ছোটবেলায় মেয়েটি এতোটাই পাগলাটে ছিলো যে, পরপর তিন বোনের ছোটবোনটিকে তার হাত থেকে নিরাপদে রাখতে মা রান্না করার সময় ছোট্ট মেয়েটিকে ঘুম পাড়িয়ে ছিটকিনি দিয়ে রান্না করতে যেতো। কখনোবা যদি ভুলবশতঃ ছিটকিনি না দেয়া হতো আর ছোট্ট বোনটিকে মেয়েটি নাগালে পেতো আদরে আদরে বোনের সারা শরীর খামছি দিয়ে ভরিয়ে তুলতো। দস্যি মেয়েটিকে তাই তাঁর মা প্রায়ই বাড়িওয়ালা মেয়েদের সাথে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দিতো্। সে সময়ে স্কূল ছিলো কিনা জানি না, তবে কল্পনার ছবিতে মনে হয় ওটি মাদ্রাসাই ছিলো। কতোই বা বয়স ছিলো মেয়েটির! হবে হয়তো চার কি সাড়ে চার। এমনি করে মাদ্রাসায় যাওয়া-আসা করতে করতে একদিন সে ঘটিয়ে বসে এক মহাকান্ড। স্মৃতির মনিকোঠায় যতোটুকুন মনে পড়ে, মাদ্রাসার শুরুটা ছিলো মাঠে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে-
-দুই একে দুই
দুই দুগুনে চার
তিন দুগুনে ছয়- এমন নামতা পাঠ।
শুরুতেই একটা ক্লাস ছিলো আরবী। একদিন ক্লাস শুরু হবার আগেই কোন এক সহপাঠির সাথে মেয়েটির ঝগড়া বেধে যায়। সে কি মারামারি দুজনের! মারামারিতে সে জিতেছে কিনা তা মনে পড়ছে না। ক্লাসে স্যার চলে আসার সময় হয়েছে। তাই সবাই যার যার আসনে বসে পড়লো। ওরাও স্যারকে আসতে দেখে মারামারি স্টপ দিয়ে আসনে বসলো। ক্লাসে স্যার ঢুকবেন জেনেও মেয়েটি সমানে কাঁদছে। স্যার ক্লাসে আসলেন। কান্না শুনতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন
”এই যে মেয়ে, তোমার কি হয়েছে? কাঁদছো কেনো?”
মেয়েটি জবাব দেয় ”আমরারে হে মারছে।”
স্যার জিজ্ঞেস করলেন ”তোমারে আর কারে?”
মেয়েটি আবারও বলে ”আমরারে।”
এবার স্যার কাছে এসে হাতে থাকা বেত দিয়ে মেয়েটির শরীরকে দেখিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলেন ”তোমারে আর কারে মারছে?”
মেয়েটি এবারও বললো ”আমরারে।”
মাষ্টারমশাই এবার আরেকটু এগিয়ে মেয়েটির শরীরে নিজহাত রেখে বললেন ”তোমারে আর কারে?”
তবুও মেয়েটি বলে চলে ”আমরারে।”
মহা ধৈর্য্যের সাথে মাষ্টারমশাই আরেকবারও মেয়েটিকে ছুঁয়ে বললেন ”তোমারে” এবং হাত নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন “আর কারে?”
মেয়েটি বুঝতে পারছে মাষ্টারমশাই কিছুতেই তার কথা বুঝতে পারছেন না। তাই সে নিজের বুকে হাত রেখে খুব দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করলো ”আমরারে”
এবার মাষ্টারমশাইর ধৈর্য্যের বাধঁ ভেঙ্গে গেছে। তিনি মেয়েটিকে বললেন হাত পাতো। মেয়েটি বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে মাষ্টারমশাইর দিকে তাকিয়ে। তিনি আবারও একটু উচ্চস্বরে বললেন হাত পাতো। অবাক বিস্ময়ে ছোট্ট মেয়েটি হাতটা বাড়িয়ে দেয়। হাতে এসে পড়ে শপাং শপাং দুখানি বেতের বারি। এবার সে সত্যিই আঘাত পেয়ে কান্না জুড়ে দেয়।
খানিক কান্নার পর মাষ্টারমশাই মেয়েটিকে কাছে ডেকে নিয়ে ‘আমারে’ আর ’আমরারে’ এই দুই শব্দের তফাৎ বুঝিয়ে দেন। তারপরই মেয়েটি বুঝতে পারে ’আমি’ আর ’আমরা’ এই দুই শব্দের প্রয়োগ কখন কিভাবে করতে হয়।
ছোট্টবেলায় আমরা মনে হয় অনেকেই এই সমস্যা পার করে এসেছি।
আরও একদিন আসবো মেয়েটির দস্যিপণার আরে একটি গল্প নিয়ে….
২৪টি মন্তব্য
অলিভার
আমারও ছোটবেলাতে উচ্চারণগত কিছু সমস্যা ছিল, তবে সেটা নিয়ে পরিবারের সবাই খুব মজা করতো।
দস্যিপনার আরও গল্পের অপেক্ষায় রইলাম।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ, এমন সমস্যা সব বাবুদেরই থাকে।
খেয়ালী মেয়ে
শব্দের পার্থক্য এভাবে বোঝায় জানা ছিলো না ;?
ছোট্টমেয়েটির দস্যিপনার অন্য গল্পটি পড়ার অপেক্ষায় রইলাম…
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হাহাহাহা। হুম, ’আমরা’ বলতেই সে ‘আমি’ কে বুঝাতো।
সীমান্ত উন্মাদ
আমি ছোট বেলায় খুব বেশি দুষ্টামী করিনি তবে উন্মাদীয় কর্মকাণ্ডের জন্য খাওয়া মাইরের দাগ এখনো পিঠে দুই চারটা থাকলেও থাকতে পারে। তয় চুরি করে স্কুলের সাইন্স ল্যাবরেটরিতে ঢুকে বিভিন্ন ক্যামিকাল আর এসিড মিশ্রনের এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে জার ফেটে হাতের এলবোতে পুড়ে যাওয়া দাগটা এখনো প্রমান দেয় আমি দুষ্ট ছিলাম না। খিক খিক। আপনার গল্পটা পুরুনো দিনে নিয়ে গেলো।
শুভকামনা জানিবেন নিরন্তর।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হাহাহা। ’শান্ত’ এর সংজ্ঞা তাহলে পাল্টাতে হবে।
স্বপ্ন নীলা
ওরে বাবা !! আমি শপাং শপাং বেতের বাড়ির কথা শুনলেই এখনো ভয় পাই, আগে ছাত্র ছাত্রীদেরকে যে কি হারে পেটানো হতো —
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হ্যাঁ, তখনকার সময় পেটানোর ধরন বড় অস্বাভাবিক ছিলো।
অনিকেত নন্দিনী
মাষ্টার মশাইয়ের উপর বেজায় রাগ লাগছে। দুই শব্দের মাঝের তফাত এভাবে বোঝাতে হয় বুঝি?
আমি যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়েছি সেখানে এমন এক মহাশয় ছিলেন। স্পষ্ট মনে আছে ক্লাস সেভেনে পড়ি সময় পাশের রুমে ক্লাস সিক্সের ক্লাস হতো। ক্লাস এইটের কয়েকজন ছেলেমেয়ে ইংরেজি গ্র্যামারে ভুল করাতে স্যার তাদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে বেত মারছিলেন। ছাত্র ছাত্রীদের বেত মারার সময় স্যারের মাথায় হয়তো খুন চেপে যেতো। সেদিনও বেত মারতে মারতে স্যারের হুঁশজ্ঞান লোপ পেয়ে গেলো। মুখে “হুঁ হুঁ’ শব্দ করতে করতে তিনি খুব করে বেত মারছিলেন সময় হাত থেকে বেত ফসকে পার্টিশনের উপর দিয়ে ক্লাস সিক্সের রুমে গিয়ে এক ছেলের কপালে লেগে কপাল ফেটে গেলো।
এরপর সেই স্যারকে বরখাস্ত করা হয়েছিলো।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
এখন বুঝি, মাষ্টার মশাই বেত প্রয়োগ না করেও সেদিন তফাতটা বুঝিয়ে বলতে পারতেন। তবে এটি সত্য যে, সেদিন মনে রাখার মতো সে ঘটনা না ঘটলে, আজ তা এভাবে একটা গল্প হয়ে উঠে আসতো না।
নুসরাত মৌরিন
আপু দস্যি মেয়েটা কি আপনি ছিলেন?
মাস্টার মশায়টা বেজায় পাজি,এভাবে কেউ মারে?
আরো গল্প শোনান ছোট্ট মেয়েটির
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হুম, তখনকার বেশিরভাগ মাষ্টারমশাই এমন থাকলেও তাঁদের প্রতি ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা কাজ করতো, যা এখনকার সময়ে দেখা যায় না।
আর দস্যি মেয়েটা তো গল্পের চরিত্র।
জিসান শা ইকরাম
মাষ্টার মশাই মেয়েটিকে বেত না মেরে বুঝিয়ে বলতে পারতেন।
অবশ্য মেয়েটি তা বুঝতে চাইত কিনা কে জানে?
‘মাইরের উপ্রে ঔষধ নাই’ -এটিও হয়ত সে তখন বুঝেছিলো।
পিচ্চি মেয়েটির কথা আরো জানতে চাই।
লেখা ভালো লেগেছে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হাহাহা। ‘মাইরের উপ্রে ঔষধ নাই’ -এটি সে তখন বেশ ভালোই বুঝেছিলো, এমন বুঝেছিলো যে, পুরো ঘটনা এখনও সে ভুলে নাই।
লীলাবতী
পাগলাটে সেই ছোট্ট মেয়েটি আমাদের এখানে আছে নাকি?এখানে এসে সে নিশ্চিন্তে পাগলামী করুম,কান্নাকাটি করে আমরারে বলুক শতবার,আমরা কেউ তাঁকে মারবো না বেত দিয়ে।ভালোবাসবো 🙂
লেখুন আপু আরো।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হাহাহা। আমার ভালোবাসার সোনেলা।
মেহেরী তাজ
উচ্চারনের ভুল মনে পরেছে না তেমন তবে আমার এক ফ্রেন্ড “একই” কে একঐ বলতো মনে আছে।
পরের গল্পটা পড়ার অপেক্ষই রইলাম।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হুম, উচ্চারনজনিত সমস্যা ছোটবেলায় প্রায় বাচ্চারই থাকে। আমার এক খালাতবোন ’কম-বেশি’ কে উল্টো করে বুঝতো। আমি তার এই উল্টো বুঝাকে সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করে বেশি নিয়ে প্রায়ই তাকে কাঁদাতাম। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতাম সে-ই তো কম চেয়েছে। বলেছে ‘আমাকে কম দিতে হবে কিন্তু’।
রিমি রুম্মান
ছোটবেলায় উচ্চারণ গত ত্রুটির জন্য আরো বেশি আদুরে ছিলাম … ভালো লাগলো লেখাটি
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ।
আশা জাগানিয়া
ভালো লেগেছে লেখাটি,মেয়েটির কথা আরো জানতে চাই 🙂
মারজানা ফেরদৌস রুবা
জানবেন। ধীরে, অপেক্ষা করুন।
ছাইরাছ হেলাল
আপনি যাই বলুন না কেন, মাষ্টার সাহেবের কাজকে সমর্থন করতে পারি না।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হ্যাঁ, ঠিক সমর্থন করা যায় না। তবে এটাও সত্য, অই ঘটনা না ঘটলে আজকের এই বিবরনটি এখানে আসতো না, হাহাহা।