ছোট গল্প # সুপ্ত ভালবাসা

আবু জাকারিয়া ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, বুধবার, ০৬:৪১:২৭পূর্বাহ্ন গল্প, সাহিত্য ১২ মন্তব্য

হ্যা, আমার মনে পড়ছে। সকাল ৬ টায় উঠে পড়তে শুরু করেছিলাম, দুপুর ২ টার পর মাত্র ১ ঘন্টা বিরোতি নিয়েছি। তারপর থেকে এক টানা পড়ে চলছি। হাতে ঘড়ি ছিল না, বা দেয়াল ঘড়িটার দিকেও তাকাইনি, তবু আমি আন্দাজ করতে পারছি।
যাই হোক, কালকে সকাল ১০ টায় আমার এনাটমি পরীক্ষা। খুব বেশি পড়াশুনা করতে হচ্ছে। অবশ্য অন্য সাবকেক্ট হলে এত পড়তাম না। কারন আমি এনাটমিতে তেমন ভাল ছাত্র না। তাই একটু বেশি পড়তে হচ্ছে।
আমার সামনের প্লাস্টিকের তৈরি নরকংকালটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ওর বিশ্রি হাসিটা মাঝে মাঝে আমার কাছে বিরক্ত লাগে, সেই সাথে ভয়ও। মেডিকেলের স্টুডেন্ট হয়ে এসব বিষয়ে ভয় পাওয়া মানায় না, তাই আমি ওর সামনে নিজেকে সাহসী বলে প্রমান করার চেষ্টা করি। ওর অংগ প্রতংগুলো ছুয়ে দেখি, নামগুলো মুখস্ত করতে থাকি। সব মেডিকেলের স্টুডেন্টরা যা করে আমিও তাই করি।
এবার আমি আর আন্দাজ করলাম না। সরাসরি ঘড়িটা দেখেনিলাম। ৫.২০ বাজে। অনেক পড়েছি, এখন মাথাটা ঠেলা গাড়ির চাকার মত ঘুরছে।
আমি জামাকাপড় পরে রেডি হচ্ছি বাইরে বের হব বলে। রুমমেট ফয়সাল বলল, দোস্ত আমারও মাথা ঘুরছে, আমিও বাইরে ঘুরতে যাব।
আমি ফয়সালকে এডিয়ে চলতে চাইলাম। কারন, ও সাথে থাকলে আমার মাথা ঘোরা কমবেনা, বরং হু হু করে মটর সাইকেলের চাকার গতির মত বাড়বে। প্রচুর কথা বলার অভ্যাস আছে ওর, তাই অনেকে ওর প্রতি বিরক্ত হয়, আমিও মাঝে মাঝে। আমি ওকে সরাসরি না বলে দিতে চেয়েছিল কিন্তু তার দরকার পরেনি। বাইরে বের হয়েই ও অন্য পথে হাটতে শুরু করল। কাছাকাছি এক আত্মীয়ের বাসা আছে ওর, সম্ভবত সেখানে যাবে।
আমার এখানে কোন আত্মীয় সজন নেই। তবে শুনেছিলাম, এই শহরে অনেক বছর ধরে দুঃসম্পর্কিত এক মামী থাকেন। আমি তাকে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছেনা। হয়ত দেখেছি, কিন্তু মনে পড়ছেনা।
মাথাটা হালকা করার জন্য আশে পাশের গলিগুলোতে ঘুড়ে বেড়াচ্ছি। আর একটু ঠান্ডা বাতাশ পেলেই টেনে ফুসফুসের মধ্যে নেয়ার চেষ্টা করছি। দুরে ছোট একটা মাঠ চোখে পড়ল আমার। মাঠে রয়েছে সবুজ ঘাস আর উপরে খোলা আকাশ। একটুকরা ঘন সবুজ ঘাসের উপর বসে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলাম। তারপর কিছুক্ষন এলোমেলো এদিক ওদিকে হাটলাম। বাসায় দিকে হাটা শুরু করব, এমন সময় কে যেন আমার নাম ধরে ডাকল।
পিছনে তাকিয়ে দেখি ছোট্ট একটা ওশুধের দোকান। দোকানের মধ্যে এক বোরকা পরা মহিলা বসে আছে। মহিলাটি আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকছেন।
আমি কাছে গেলাম।
“তুমি আমাকে চিনতে পারছ?” মহিলাটি বললেন।
এই শহরে আমি চিনতে পারব, এমন কোন মহিলা থাকতে পারে, অন্তত আমার জানা নেই। তাছাড়া মহিলাটি নিজে বোরকা পরে আছেন। বোরকার উপর থেকে কোন মানুষকে চিনতে পারা সহজ নয়। অবশ্য খুব পরিচিত হলে আলাদা কথা।
আমি মাথা নেড়ে জবাব দিলাম, না।
মহিলাটি তখন বললেন, আমি সম্পর্কে তোমার এক মামী হই।
আমার এবার বুঝতে অসুবিধা হল না এই সেই দুঃসম্পর্কিত মামী, যার কথা অনেক শুনেছি আমি। আমি এবার স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে শুরু করলাম, কেমন আছেন মামী?
মামি হাসলেন, বোরকার উপর থেকে হাসিটা স্পস্ট বোঝা যায়, বললেন, ভাল আছি বাবা, তুমি কেমন আছো?
অনেক্ষন ধরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হল মামীর সাথে। মামী হাসছেন আর কথা বলছেন। ভালই লাগছিল কথা বলতে।
আমি চলে আসব, এমন সময় বললাম, আচ্ছা মামী, মামা কেমন আছে?
প্রশ্নটা করার সাথে সাথে তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। ভাল বা খারাপ বলেছিলেন কিনা, মনে পড়ছে না। বললেও এত আস্তে বলেছিলেন, যে আমি তা শুনতে পাইনি।
আমি চেয়ার ধরে দাড়িয়েছিলাম। মামি হাত দিয়ে ইশারা করে বললেন, বস।
আমি আবার চেয়ারে বসলাম। কিছুক্ষন মামী চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, তোমার মামা ভালই আছে।
আমি বললাম, মামা এখন কোথায় আছে?
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই বললেন, ভাল থাকবেনা কেন, নতুন নতুন বউ পেলেতো ভাল থাকারই কথা।
আমি মামির কথার কিছুই বুঝতে পারছিলাম মা। ভাবছিলাম, মামী এসব কি বলছে? অবশ্য পরে আমার কাছে সব কিছু পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল। মামা এ পর্যন্ত মোট ছ’টা বিয়ে করেছেন। তিনটেই তালাক দিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানের আছে তিনটা। এই মামী ছিলেন মামার প্রথম স্ত্রী। তারও তালাকের খাতায় নাম। মামীর তিন ছেলেমেয়ে। সবগুলোকে সে নিজের খরচে মানুষ করেছে।
তার একমাত্র অবলম্বন এই ছোট্ট ওশুধের দোকানটা।
একজন রোগী আসলেন ব্লাড প্রেসার মাপাতে। মামী ব্লাড প্রেসার মেপে দিলেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। তারপর লোকটি কিছু ওশুধ পত্র কিনলেন মামীর দোকান থেকে এবং চলে গেলেন। আমি প্রায় এক ঘন্টা ধরে বসে আছি, আর এটাই আমার দেখা মামীর দোকানের প্রথম কাস্টোমার। কাস্টোমার লোকটা ব্লাড প্রেসার মাপা বাবদ পাচ টাকা বেশি দিয়েছিলেন মামীকে, আমি খেয়াল করেছিলাম।
মামী আমার দিকে ফিরে তাকালেন, বললেন, আমার ভালবাসায়তো কোন খাদ ছিলনা। এমনকি এখনও নেই, তাহলে আমার দোষ কি ছিল?
আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না, তাই আরেকদিক তাকিয়েছিলাম।
মামী বলল, আমাকে যদি ভাল না লাগে, তবে বিয়ে করেছিল কেন?
মামীর কথা শুনে আমার কিছটা লজ্জা লাগছিল। তার বড় ছেলে আমার থেকেও বড়। সে তুলনায় সে আমার মায়ের সমকক্ষ। যদিও আমার অসস্থি লাগছিল, তারপরেও এক প্রকার বাধ্য হয়ে তার কথাগুলো শুনছিলাম। কালকে সকাল ১০ টায় আমার এনাটমি পরিক্ষা, বার বার মনে পড়ছিল।
মামি এবার বললেন, প্রেমের(ভালবাসার) প্রস্তাবটা সেই প্রথম দিয়েছিল, তারপর বিয়ের প্রস্তাব। আমি তাকে সত্যি সত্যিই ভাল বেসেছিলাম আর বিয়েও করেছিলাম। এমনকি এখনও ভালবাসি।
আরেকজন কাস্টোমার আসলেন দোকানে। ইনি আমার দেখা মামীর দোকানের দ্বিতীয় কাস্টমার। মামী ওশুধ বিক্রি করাতে ব্যস্ত আছে। আমি এই শুযোগটা গ্রহন করতে চাইলাম, বললাম, মামী আমি তাহলে যাই এখন?
মামি আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, আরেকটু সময় বস। মামী ওশুধ বিক্রির কাজ শেষ করে আমার দিকে আবার ঘুরে বসলেন। একটা ট্রেতে করে কনডেন্স মিল্কের দুই কাপ চা আসল। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে চায়ের বাস্প উড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখছিলাম।
মামী ইশারা করে বললেন, নাও চা খাও।
আমি চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। গরম চায়ের শীতল অনুভুতি আমার খাদ্যনালী ছুয়ে পাকস্থালীতে প্রবেশ করল। যদিও এ বিষয়টা এনাটমির না, তারপরেও বার বার এনাটমির কথা মনে পড়ছে।
মামি বলল, তোমার মামা হয়ত আমাকে ভাল না বাসতে পারে, আমি তাকে সারাজীবন ভালবেসে যাব। সব সময় তার মঙল কামনা করব, সে যেন শুখে থাকে।
মামার বিষয় নিয়ে অনেক কথা বলল মামী। এক পর্যায়ে থেমেগিয়ে কি যেন চিন্তা করছিল। আমি এই সুযোগটা গ্রহন করলাম, বললাম, মামী, আমি এখন যাই?
মামী বলল, যাবে কেন, থাক। কয়েকদিন বেড়াও আমাদের বাসায়। কাছেই আমাদের বাসা।
অনুমান করে বুঝতে পারলাম, মামীর বাসাটা দোকান থেকে খুব কাছে হবে, যেখানে সে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ভাড়া থাকে।
আমি বললাম, আজ না মামী, অন্য কোন দিন। কাল আমার পরীক্ষা আছে।
পরীক্ষার কথা শুনে কিছুটা অবাক হল মামী।
বললেন, তোমার পরীক্ষা, আগে বলবানা? শুধু শুধু বসিয়ে রেখেছি তোমাকে।
আমি মামীকে বিদায় জানিয়ে যখন দোকান থেকে বের হলাম, তখন রাত ঠিক ন’টা বাজে। আন্দাজ নয়, মামীর দোকানে একটা দেয়াল ঘড়ি আছে, তাতে দেখেছি। কালকে সকাল ১০ টায় আমার এনাটমি পরীক্ষা, অনেক কিছু পড়তে হবে। কখন পড়ব বুঝতে পারছিনা। মামীর দোকান থেকে বেড়িয়ে, বাসার উদ্দেশ্যে খুব দ্রুত হাটতে লাগলাম।

★);)
*”

১০৩৮জন ১০৩৫জন
0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ