আধ-শুকো আস্ত কলাপাতা দিয়ে বানানো গোলকরা দড়িটি দু’পায়ে গলিয়ে দু’হাতে গাছ জড়িয়ে ধরে তর তর করে বেয়ে গাছের মাথায় উঠে বসেছে। ভাবছি এই ধাড়ি ঢেমনি যদি আল্লাহ্‌ না করুণ কোন কারণে গাছ থেকে পিছ্‌লে নীচে পড়ে যায় তখন কী হবে? আমি ভাবতে পারছি না,মাথা ঘুড়ে উঠেছে,বমি বমি লাগছে।যদি ধরেও নিলাম পড়ে যেন যাবে না গাছ থেকে কিন্তু এই গ্রামের কেউ যদি দেখে ফেলে ঐটা নারকেল গাছে চড়েছে,মান-ইজ্জত এ বাড়ীর থাকবে?আমার কান্না পেল। আমি কেঁদে কেঁদে হাত জোড় করলাম,হাত-পা ধরে যত রকম অনুরোধ উপরোধ করা সম্ভব তা সবই করলাম।গাছ থেকে সাবধানে নেমে আসতে বললাম আল্লার ওয়াস্তে ,কিন্তু কিসের কী?

এই যে বন লক্ষ্মী,লতা সোনা আমার,আগে মনে ছিল না?আমাকে যখন দাঁত নড়াতে চেয়েছিলে? চুপ,একদম চুপ।আবার ফোঁপায়?একটু শব্দ বেরোলে মাথা ফাটিয়ে ফেলব নারকেল ছুড়ে।এই,চুপ।কোন ফোঁস ফোঁস করাও চলবে না,এই মারলাম নারকেল।ইস এ কী করলাম?ছোট ডাবটি তো ওর পায়ে দিয়ে পড়ল হাত ফসকে।ব্যথা পেয়েছে নিশ্চয়ই।মন খারাপ লাগছে,কয়েকটা ডাব নীচে ফেলে দিয়ে দ্রুত নেমে পড়ি।ওর পায়ের অবস্থা কী করেছি কে জানে।

বাড়ির ভেতর থেকে কে যেন ডেকে বলল ‘বনলতা কিসের শব্দ পেলাম?তোরা কোথায়?’আমি বলে দিলাম,’ও কিছু না আমরা এখানেই আছি।’
নাছরিন গাছে থেকে নেমে অনেক যত্নে চোখের জল মুছিয়ে পা টেনেটুনে দেখল পরম মমতায় আর কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বলল ” তুই চাইলে এক ফুঁৎকারে দোজখের আগুন নিভিয়ে দিতে পারি “।

৩৫১জন ৫৩০জন
0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ