এক জুনে ছেলেটি জন্মালো। তাঁর জন্মের একমাস আগ অবধি আমি জব করি। জবটি জরুরি ছিল। শরীরের ভেতর আরেকটি শরীর বহন করে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু খেয়ে রওয়ানা দেই কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। এরপর পথিমধ্যে বমি করতে করতে যাওয়া। ট্রেনে উঠে মনে মনে দোয়া করতে থাকি, আজ যেন এস্কেলেটরটা সচল থাকে। বলা বাহুল্য, ওই সময় প্রায় প্রতিদিনই সেটি রিপেয়ারের কাজ চলতো। কাজ থেকে ফেরার পথে পথিমধ্যে ট্রেন বদল করতে হয়। গ্রাউণ্ড ফ্লোর থেকে অনেক উপরের ৭ নং ট্রেন। কয়েক সিঁড়ি উঠি। দাঁড়িয়ে থাকি। শ্বাস নেই। আবার খানিক উঠি। এভাবে উপরে উঠার সিঁড়ি যে আর শেষ হয় না ! একদিন গুনে দেখি ৯৭ টি স্টেপ ! এভাবেই দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফেরা প্রতি রাতে। দশ মাস পর সন্তান জন্মদানের সময়কার কষ্টের কথা আর না-ই বলি। শুধু বলি__ পৃথিবীর কোন কষ্টের সাথেই একজন মা’য়ের সন্তান জন্মদানের কষ্টের তুলনা হতে পারে না। ভয়াবহ এক অন্ধকার। সেখান থেকে কেউ ফেরে, কেউ ফেরে না…
এ কষ্ট কেমন করে ভুলে যায় প্রতিটি মা ! কেমন করে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়জন জন্মায় ! ক’বছর বাদেই উত্তর পেয়ে যাই। মনে হতে থাকে__ এত কষ্ট করে যাকে পৃথিবীর আলো-বাতাসে নিয়ে এলাম, তাঁর কোন ভাই-বোন থাকবে না…সুখ-দুঃখ শেয়ার করার কিংবা বাবা-মা’র অবর্তমানে বিপদে এগিয়ে আসার কেউ থাকবে না, এ কেমন করে হয়। এরপর আবারও সেই কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। এবার ভয়াবহ আরেক অভিজ্ঞতা। পুরো দশমাসই যমের সাথে লড়াই চলে। যম নিয়ে যেতে চায়। আমি বেঁচে থাকতে চাই আমার ছয় বছরের ছেলেটির জন্যে। এভাবে আটমাস লড়াই করে করে ক্লান্ত আমি জ্বরে পুড়ে যেতে থাকি। ডাক্তার চিন্তিত হয়ে উঠে। হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে পাঠানো হয় ইন্টেনসিভ কেয়ারে। মুখে অক্সিজেন,হাতে পা’য়ে, আঙুলে, সমস্ত শরীরে নানান রকম যন্ত্রপাতির তার জড়িয়ে পেঁচিয়ে রাখা। এক একটি মেশিন শরীরের এক একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা জানান দেয়। স্যালাইন দেয়া, ব্লাড নেয়া সহ প্রতিদিন বেশ অনেকবার সুঁই এর আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হই। ডাক্তার, নার্স, সবাই মাস্ক পরে রুমে ঢুকে। আমি কারো মুখের অভিব্যক্তি দেখতে পাইনা। শুধু কুচ্কে থাকা কপালটুকু দেখে আন্দাজ করি,আমি সম্ভবত মারা যাচ্ছি। বাবা-মা’কে খুব মনে পরে। ভাই বোন দুটোর মুখ ভেসে উঠে। ছেলেটাকে খুব দেখতে মন চায়। কিন্তু ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে কারো ঢুকতে মানা। বিধায় ছেলেটিকে নিয়ে ওর বাবা দূরের এক গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়, যেখান থেকে আমার রুমের জানালা দিয়ে আমি তাকে এক নজর দেখতে পাই। দূরের সবকিছুই অস্পষ্ট। সেই অস্পষ্ট ছোট্ট রিয়াসাত’কে দেখে ভেতরটা হুহু করে উঠে…
দেশে মা রাতভর দীর্ঘ প্রার্থনায় বসে থাকে। বাবা মসজিদে দোয়া পড়ায়। এদিকে শারীরিক যন্ত্রণায় ধীরে ধীরে আমার জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যেতে থাকে। জীবনকে বিষাক্ত মনে হয়। মনে হতে থাকে, যত তাড়াতাড়ি মৃত্যু, ততো তাড়াতাড়ি মুক্তি। অজ্ঞাত সেই ফ্লু এর কারনে যখন সারা বিশ্বেই শতশত মানুষ মারা যাচ্ছিল, তখন আমি সবার দোয়া, ডাক্তারদের নিবিড় চিকিৎসা আর সৃষ্টিকর্তার কৃপায় বেঁচে উঠি। বাইরের মুক্ত বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেই। পৃথিবীটাকে আগের চাইতে আরো সুন্দর মনে হতে থাকে। অতঃপর জুলাইয়ের এক ঝলমলে দিনে দ্বিতীয়জনের জন্ম হয়। তাঁর নাম রিহান…
## প্রতিটি মা’য়ের সন্তান জন্মদানের দুঃসহ কিছু গল্প থাকে। গল্পগুলোর মাঝে ভিন্নতা থাকে হয়তো। তবে অসহনীয় কষ্টগুলোতে ভিন্নতা নেই। আমার, আপনার সকলের মা’য়েরা এমন কষ্ট করেই আমাদের পৃথিবীতে এনেছেন নিশ্চিত।
২০টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
মায়েদের যেমন করে মনে রাখার কথা তা পারিনি পারিনা।
তবে মনে রাখতে চাই ই।
রিমি রুম্মান
আসলে মা না থাকলেই সবাই উপলব্দি করতে থাকে, মা কি ছিল। তবে মায়েদের ত্যাগ কোন কিছুর সাথেই তুলনা চলে না। নিজে মা না হলে এমন করে বুঝার ক্ষমতা পেতাম না হয়তো।
জিসান শা ইকরাম
জন্মদিনের শুভেচ্ছা নিন -{@
যেমন করে লিখলেন,তেমন করে ভাবিনি কোনদিন
একজন পুরুষ হয়ে এমন কষ্ট অনুভব করা অসম্ভব আসলে।
মা কে যেন স্মরনে রাখি আজীবন
আপনি সহ সকল মা ভালো থাকুক,সন্মানের সাথে।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন সবসময় ।
নীলাঞ্জনা নীলা
অনুভুতি গুলো আপনি খুব ভালো ভাবে প্রকাশ করতে পারেন।এমন প্রকাশ আমি আর দেখিনি।
‘আমার, আপনার সকলের মা’য়েরা এমন কষ্ট করেই আমাদের পৃথিবীতে এনেছেন নিশ্চিত।’ -{@
রিমি রুম্মান
এমন মন্তব্যে উৎসাহিত হই। আরও লেখার প্রেরনা পাই। ভাল থাকুন।
শিশির কনা
সন্তান প্রসবে একজন মায়ের শারীরিক কষ্টকে নিপুন ভাবে প্রকাশ করেছেন।আমরা যেন মা কে না ভুলি।
রিমি রুম্মান
মা’কে বুঝতে বুঝতেই সময় শেষ হয়ে যায়, হায় !
প্রজন্ম ৭১
আল্লাহ আপনাকে যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখুন।এত কষ্টের পরেও আপনি একজন গরবিনী মা।শ্রদ্ধা নিন আমার। চমৎকার উপস্থাপনা।
রিমি রুম্মান
এমন করেই আপনার আমার আমাদের সকলের মায়েরা আমাদের পৃথিবীতে এনেছেন। মা’কে ভালবাসুন অনেক অনেক।
ব্লগার সজীব
শুভ জন্মদিন আপু।কত কষ্ট করেন একজন মা,সন্তানের মুখ দেখার জন্য।
রিমি রুম্মান
জন্মদিনের শুভেচ্ছায় আবেগাপ্লুত। যিনি কষ্ট করে এনেছেন পৃথিবীতে, তার মুখখানা ভেসে উঠে নয়ন সম্মুখে। তাই এ লেখা…
শুন্য শুন্যালয়
শুভ জন্মদিন আপু। কতো সুন্দর করে প্রকাশ করলেন মায়ের অনুভূতিকে। নানা কস্টে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে যায়, শুধু সন্তানের কথা ভেবেই সব কস্ট মেনে নেয় মা। সত্যিই তো কেমন করে ভুলে গিয়ে আবারো জন্ম দেয় আরেকটি শিশু!!! কারন সে মা। অনেক ভালো থাকুন আপু, ভালো থাকুন সবসময়।
রিমি রুম্মান
আমার সরকারী চাকুরীজীবী মা সারাদিনই কিছু না কিছু পড়তেন। খবরের কাগজ কিংবা বই। দুঃখের বিষয় হল আমি লেখালেখি শুরু করে ২০১২ তে মায়ের মৃত্যুর পর। আমার অনুভূতিগুলো দেখতে পেলে খুশি হতো নিশ্চয়ই
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
নিজেদের স্বার্থে মায়েদের এমন কষ্ট এক সময় ভূলে যাই।সুন্দর অনুভূতি। -{@
রিমি রুম্মান
ঠিক বলেছেন। ভাল থাকুন। শুভকামনা।
প্রহেলিকা
মা কে নিয়ে লেখা পড়তে গেলেও চোখ দিয়ে পানি চলে আসে। মা সবার জীবনে মা হয়েই থাকিন আজীবন।
রিমি রুম্মান
মা নেই যার, তার অনুভূতি শুধু আরেকজন মাতৃহীন-ই বুঝবে। ভাল থাকুন। অনেক ভাল।
লীলাবতী
আপনাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা আপু।মা এর এই কষ্টের তুলনা নেই।
রিমি রুম্মান
শুভকামনা রইলো…