ছেলে বেলার দূরন্তপণা

মনির হোসেন মমি ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬, সোমবার, ০৯:১৩:৪৮অপরাহ্ন গল্প ১৯ মন্তব্য

শহুরে দালান কোটার এক পাশে নিন্মাঞ্চলে বাশের চটি আর খেজুর গাছের পাতায় মুড়ানো বাবুই পাখিদের মতো তৈরী করা এক একটি ঘর তার পাশ দিয়ে imagesবয়ে গেছে দূূষিত জলের খাল।দূর থেকে বুঝা যায় ঘর গুলো যেন ছোট ছোট ছাউনি নাওঁ।অভিজাত ঢাকা শহরে একটি নামকরা বস্তি।এই বস্তিতে বাস করতেন সহায় সম্ভল কর্মহীন গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলো।তাদের অনের মধ্যে কখনো ঠেলা গাড়ী চালক কখনো বা দিন মজুরের কাজ করতেন অশিক্ষিত আকবর আলী খান।নামে যষ থাকলেও বাস্তবে তার বিপরীত মুখী অবস্থা।তার স্ত্রী সুফিয়া বেগম নামে শিক্ষার ভাব থাকলেও বাস্তবে শিক্ষার আলো বলতে তার কিছুই ছিল না।দিন আনা দিন খাওয়া এই সংসারটিতে এক মেয়ে ও এক ছেলে,এদিক দিয়ে বলতে হবে তারা বুদ্ধিমান।
দশ বারো বছর সংসার জীবনে বড় মেয়েটি  গ্রামের বাড়ীর পুকুরে জলে ডুবে মারা গিয়েছিল।তার পর জন্ম হয় এক ছেলের।পদ্মার সর্বোনাশা ভাঙ্গনে বাড়ী ঘর বিলীন হওয়াতে বেচে থাকার তাগিদে শহরে চলে আসা হয়  তাদের।
অনেক শখ করে পুত্র সন্তানের নাম রেখেছিলেন  সোহাগ হয়তো আদর যত্ন একটু বেশীই করতেন বলে।সোহাগের মা সকালে বের হতেন বাসা বাড়ীর কাজের উদ্দ্যেশ্যে সে দিনও তাই করেছিলেন।সোহাগের বয়স পাচ ছয় বছর হবে।সে অত্যান্ত দূরান্তপনা ছিলো।এই এখানে খেলা করছে তো হঠাৎ উধাও তাই ভয়ে তার মা যখন কাজে যাবেন তখন তার সাথে পাশের  ঘরের এক আট দশ বছরের মেয়ের কাছে তাকে রেখে যেতেন।

খুব সকাল থেকেই একটি কাক তাদের খড়কুটো ঘরের চালে বসে কা কা করে ডাকছে।খুব বিরক্তি আসে সুফিয়া বেগমের কাজে যাওয়ার যাত্রার সময় যদি একন অলক্ষনি কাক ডাকে তবে মেজাজটা কার না চেতে…সুফিয়া রাগে সবগুলো দাতে দাত লাগিয়ে খট খট শব্দে মনে মনে ক্ষোভ প্রকাশ করতে করতে ছেলেকে মেয়েটির কাছে খেলতে দিয়ে বললেন।
-এই দুষ্টুমি করবি না কিন্তু…..
-আচ্ছা আমার জন্য রঙ্গিন বেলুন নিয়া আই বা….
-আইচ্ছা বাবা
ছেলেকে আগেই কপালে বড় করে কাজলের টিপ দিয়েছেন যাতে কারো নজর না লাগে এখন যাবার বেলায় ছেলের চোখে মুখে থুথু দিলেন তিন বার যাতে কোন বিপদে  না পড়েন।তার বাবা সেই ভোরে ফজরের আযানের পূর্বেই কামলা দিতে চলে গেছেন নিদিষ্ট স্থানে সেখানে কামলাদের ক্রয় বিক্রয়ের হাট বসে।

মা বাবা দুজনেই  অন্নের খোজে যার যার কর্মম স্থলে চলে যাবার পর পরই সোহাগ সামনে এগিয়ে দেখে নিল তার মা সত্যিই চলে গেছেেন কি না।নাহ্ সে চলে গেছেন।এইতো সুযোগ….
-এই চলো না একটু ঐদিকে যাই…ঐ যে রেল দেখে আসি।
-না না তোর মা জানলে বকবে,
-মাতো নেই এখন….
ইশারায় মন চলে যায় দূরন্তপনার দিকে।এ দিকে তার মা ফোনে জানতে পারেন ছেলে ড্রেনে পড়েছে…..।মায়ের মন বড় অস্থির,ছেলের এমন খারাপ খবর শুনে কাজ কি আর হাতে উঠে!পাগলের মতো সেই পাচ তলা থেকে কি ভাবে যে সে নীচে নেমে এলো তাও তার অজানা।কিন্তু পথতো শেষ হয় না তার কাছে কেবলি মনে হচ্ছে কখন সে তার গন্তব্যে পৌছবেন।
উৎসুক জনতার ভিড়,কেউ আবার খোলা ম্যানহোলের ভিতরে তাকিয়ে দেখছেন,ছেলেটিকে দেখা যায় কি না।সুফিয়া বেগম যখন মেয়েটির কাছে তার ছেলেকে রেখে গিয়েছিলেন তখন মেয়েটি তাকে নিয়ে ম্যান হোলের কাছে দীর্ঘক্ষণ খেলা করেছিলেন তাই অনেকের মতে ছেলেটি এই গর্তেই পড়েছে কেননা গর্তের নিকট মেয়েটি ঠায় দাড়িয়ে ছিল …এক ব্যাক্তি তাকে জিজ্ঞাসা করেন যখন তখন একটু সন্দেহ হয় মেয়েটি উপরে তবে পিচ্চি ছেলেটি কোথায়।
-কিরে তোর সাথে না পিচ্চি বাবু ছিল সে কই?
-হে তো ঐদিকে গেল।গর্তটি দেখিয়ে
-তুই কই আছিলি দেখলি না?
-আমিতো ওরে ঐখানে রেখে ওর জন্য বেলুন কিনতে গেছিলাম….ওর মা টাকা দিয়ে গেছিল।
বলা বাহুল্য গর্তের পাশেই ছিলো একটি ছোট জলাশয় যা কস্তুরিপানায় ভরাট ছিল।অনেকের ধারনা ছেলেটি হয়তো ঐ জলাশয়েই পড়েছে।অবশেষে ঘটনা স্থলে এসে পৌছলেন সুফিয়া এবং তার স্বামীও এরই মধ্যে চলে আসেন সেখানে।লোকাল যুবকরা উৎসাহ নিয়ে খোজা খুজি করছেন কিন্তু দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যাবার পরও ছেলেটির কোন খোজই মিলছে না।সুফিয়া তার স্বামীকে নিয়ে থানায় গেলেন।থানার কর্মকর্তারা তাদের অভিযোগ আমলে নিলেন না।তারা চলে এলেন থানা থেকে তখন বেলা দুপুর গড়াচ্ছে।
এ দিকে জলাশয় কিংবা খোলা ম্যানহোলে ছেলেটি পড়েছে বলে যে তথ্য লোকাল জনতার মাঝে।কে বা কারা যেন সুফিয়া বেগমের ক্রন্দন রত ছবি এবং HJHJHহারানো ছেলেটির ছবি সহ বর্তমান যুগে নির্ভরতার প্রতীক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইস বুক টুইটারে পোষ্ট করেন।সাথে পুলিশের উপর অভিযোগের আঙ্গুল তুলা হয়।আর যায় কোথায় প্রশাসন হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন ছেলেটিকে উদ্ধারের।থানায় যাবার পর যে অফিসারটি তাদের কোন অভিযোগ আমলে নেননি তারাই এখন ছেলেটির মা বাবার সাথে বিনয়ের সাথে কথ বলে কথা দেন এবং নিশ্চিত উদ্ধার হবে বলে নিশ্চয়তা দিলেন।
মায়ের বুক থাবরানি চিৎকার করে বিলাপ করছে….ছেলে আমার বেলুন চাইছিল….এই যে বেলুন এহন আমি কারে দিমু গো…আল্লাহ্।
সময় যত অতি বাহিত হচ্ছে ঘটনার দায় ভারে ন্যুয়ে দিশেহারা প্রশাসন আর একে একে ফেইস বুক টুইটার পত্রিকার পাতায় পাতায় নিউজ হতে থাকে ঘটনাটি।প্রতিবাদের ঝড় উঠে রাজপথে।ম্যান হোলের সুরঙ্গে অভিজ্ঞ উদ্ধারকারী পাঠানো হয় তারা তন্ন তন্ন করে খোজছেন… কোথাও নেই ঐদিকে জলাশয়েও অভিজ্ঞ ডুবুরিরা খোজে খোজে হয়রান। ছেলেটির মা বাবা অভুক্ত শরির অসার কেদে কেদে নয়ন ভাসাচ্ছেন।
দিন চলে যায়,পর দিন পত্রিকায় নিউজ আসে প্রশাসনকে হেয় কর যে যে ভাবে পেরেছেন দৈনিক পত্রিকা গুলোতে নিউজের বড় বড় হেড লাইন বের করছেন।সকাল দুপুর পেরিয়ে পর দিন সকাল বেলায় সেই হারিয়ে যাওয়া সুফিয়ার আদুরে দুলাল সোহাগ উৎসুক জনতার ভিড়ে তার মা বাবাকে খোজছে,সাথে একজন  যুবক।

আশ্র্রয় দাতা যুবকের ঘরে প্রত্যহ পত্রিকা রাখতেন সেই পত্রিকায় সোহাগ সদ্য প্রকাশিত আলোচিত ঘটনায় তার মা বাবার ছবি দেখে নিউজটি তাকে দেখিয়ে বলে এরাই তার মা বাবা।যুবক  পত্রিকাটি হাতে নিয়ে ঠিকানা পড়ে দ্রুত তাকে নিয়ে ঘটনা স্থলে আসেন।উৎসুক জনতার ভিড়ের মাঝে সোহাগ তার মা বাবাকে খোজছেন।সে বুঝতে পারছেন না এখানে এতো লোক কেনো!সোহাগ যুবককে তাদের বাসায় যেতে বলাতে যুবক তাকে এখানেই তার মা বাবা আছেন বলে আশস্ত করেন।এক পর্যায় সোহাগ ভিড়ের ভিতর আঙ্গুলের ইশারায় ক্রন্দন রত তার মাকে দেখাল যুবককে।তৎক্ষনাৎ যুবক সোহাগকে কোলে তুলে নিয়ে ভিড় ঠেলে তার মায়ের নিকট তাকে বুঝিয়ে দিলেন।মা ছেলেকে ফিরে পেয়ে আনন্দে আত্বহারা।ক্রন্দনরত মা ছেলেকে পেয়ে ছেলের চোখে মুখে চুমোয় ভরে দিলেন।
ধীরে ধীরে খবর পেয়ে সকল সাংবাদিক টিভি ক্যামেরা এ দিকে মায়ের নিকট চলে এসে তার মাকে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন করেন।উত্তরের এক পর্যায় আশ্রয় দাতার নাম মিডিয়া জানতে পেরে সকল মিডিয়া তার উপর ঝুকে পড়েন।
-আচ্ছা আপনি কি ভাবে কোথায় তাকে পেলেন?
যুবক এর আগে কখনোই এমন পরিস্থিতিতে পড়েননি মুহুর্তে মুহুর্তে ক্যামেরার ফ্লাশ আর মুখের সামনে ধরে রাখা টিভির স্পিকার তার প্রশ্নত্তোরের মাঝে মুখের ভাষায় মাঝে মাঝে জড়তা এসে যায়।
-গতকাল বিকেল বেলায় আমি রেল লাইন দিয়ে হেটেই একটি কাজে বের হয়েছিলাম,তখনই এই ছেলেটিকে দেখলাম রেল লাইনের উপর কান পেতে ট্রেন আগমনের শব্দ শুনতে চেষ্টা করছিল সে যা আমরাও ছোট কালে শুনেছি।তার পর আমি আমার কাজ সেরে আবার যখন একই পথ দিয়ে আসছিলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা,দেখলাম সেই ছেলেটিই একই স্থানেই রেল লাইনের উপর আনমোড়া হয়ে বসে আছে।আমি ভাবলাম ছেলেটি কে যাবার সময় দেখলাম আবার আসার সময়ও দেখলাম…এরই মাঝে আগত ট্রেনের বাশির শব্দ পেলাম ও’তখন পকেট থেকে একটি পয়সা বের করে রেল লাইনের উপরে রেখে ওখানেই দাড়িয়ে রইল।ওখান থেকে সে নড়ছে না একটুও ঐ দিকে ট্রেন বাশি দিতে দিতে তার প্রায় কাছা কাছি চলে আসছিল।তখন তা লক্ষ্য করে দৌড়ে ছেলেটিকে কোলে তুলে নিরাপদ স্থানে চলে এলাম।ট্রেন চলে যাবার পর ও’পয়সাটি খোজে দিতে বলল।আমি তাকে নিয়ে চ্যাপ্টা হওয়া পয়সাটি ওর হাতে দিয়ে জিজ্ঞাস করলাম বাসা কোথায়….ওর আধা ভাঙ্গা কন্ঠে শুধু আঙ্গুল তুলে ইশারা দিয়ে বলল ঐ যে ঐ খানে।আমি বললাম তুমি যেতে পারবে? সে মাথা ঝাকিয়ে না বলাতে তার বাবার নাম মায়ের নাম এলাকার নাম জিজ্ঞাসা করলাম,ঠিকমত সে কিছুই বলতে পারলনা।
-তারপর?
-তারপর রাত হয়ে যাওয়াতে তাকে আমি নিজের বাসায় নিয়ে গেলাম সে অনেক কান্না কাটি করল অনেক ক্ষণ আমি তাকে ভাত খাইয়িয়ে তাকে ঘুম পাড়ালাম অনেক কষ্টে।
-তার পর?
-তারপর সকালে আমার বাসায় রাখা পত্রিকায় তার মায়ের ছবি দেখে সে বলল এটা তার  মা।তারপর দেরি না করে ঠিকানা দেখে তাকে নিয়ে এখানে চলে এলাম।

১১৩৫জন ১১৩৫জন

১৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ