ভারতের আম আদমি পার্টির আলোচিত নেতা জনাব অরবিন্দ কেজরিওয়াল দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই ৯ সচিবকে বদলী করার পাশাপাশি মাত্র ১০ দিনের মধ্যেই দিল্লির নাগরিক সমস্যাগুলির সমাধান খুঁজে বের করার নিশ্চয়তা দিয়েছেন।
পত্রিকায় এই খবর পড়ে, রাজভাই অবাক হয়ে বললেন, জনাব কেজরিওয়াল দেখি প্রথমদিনই ‘নায়ক’ ছবির নায়কের মত ছক্কা মেরে দিলেন?
আমি বললাম, কিভাবে?
রাজভাই বললেন, দেখেন, ভারতের মত একটা প্রায় আমলা শাসিত প্রশাসনে একযোগে এতজন ডাকসাইটে আমলাকে বদলী করতে গার্টস লাগে, আর সেটা জনাব কেজরিওয়াল প্রথমদিনই দেখাতে পেরেছেন। আমরা খাঁটি বাংলায় যাকে বলি, ‘বাসর রাতে বিড়াল মারা’-উনি সেটা মারতে পেরেছেন। সবচেয়ে বড় যে কাজটা উনি করতে পেরেছেন, সেটা হল, উনি ভারতের প্রশাসনযন্ত্রে একটা ম্যাসেজ দিতে সক্ষম হয়েছেন যে, ‘আগের মত আর চলবে না’! আর এটাই ওনাকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দিয়েছে যা তার কাজকে ভবিষ্যতে অনেক সহজ করে দেবে।
আমি বললাম, দেখা যাক! ভারতের আইন-কানুন গুলো এমনভাবে বিন্যস্ত যে, তাকে আমলাতন্ত্রের জালে জড়াতেই হবে। আর যদি সেটা উনি জড়াতে না চান তাহলে তাকে আইন ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হবে আঁচিরেই। আর পুরাতন রাজনৈতিক ঘাঘুরা এটার জন্যই ওনাকে সরকার গঠন করতে কিছুটা বাধ্য করেছেন।
রাজভাই বললেন, বুঝলাম না?
আমি বললাম, এই আম আদমি পার্টির বয়স কত? বড়জোর এক থেকে দেড় বছর? আর এই অল্প সময়ের মধ্যেই তারা এত জনপ্রিয় হয়ে গেল যে, দিল্লির মত একটা রাজ্যে তারা সরকার গঠনের মত সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল? কিছু সংখ্যক আপাত রাজনৈতিকভাবে অপরিচিত তরুণের দল মানুষের মনে জায়গা করে নিল এত তাড়াতাড়ি? যা তাদের দিল্লীর মসনদের মত একটা প্রেস্টিজিয়াস আসনে আসীন করে দিল?
না, এর মূলে আছে দিল্লী তথা ভারতের প্রচলিত দলগুলির প্রতি মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, বঞ্চনা আর আহাকার যা তাদের বিকল্প খুঁজতে বাধ্য করেছে। হ্যাঁ! তারা এইরকম বিকল্প অনেকদিন ধরেই খুঁজছিল কিন্তু তা তারা পাচ্ছিল না বলেই কখনো এইদল, কখনো ওইদলে ভোট দিয়ে বারবার সরকার পরিবর্তন করছিল আর প্রতিবার প্রতারিত হচ্ছিল। ঠিক, মানুষের এই দুর্বিষহ সময়েই আম আদমি দলের আবির্ভাব ও ভোটে জয়লাভ।
আপনি কি নেগেটিভ ভোটের কথা বলছেন? তাহলে কি জনাব কেজরিওয়াল ও তার দলের কোন ভাল কোন কাজ নেই যা মানুষের মনে আশা জাগিয়েছে? রাজভাই বললেন।
আমি বললাম আছে-
প্রথমতঃ জনাব অরবিন্দ কেজরিওয়াল, একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি যিনি ভারতের আমলাতন্ত্রের শক্তিশালী মন্ত্রণালয় আয়কর দফতরের একজন অফিসার ছিলেন। মানুষের জন্য কিছু করবেন বলেই তিনি তার নিশ্চিত জীবন ছেড়ে জনকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন, বেছে নিয়েছিলেন এক অনিশ্চিত ভবঘুরে ও প্রতিবাদী জীবন। যা দিল্লির মানুষ অনেকদিন ধরেই চাক্ষুষ করছিলেন আর অবচেতন মনে নিজেরদেরকে তার সাথে তুলনা করে তাকে নায়ক রূপে তাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান দিচ্ছিলেন। এছাড়াও তাকে মাঠে-ময়দানে জনাব আনা হাজারের সাথে অনশন করতে দেখে তার সততা আর কমিটমেন্টের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। মানুষ ভাবতে পেরেছেন যে, একে দিয়েই তাদের কাঙ্ক্ষিত সেই পরিবর্তনটা হবে। তাই প্রথম সুযোগেই তারা তাকে ভোট দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন অচলায়তন ভেঙ্গে পরিবর্তন আনার জন্য। আর সরকারে জয়েন করেই তার প্রথম আঘাতটাও হয়েছে একেবারে মোক্ষম, যেমনটা ভোটাররা চেয়েছিলেন।
দ্বিতীয়তঃ আম আদমি পার্টির সাথে যারা জড়িত বা যাদের নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল তারা অধিকাংশই বয়সে তরুণ আর প্রতিবাদী। তারা ভারত তথা দিল্লির বিভিন্ন নাগরিক ও সামাজিক আন্দোলনের সাথে অনেকদিন ধরেই জড়িত ছিলেন এবং তাদের সততার বিষয়ে নাগরিকরা একেবারেই নিশ্চিত। তাই তাদের সকলকে এক জায়গায় একটা দলে দেখে মানুষ আশান্বিত হয়েছে, ভেবেছে- এরাই পারবে!
তৃতীয়তঃ নির্বাচনে জনাব কেজরিওয়াল নিজের জন্য সেফ কোন আসন বেছে না নিয়ে টার্গেট করেছেন দিল্লীর কয়েকবারের মুখ্যমন্ত্রী, ভারতীয় কংগ্রেসের স্টার নেতা জনাব পৃথ্বীরাজ চৌহানকে। জনাব চৌহানকে পরাস্ত করেই তিনি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করবেন; তার এই মনোভাব দিল্লীর মানুষকে লাইভ গ্ল্যাডিয়েটর মুভি দেখার আনন্দ দিয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে ভোটারদের মননে এবং তাই তারা ভোট কেন্দ্রে যেয়ে যুদ্ধের আমেজে আম আদমিকে ভোট দিয়েছেন।
চতুর্থঃ ঝাড়ু, ভারতীয় সমাজে প্রতিবাদী মানুষের শেষ হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত বা দুর্বলের অস্ত্র হিসেবে চিহ্নিত। অপরদিকে মেয়েরা এটাকে তাদের মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে মনে করে। আবার নিম্নবর্ণের হিন্দুদের তথা হরিজনদের কাছে এটা তাদের রুটি রুজির প্রধান মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত। আর এটাকে মার্কা হিসেবে বেছে নেওয়াতে একদিকে যেমন তা মানুষের মনে দ্রুত দাগ কেটেছে, অপরদিকে প্রচলিত মার্কা গুলিকে ঝেটিয়ে বিদায় করার মানসে, মানুষ ঝাড়ু মার্কায় ছাপ মেরে যুদ্ধ জয়ের নির্মল আনন্দ উপভোগ করেছে।
এটা গেল একটা দিক। অপরদিকটা হল- কেন সবচেয়ে বেশী আসনে জয়লাভ করেও বিজেপি সরকার গঠন করার চেষ্টা করলো না? আবার কংগ্রেসই বা কেন আগাম সমর্থন দিয়ে আম আদমিকে সরকার গঠন করতে বাধ্য করলো?
এখানেই আছে রাজনীতির সেই পুড়নো প্যাঁচ আর হিসাব নিকাশঃ
১) বিজেপি যদিও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি কিন্তু তারা সবচেয়ে বেশী আসনে জয়লাভ করেছিল, তারপরেও কেন তারা সরকার গঠনে চেষ্টা করলো না? – এটা এক কথায় অবিশ্বাস্য কারণ ভারতীয় রাজনীতিতে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অন্যদলের সাংসদ কেনাবেচা নিত্যনৈমিত্তিক একটা ব্যাপার, ডালভাত। বিজেপি এটা করেনি কয়েকটা কারণে-
ক) সামনেই জাতীয় তথা লোকসভার নির্বাচন, এই সময়ে সাংসদ কেনা-বেচার চেষ্টা করে নিজেদের গায়ে দুর্নীতির কালি লাগাতে চায়নি। যেখানে তারা নরেন্দ্র মোদীকে ক্লিন ইমেজের অধিকারী হিসেবে দাঁড় করিয়ে আগামী দিনের ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছে।
খ) আম আদমি পার্টির দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান এবং তাতে আম জনতার সমর্থন দেখে বিজেপি প্রমাদ গুনেছে। তাই তারা এবার আর এমুখো হয়নি।
গ) “সরকার গঠনের জন্য পর্যাপ্ত আসন নেই”- বলে বিজেপি টেকনিক করে কেটে পরেছে। এক্ষেত্রে অবশ্য তারা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত আম আদমি পার্টিকে সরকার গঠনে চাপে ফেলে দুটি উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে চেয়েছে। আবার ‘সরকার গঠনে আম আদমির প্রতি কংগ্রেসের আগাম সমর্থন’- তাদেরকে এই সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্যও করেছে। তারা একঢিলে অনেক পাখি মারতে চেয়েছে। তার নমুনা কিছুটা নিম্নরূপ:
২) অপরদিকে ভারতীয় কংগ্রেস প্রমাদ গুনেছে, যদি আম আদমি’র প্রতি মানুষের আকর্ষণ একই রকম থাকে, তাহলে সামনের জাতীয় নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি অবধারিত। কারণ ক্ষমতাসীন দলের প্রতি মানুষের সবসময়ই একটা নেগেটিভ আচরণ থাকে, যারা খুঁজে ফেরে ভোট দানে বিকল্প একটা দল কিন্তু সেই ভোট আবার তারা বিজেপিকে দিবে না। এখন এই ভোট গুলো যদি আম আদমি পার্টি পেয়ে যায় তাহলে ভোট তিন ভাগ হয়ে যাবে, ফলাফল বিজেপি চামে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। তাই কংগ্রেস চেয়েছে আম আদমি পার্টিকে বিতর্কিত করে তুলতে, যাতে করে তাদের ক্লিন ইমেজটাকে নষ্ট করা যায়। আর এই কারণেই তাদের এই আগাম নিঃস্বার্থ সমর্থন, যা কখনো দেখা যায় না।
তাহলে কি আম আদমি ব্যর্থ হবে বলে আপনি মনে করেন? রাজভাই পাল্টা প্রশ্ন জুড়ে দিলো?
আম বললাম, না! কারণ আপনি যদি জনাব কেজরিওয়ালের চেহারাটা ভাল করে দেখে থাকেন? তাহলে দেখবেন তার চেহারায় একটা নেতৃত্ব সুলভ ভাব ফুটে আছে। আমি বলবো, সে লিডার হওয়ার জন্যই জন্মেছে। তাই এইরকম একজন মানুষের পক্ষে সবকিছুই করা সম্ভব। আর মানুষ যদি দেখে জনাব কেজরিওয়াল তাদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করছেন, তাহলে মানুষও তার জন্য ত্যাগ স্বীকার করবে।
তাই আমি মনে করি, তিনি যদি তার প্রতিশ্রুতির আংশিকও বাস্তবায়ন করতে পারেন তাহলেও দিল্লীর মানুষ তার প্রতি আস্থা রাখবেন আর তার ব্যর্থতা যাবে কংগ্রেস, বিজেপি আর আমলাতন্ত্রের ঘরে।
রাজভাই, নায়ক ছবির মত উনিও জিততে যাচ্ছেন। অনিল কাপুর জিতেছিলেন সেলুলয়েডে আর কেজরিওয়াল জিতবেন বাস্তবে, যা আসলেই অনেক অনেক কঠিন।
তাই বাজী রাখেন, জনাব অরবিন্দ কেজরিওয়াল হতে যাচ্ছেন, ভারতের সত্যিকারের নায়ক!!!
৩০/১২/২০১৩
একটি মন্তব্য
নীলকন্ঠ জয়
আমার মনে হয় না। দুই খানদানী বাড়ি নিয়ে অলরেডি বিতর্কিত হয়ে গেছেন। তবে ব্যতিক্রম একজনই বটে। -{@