নাজিয়ার ভোর সকালে ঘুম ভেঙ্গেছে । আকাশ তখনো আলোকিত হয়নি । সুবহে সাদিক কি হয়েছে ? আকাশ অন্ধকারের চাঁদরে ঢাকা । তিনি বুঝতে পারছেন না । তাঁর পিপাসা হচ্ছে । তিনি ভয়ের স্বপ্ন দেখেছেন , এখন কি করবেন বুঝতে পারছেন না ।
ফজরের আজান হচ্ছে , তিনি নামাজ পড়লেন । নামাজ পড়ার পর তিনি হৃদয়ে কিছুটা শান্তি পেলেন । তাঁর অস্থিরতা কিছুটা কমলো । তিনি স্বামীর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লেন । তাঁর ঘুম এলোনা । এক ধরনের ভয় হচ্ছে , বেলা বাড়ার সাথে সাথে তাঁর অস্থিরতা বাড়ছে ।
তাঁর স্বামীর ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে , বছর পনের আগে । সকাল ৬টার দিকে তিনি
হাঁটতে বের হন । হাঁটতে বের হবার আগে তাঁর স্বামী এক কাপ চা খান । তিনি চা বানিয়ে
স্বামীর সামনে বসলেন । অন্যদিন চা দিয়েই তিনি ঘুমুতে যান । তাঁর স্বামী আসিফ খান বাসায় তালা দিয়ে বের হন হাঁটতে ।
তারা একা থাকেন , তাদের একমাত্র ছেলে অন্তু ঢাকায় থাকে । তাঁর আজ আসার কথা । আসিফ সাহেব ছেলে আসা উপলক্ষে বাজার করবেন বলে বাজারের লিস্ট গতরাতেই রেডি করেছেন , তাঁর শার্টের পকেটে আছে । তাঁর এই ছেলেকে তিনি মোটেও প্রশ্রয় দেননা কিন্তু তাঁর স্ত্রী নাজিয়া চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি করেন । ছেলের জন্য তিনি সবসময় পোলাও রান্না করেন । পোলাও তাঁর ছেলে পছন্দ করে , সাথে মুরগি ভুনা এবং বেশী করে সালাদ লাগে।
এই ছেলেকে নার্সারির প্রথম দিন থেকে কলেজের শেষ দিন পর্যন্ত নাজিয়া এক মুহূর্তেও একা ছাড়েননি । তিনি অনেকবার বলেছেন , ছেলে বড় হয়েছে তাঁর কিছু প্রাইভেসি দরকার । নাজিয়া ছেলেকে তবুও চোখের সামনে থেকে আড়াল করেননি ।
এইচএসসিতে তাঁর ছেলে বোর্ডে দ্বিতীয় হয়ে রেজাল্ট করলো । আসিফ সাহেব সবাইকে ডেকে ভালো করে খাওয়ালেন , মিলাদ মাহফিল দিলেন খুশিতে । সবাইকে বললেন – আমার ছেলে যেন আশরাফুল মাখলুকাত হতে পারে সেই দোয়া করবেন । সে যেন সারাজীবন সৎ থাকে । বাপের এই বদগুন যেন ছেলের থাকে সবাই এই দোয়া করবেন ।
আমার আর কিছু চাওয়া নেই ।
ছেলেমেয়েদের রেজাল্ট শুনে মায়েরাই বেশী খুশি হয় , এক্ষেত্রে নাজিয়া হলেননা । কারণ তাঁর ছেলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছে । নাজিয়া জানে তাঁর ছেলে সেখানে পড়তে পারবে । এই ছেলে ছোটবেলা থেকে রেজাল্ট দিয়ে তাঁকে চমৎকৃত করে আসছে , তিনি খুশি হয়েছেন সব বার । এবার হতে পারছেন না । ছেলে আড়ালে বা দূরে চলে যাবে তাঁর আঁচল থেকে । এই কারনেই ।
গেঞ্জির বদলে শার্ট পরে হাঁটতে বের হবেন তিনি । স্ত্রীর অস্থিরতা তাঁর চোখে পড়লো ।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন –
কি হয়েছে নাজিয়া ?
-কিছুনা ।
কিছু একটা তো হয়েছে , ফজরের থেকে তুমি অস্থির অবস্থায় আছো । এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারছনা । বিছানায় শুধু এদিক ওদিক করেছো , তাঁর জন্য আমার ঘুম আগেই ভেঙ্গে গেলো ।
-মানুষের সব দিনতো এক যায়না । ঘুম আসছিল না বলে এদিক ওদিক করেছি ।
তুমি সত্যি বলছো না । চা বানিয়ে দিলে কিন্তু চিনি দিয়ে দিলে , তুমি গত পনের বছরেও এই ভুল একবারও করোনি । আজ করলে । কি হয়েছে ? সত্যি করে বলতো ।
– একটা স্বপ্ন দেখেছি ।
স্বপ্নতো সপ্নই , তা নিয়ে এতো চিন্তিত হবার কিছু নেই । কি দেখেছো তুমি ?
– দেখেছি বাসে করে অন্তু আসছে , হঠাৎ গাড়ি উল্টে গেলো , কারো কিছু হলনা , শুধু আমার অন্তু মারা গেলো ।
নাজিয়া তুমি অন্তুকে নিয়ে বেশ চিন্তা করেছো বলে এমন স্বপ্ন দেখেছো । একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমুতে যাও । আমি তালা লাগিয়ে বাইরে যাচ্ছি ।
নাজিয়া কখনো মুখের উপর কথা বলে না , এবারো বললেন না । সে ঘুমুতে চলে গেলো ।
আসিফ সাহেব চিন্তিত বোধ করলেন । তাঁর স্ত্রী সপ্নে যা দেখেন তাই হয় । তাঁর নিজের জীবনেও যতবার বিপদ এসেছে তাঁর মা সপ্নে আগেই জেনেছেন । অন্তুর মাকেও কি স্রষ্টা কোনভাবে প্রস্তুত করে রেখেছেন ?
আসিফ সাহেব হাঁটতে বের হলেন , বাজারে গেলেন । সকাল নয়টার দিকে বাড়ির সামনে এসে জটলা দেখলেন । তিনি জটলার ভেতরে ঢুকে দেখলেন সাদা কাপড়ে একটা মানুষকে
জড়িয়ে রাখা হয়েছে । বাড়ির দরজায় নাজিয়াকে দেখা যাচ্ছে । তাঁর চোখ ফোলা ফোলা । শাড়ি এলোমেলো । চারিদিক থেকে কোরআনের লাইন উচ্চারণ হচ্ছে , কালেমা পাঠ হচ্ছে । দরুদ হচ্ছে । সাদা কাপড়ের কাছে গিয়ে দেখলেন মানুষটি তাঁর ছেলে অন্তু ।
অন্তুর এক বন্ধু এসেছে । সে জানাল গতরাতে হলের খাবারে এতো গন্ধ ছিল আমরা দুজন কিছু খেতে পারিনি । অন্তু হঠাৎ রাতের বেলা আমাকে বলল , কি খেতে ইচ্ছে করছে ? আমি বললাম পোলাও । সে বলল আমাকে কাপড় পরে রেডি হতে । তাঁরপর আমরা বাসে উঠলাম । সে আমাকে বলল তোকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি । আমার মার হাতের পোলাও খেলে মনে হবে জীবনে এই পোলাও খাওয়ার জন্যই বেঁচে ছিলি ।
স্বর্গের খাবার আমার মার হাতের কিছুই নয় ।
গাড়িতে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম । ঘুমের ভেতর প্রচণ্ড ব্যথায় চোখ মেলে দেখি বাস উল্টে আছে । অন্তুর কোন জ্ঞান নেই । হাসপাতালে নেয়া হলে ডাক্তার বলেন মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা পাওয়ার কারনে তাঁর মৃত্যু হয়েছে ।
অন্তুকে যথাসময় কবর দেয়া হয়েছে । আসিফ সাহেব ভেঙ্গে পড়েননি । নাজিয়ার অবস্থা বোঝা যাচ্ছেনা । তিনি নাজিয়াকে ডেকে বললেন – আল্লাহ আমাদের একটা পরীক্ষা নিলেন , কিছু মনে করোনা ।
নাজিয়া বললেন – আমি জানি । আমি কিছু মনে করিনি । আমি তোমার উপর খুব রাগ করেছি এবং আমি তোমাকে জীবনেও ক্ষমা করবোনা ।
তোমার ছেলেকে বাইরে পড়তে আমি পাঠিয়েছি , এই জন্য আমি ক্ষমা চাইছি নাজিয়া ।
আমি অন্যকারনে ক্ষমা করবোনা । আমার ছেলেকে আমি গরমকালেও গরমপানি দিয়ে গোসল করিয়েছি । তাঁর ছোটবেলা থেকেই ঠাণ্ডার সমস্যা আছে এটা তুমি জানো না ? কি মনে করে তাঁকে তাঁর শেষ গোসল ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করিয়েছ ? আমার ছেলে মারা গেছে বলে তাঁর কোন ইচ্ছে থাকবেনা ?
আসিফ সাহেব নির্বাক চোখে ও মুখে তাকিয়ে আছেন । তাঁর স্ত্রীর জবাব দেয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই । তিনি বিড়বিড় করে বলছেন – আমার ভুল হয়ে গেছে , আমার ভুল হয়ে গেছে , আমার ভুল হয়ে গেছে ।
প্রিন্স মাহমুদ
১০/১১/২০১৩
এই লেখা ক্যামন হয়েছে জানিনা । কারণ শোকের ছায়া আমি তুলে আনতে পারিনি । আসলে আমি একজন মাকে কাদাতে চাইনি ।
আধাঘণ্টা আগের এই লেখা আনাড়ি হলেও আমার ভীষণ ভালো লেগেছে লিখে ।
উৎসর্গ –
বীথি শবনম । অনুপম চক্রবর্তী , শাওন রহমান এবং নিতুকে ।
( আমার ধারনা এই চারজন মানুষ আমাকে খানিকটা হলেও পছন্দ করে । কতটুকু করে জানিনা । আমি তাদের পছন্দ করি । কিন্তু প্রকাশ করতে পারিনা )
১২টি মন্তব্য
আফ্রি আয়েশা
মা
প্রিন্স মাহমুদ
🙂
আদিব আদ্নান
আসলে আপনি আপনার ভাবটি সাবলীল ভাবে প্রকাশ করেননি , আবার এমন ও হতে পরে
করতে চান নি ।
অদ্ভুত উৎসর্গ ।
প্রিন্স মাহমুদ
হতে পারে
খসড়া
ভাল লিখেছেন। লিখুন আরও বেশী বেশী দেখবেন ছোটখাট অনেক কিছু সুন্দর হয়ে যাবে। লেখার বিষয়বস্তু ভাল, ভোর, সকাল,সুবহেসাদিক একসময় নয়। একটু খেয়াল করুন।, লেখা ঝরঝরে ও পরিস্কার। বর্ননা সাবলিল। বেশ ভাল। 🙂
প্রিন্স মাহমুদ
আমি সুবহে সাদিক বলিনি , এটা নাজিয়ার চিন্তাতে এনেছি । ধন্যবাদ
জিসান শা ইকরাম
মনটাই খারাপ হয়ে গেলো —
লেখনির গুনে পাঠক আটকে থাকে লেখায়
এটি তেমন এক লেখা ।
ভালো হয়েছে —
প্রিন্স মাহমুদ
ধন্যবাদ ছাড়া কিছু বলার নেই
ফরহাদ ফিদা হুসেইন
এক কথায় অসাধারণ! গল্প কবিতায় মিলিয়ে প্রিন্স ভাইয়ের বেস্টওয়ান।।
প্রিন্স মাহমুদ
অনেক ধন্যবাদ
তওসীফ সাদাত
অবশ্যই বেশ ভাল হয়েছে !!
প্রিন্স মাহমুদ
পড়ার জন্য ধন্যবাদ