আবীরের নতুন চাকরি সুত্রে শ্রীমঙ্গলের কাঞ্চন নগর চা বাগানে যাচ্ছে সে, বাবা রহমান সাহেবের অঢেল টাকা, গ্রুপ অফ কোম্পানি থাকলেও আবীর চাই সে নিজে কিছু শিখুক, তাই বাবা আর না করেননি, যদিও মা কান্নাকাটি করেছিলেন কিন্তু আবীর বুঝিয়ে শুনিয়ে চলেছে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে, নিজে বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার সাথে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ, চাকরী নিয়েছে চা বাগানের ম্যানেজার হিসাবে, নিজের ভালোবাসাকে সে প্রাধান্য দিয়েই সে এই চাকরি নিয়েছে, পাহাড়, বন জঙ্গল ওকে খুব টানে।
ঢাকা সিলেট রোডের শ্রীমঙ্গল লিংক রোডের মুখে বাস থেকে নেমে পড়লো আবীর, একটা লোক দৌঁড়ে এসে আবীরকে জিজ্ঞেস করলো, স্যার আপনি আবীর চৌধুরী?
হাঁ।
সালাম স্যার, ব্যাগ গুলো আমি নিচ্ছি, ঐ যে গাড়ী।
আবীর ভালো করে দেখলো ওকে নিতে আসা মানুষটির দিকে, মুখে হাসি, সামনের দুইটা দাঁত নেই, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, মানুষটা ওর ব্যাগপত্র নিয়ে আগে আগে এগুলো মানুষটা, গাড়ীর কাছাকাছি এসে ব্যাগ গুলো পিছনে রেখে আবীরকে জীপের সামনের সিটে বসিয়ে গাড়ী ছেড়ে দিলো।
কি নাম তোমার?
স্যার, আমার নাম রসিক আলি, কাঞ্চন নগর চা বাগানের এসিস্টেন্ট ম্যানেজার স্যারের গাড়ী চালাই, স্যারই আপনাকে নিতে পাঠালেন।
আবীর বেনসন লাইটের প্যাকেটটা বের করে একটা সিগারেট ধরালো, দুই টান দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এইখান থেকে কতদূর বাগান?
স্যার, দুই ঘন্টা লাগবে।
গাড়ী যখন বাগানের ভিতরের পথ ধরে এগুলো, আবীর মুগ্ধ চোখে এইদিক ঐদিক তাকাতে লাগলো, একসময় বাগানের দূরের কিছু গাছে বানর দেখতে পেয়ে গাড়ী থামাতে বলে নিজের হ্যান্ডব্যাগ থেকে ডিএসএলআর বের করে পটাপট ছবি তুলতে লাগলো, ছোটবেলা থেকেই ওর ছবি তোলার শখ, একসময় সে ন্যাচার ফোটোগ্রাফিও করতো।
ছবি তোলা শেষে আবার গাড়ী নিয়ে এগুলো।
স্যার, এসিস্টেন্ট ম্যানেজার স্যার বলেছিলেন আপনাকে নিয়ে সোজা উনার বাসায় নিয়ে যেতে।
তাই, তাহলে আর কি, চলো।
বাগানের এঁকে বেঁকে চলা, মাঠির উঁচু নিচু পথ শেষে একটি বাংলো টাইপের বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো তাদের গাড়ী।
এক বয়স্ক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাকে দেখা গেল দ্রুত বাংলো বাড়ীটি থেকে বেরিয়ে আসতে, ভদ্রলোক দ্রুত গাড়ীর পাশে এসে বললেন, সালামালেকুম স্যার, আমি রফিক শেখ, এই বাগানের এসিস্টেন্ট ম্যানেজার, আসুন স্যার, আসুন।
আবীর গাড়ী থেকে নেমে বললো, আমি আপনার বয়সে ছোট, আপনি আমাকে স্যার স্যার করলে আমি লজ্জিত হবো, আপনি আমাকে আবীর বলেই ডাকবেন প্লিজ, সাথে তুমি করেই বলবেন।
ভদ্রলোক আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরলো আবীরকে, খুব খুশি হলাম বাবা, আসলে তুমি আমার ছেলের বয়সী, আসো আসো।
ভদ্রলোক আবীরকে নিয়ে বাংলোর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বারান্দায় দাঁড়ানো ভদ্রমহিলাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, ও হলো আমার ওয়াইফ।
আবীর সালাম দিলে, ভদ্রমহিলা ওয়ালাইকুম সালাম বলে পাশে পাশে এগুলেন, রফিক শেখ, আবীরকে বারান্দায় রাখা বেতের সোফাতে নিয়ে গিয়ে বসালেন।
বেশ পরিপাটী করে সাজানো বাসাটি, বাসার সামনে লাইন ধরে বিভিন্ন ফুলের গাছ, কয়েকটি গাছ আবীর চিনলো, কনকচাঁপা, কৃষ্ণচুড়া, সোনালু, বাগান বিলাশ সহ আরো অনেক ফুল আর ফলের গাছ, সামনের টি টেবিলের ফুলদানিতে রাখা আছে নাম না জানা বনফুল।
একটু পর ভদ্রমহিলা তিন কাপ চা, ঘরে বানানো সিংগারা আর ডালপুরি নিয়ে এলেন।
আবীর, নাও নাও তোমার আন্টি নিজের বানানো, রফিক শেখ সিংগারার প্লেট তুলে আবীরের সামনে এগিয়ে দিলো।
আবীর সিংগারা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো, আনকেল এইখানে কতো বছর ধরে আছেন এই বাগানে?
তা প্রায় পাঁচ বছর হয়ে গেল, আগে অন্য চা বাগানে ছিলাম।
বাহ অনেক বছর, আর আগের ম্যানেজার সাহেব চাকরি ছাড়লেন কবে?
তিন বছর হয়।
আপনাদের বাসাটা খুব সুন্দর, আপনারা দুজনেই থাকেন?
না না, আমার মেয়েও থাকে, ও আবার সিলেট শাহজালাল ইউনিভারসিটিতে পড়ে, গতকালই এসেছে, এই তোমার মেয়ে কই, উনার ওয়াইফকে জিজ্ঞেস করলেন।
কই আবার, নিশ্চয় সারা বাগান মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, রফিক সাহেবের ওয়াইফ হেসে বললেন।
তা আবীর, তুমি আসো আমার সাথে, মুখ হাত ধুয়ে নাও, তোমার আন্টি খাবার রেডি করুক।
এতো কষ্ট কেন করছেন, আবীর বলে উঠলো।
বাবা তুমি এইসময় খাবার পাবে কোথায়, অবশ্য আমার আর্দালি আর তোমারটা মিলে তোমার বাংলো পরিস্কার করছে।
রফিক সাহেবের ওয়াইফ অনেক কিছুই রান্না করেছেন আজ, কই মাছের পাতুরী, রুই মাছ ভুনা, গরু, মুরগি, হাঁসের ডিম, মিক্সড ভেজিটেবেল আর পোলাও।
এতো কিছু করলেন আন্টি, আবীর আৎকে উঠলো।
না বাবা তেমন কিছুই না, ভাত বেড়ে দিতে দিতে জবাব দিলেন মিসেস রফিক।
কই মাছ মুখে দিয়েই আবীর খুশি হয়ে উঠলো, বাহ এ দেখছি আমার মায়ের হাতের রান্নার মতো।
তাই, তুমিও তো আমার ছেলের মতোই, খাও বাবা, খাও।
খুব আদর যত্ন করে আবীরকে খাওয়ালেন মিসেস রফিক, খাবার শেষে মিষ্টি দই দিলেন আবীরকে।
আবীর আর রফিক সাহেব খাওয়া শেষে সামনের বারান্দায় বসলে, মিসেস রফিক চা নিয়ে এলেন, চায়ে চুমুক দিয়ে আবীর বললো, আন্টি আপনার চাটা বেশ।
মিসেস রফিক মিষ্টি হেসে বললেন, আমাদের বাগানেরই চা।
চা পান শেষে রফিক সাহেব নিজেই চললেন আবীরকে ড্রপ করার জন্য, দশ মিনিটের পথ আবীরের বাংলো, রফিক সাহেবের বাংলোর মতই অনেকটা, সাইজে একটু বড়, পুরা বাংলোটাই সাদা রঙ করা, ছাদটা সবুজ। গাড়ীর আওয়াজ শুনে ঘরের ভিতর থেকে দুইজন মানুষ বেরিয়ে এলো, গাড়ী থামার পর দুজনেই নমস্কার জানালো, রফিক সাহেব সাহেব দুজনের পরিচয় দিলেন, একজন হলো হারাধন, আবীরের আর্দালি, কুক ও কেয়ার টেকার, আরেকজন হলো লক্ষি, সে বাংলোর দারোয়ান কাম মালি।
সুখি কই, রফিক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন?
স্যার ও কাজ শেষে এই কিছুক্ষণ আগেই চলে গেল।
রফিক সাহেব আবীরকে পুরা বাংলো ঘুরিয়ে দেখালেন, এইখানেও প্রচুর ফুল গাছ আছে, যা দেখে আবীরের মন ভরে গেল।
হারাধন, বাজার সদাই কিছু করেছিস, রফিক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।
হ স্যার, মাছ মুরগি সব নিয়ে আসছি।
আবীর তোমার গাড়ী ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি নিয়ে আসার জন্য, ও প্রতিদিন সকাল ছয়টার সময় হাজির থাকবে, সাতটার সময় অফিসে নিয়ে যাবে তোমাকে।
জি আনকেল।
তাহলে আমি আসি?
জি আপনাকে আর আন্টিকে অনেক কষ্ট দিলাম আজ।
না না কষ্টের কিছুই ছিলোনা, এইখানে মেহমান আমরা কই পাই বলো, আসি তাহলে।
সালামালেকুম।
ওয়া আলালাইকুম সালাম।
………… চলবে।
ছবিঃ Google.
১৯টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
আপনার গল্পের হাত ভাল চলুক সঙ্গে আছি।
ইঞ্জা
ধন্যবাদ ভাই, খুব আপ্লুত হলাম।
নীরা সাদীয়া
নতুন গল্প শুরু হল নাকি? ছবিটা দারুন। লিখে যান। একদিন সময় করে সবগুলা পর্ব একসাথে পড়ব।
ইঞ্জা
জি আপু, নতুন শুরু করলাম, রেগুলার পড়ে কমেন্ট করলে উৎসাহিত হতাম। :)/
আবু খায়ের আনিছ
একটা মজার কথা মনে পড়ল, এক লেখক বলেছিল, গাছের চেয়ে গাছের ডালপালা বড় করে ফেলতে গাছের আর মূল্য থাকে কই?
উত্তরটাও ছিল এই রকম, গাছ দেখে গাছ চিনা যতটা সহজ তারচেয়ে বেশি সহজ ডালপালা দেখেই।
যাইহোক, নামের সাথে গল্পের শুরুর কোন কিছুই পেলাম না, অথাৎ এই গল্পটাও বেশ বড় হবে বুঝা যাচ্ছে। ডালপালা হোক, তবে যেন আগাছা বা পরগাছা না হয়।
সময় করতে পারি না তাই ইদানিং অনেক কিছু মিস হয়ে যায়। তবু যেহেতু একবার পড়া শুরু করেছি চেষ্টা করব সবগুলো পর্ব ঠিক টাইমেই পড়ব নয়ত পরে পড়ে নিব। শুভ কামনা ভাইয়া।
ইঞ্জা
আনিছ ভাই, মাত্র তো শুরু করেছি, জলতরঙ্গ দেবো কোথা হতে, আবীরের পরিচয় থেকে কিছু বুঝা উচিত ছিলো আপনার, কারণ সে একজন বায়ো ইঞ্জিনিয়ারও বটে, আবার জীবনে চলার ভাষায়, ভালোবাসায় একটি তরঙ্গ থাকে নয় কি?
ইঞ্জা
আরেকটা কথা বলি, নামটি প্রতিকি। 🙂
আবু খায়ের আনিছ
নামটি যে প্রতিকী সেটি বুঝেছি, আর হা, পরিচয় পর্ব ভালো হয়েছে। ঐ যে বললাম ডাল পালা থেকেই আসল গাছ চিনা যায় দ্রুত। আমরাও চিনতে চাই বাকী গল্প পড়ে।
ইঞ্জা
ধন্যবাদ আবারো ভাই, আপনাদের নিরাশ করবোনা আশা রাখি, পাশে থেকে অনুপ্রেরণা দেবেন এই কামনা রাখছি।
ছাইরাছ হেলাল
অনেক অপেক্ষা করিয়ে আবার গল্প লিখছেন!!
ভালো লাগবে আশাকরি, আমাদের সকলের,
সাথেই আছি, ছিলাম যেমন।
ইঞ্জা
ধন্যবাদ ভাইজান, আপনারা অনুপ্রেরণা দেন বিধায় লেখার সাহস করি, আমি চেষ্টা করছি ভালো লেখার, আশা করি ভালো লেখা উপহার দেবো, আবারো ধন্যবাদ ভাইজান।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
গল্পের শুরুতে মেহমানদারী ভালই দেখালেন।দেখি সামনে কি আছে।
ইঞ্জা
গল্পের শুরু হলো মাত্র, দেখি আর কি কি করা যায়, পাশে থাকবেন ভাই।
সৈয়দ আলী উল আমিন
ধন্যবাদ ভাই
ইঞ্জা
পাশে থেকে অনুপ্রেরণা যোগাবেন, এই কামনা রইল।
শুন্য শুন্যালয়
লেখায় এমন টেস্টি টেস্টি খাবারের লোভ দেখালে আকর্ষণীয় না হয়ে পারে? আর এতো সুন্দর করে জায়গাটার বর্ননা দিয়েছেন! আফসোস যে আমি জীবনে কখনো চাবাগানই দেখলাম না। 🙁
জলতরঙ্গের মিষ্ট মিষ্টি প্রেমের গল্পের সাথে এগুচ্ছি। লিখুন ভাইয়া।
ইঞ্জা
আপু দেশে আসুন, টেস্টি টেস্টি খাবারের দাওয়াত রইল।
আপু, আমি অনেকবার চা বাগান ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছি, একরাত বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতেও থেকে ছিলাম। 😀
অনুপ্রেরণা দিয়ে আমার লেখা এগিয়ে নিতে সাহায্য করবেন, এই কামনা রইল।
জিসান শা ইকরাম
বাগানের বর্ননা, সুন্দর একটি বাংলো, লোভনীয় খানা খাদ্য ভক্ষণ,
দিলেন তো মাথা আউলা ঝাউলা করে।
মনে হচ্ছে তো এই আবীরটা আপনিই, নাহলে এত সুন্দর করে ক্যামনে লেখেন? 🙂
ভাল লাগলো প্রথম অংশ।
অপেক্ষা পরের পর্বের জন্য।
ইঞ্জা
ভাইজান, আমি জীবনে চা বাগান অনেক দেখেছি, সাথে এক রাত বাগান ম্যানেজারের বাসায় থাকার অভিজ্ঞতাও আছে, এতেই চা বাগান নির্ভর গল্প লেখার চেষ্টা করছি, খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে আমি একটু সৌখিন, আপনার ভাবি রাঁধেনও বেশ, আমার ভাবী, মা, বাচ্চাদের নিয়ে একদিন চলে আসুন, খুশি হবো। 🙂
দোয়া রাখবেন ভাইজান।