গোলাপি জামা

রুমন আশরাফ ২৮ অক্টোবর ২০১৯, সোমবার, ০১:৪৩:৩১অপরাহ্ন গল্প ১৬ মন্তব্য

মেস থেকে বের হলেই মার্কেট। আহামরি টাইপের কোনও মার্কেট না। তবে মফঃস্বল শহরে সাধারণত যেমনটা থাকে তেমনই আর কি। রাকিব প্রতিদিন অফিসে যাবার সময় এই মার্কেটের সামনে দিয়েই যায়। এখানে জামা কাপড় বিক্রয়ের এর একটি শোরুম আছে। শোরুমের কাঁচের দেয়ালের ভেতরে কিছু পুতুলের ডামিতে ঈদের নতুন পোশাক পরিধান করানো আছে। এর মধ্যে একটি জামা গোলাপি রঙের। মেয়েটি এবার বায়না ধরেছে ঈদে যেন গোলাপি রঙের জামা কিনে দেয়া হয়। গত রাতেও মোবাইলে কথা হয় মেয়ের সাথে। রাকিবের মেয়ে এবার ক্লাস থ্রিতে পড়ে। গ্রামে থাকে মায়ের সাথে।

 

আজ সকালেও অফিসে যাবার সময় দোকানটির দিকে লক্ষ্য করল রাকিব। জামাটা আজও আছে। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছে ভেতরে ঢুকবে কি না। পকেট হতে মোবাইল বের করে সময় দেখল। হাতে বেশ কিছু সময় আছে এখনও। দোকানে একবার ঢোকা যায়। কিন্তু বিপত্তি হচ্ছে দোকানের দরজা নিয়ে। Pull এবং Push এর ব্যাপারটা এখনও ঠিক মতো রপ্ত করতে পারেনি রাকিব। দরজার হাতল ধরে কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে রইলো। ভেতর থেকে একজন এসে দরজা খুলতে সাহায্য করলো।

-স্যার কি লাগবে?

-জামা দেখতে আসলাম। তবে আজকে কিনব না। এমনি দেখবো আপনাদের কালেকশনে মেয়েদের জামা কি কি আছে।

-সমস্যা নেই স্যার। আপনি দেখুন।

 

রাকিব পুরো দোকানের এদিক অদিক তাকাল। সুন্দর সুন্দর অনেক জামা আছে এখানে। থরে থরে সাজানো। মেয়েদের বেশ কিছু জামা হ্যাঙ্গারে ঝুলানো। ভেতরে আরও কিছু ডামিতে জামা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সব জামার চাইতে কেন যেন কাঁচের দেয়ালের পাশের ডামিতে পরানো জামার দিকে চোখ যাচ্ছে বারবার।

-আচ্ছা এই জামাটার দাম কেমন?

-স্যার মেয়ের বয়স কেমন?

-৮/৯ বছর হবে।

-এই জামাটা ৮ থেকে ১০ বছরের বাচ্চার জন্য উপযুক্ত। তবে আপনি চাইলে একই জামা ভেতরের প্যাকেট থেকেও দেয়া যাবে। তবে সীমিত কালেকশন।

-আমি আজ নিব না। তবে দামটা বললে সুবিধা হয়। আজকে তেমন টাকা নিয়া আসি নাই।

-এটার দাম স্যার ২০৯০ টাকা। ডিসপ্লেতেও দাম উল্লেখ আছে। আমাদের সব জামাই এক দরে বিক্রি হয়।

-আচ্ছা ঠিক আছে। জামাটা সুন্দর। আমি পরে আসবো।

-ধন্যবাদ স্যার। আবার আসবেন।

 

দোকান হতে বের হবার সময় রাকিব এবারও পড়লো বিপত্তিতে। দরজা টানবে নাকি ঠেলবে বুঝতে পারছে না। ঢোকার সময় দরজা খোলার ব্যাপারটি খেয়াল করেনি। সেলস ম্যান আবারও এসে দরজা খুলতে সাহায্য করলো।

 

দোকান থেকে বেরিয়ে চিন্তা করতে লাগলো এতো দাম দিয়ে জামাটা কিনবে কিনা। অবশ্য আজ তো কিনতেও পারবে না। বেতন বোনাস যেদিন পাবে সেদিনই কিনতে হবে। ঈদের ছুটি হতে আরও সপ্তাহ খানেক বাকি। ছুটির আগের দিন বেতন বোনাস দেয়া হবে। ততদিন পর্যন্ত রাকিবকে অপেক্ষা করতে হবে।

রাকিব পিয়ন পোস্টে চাকরি করে। যৎসামান্য বেতন পায়। বোনাস নিয়েও যা পাবে তাতেও খুব একটা টাকা হাতে পাবে না। আর এই সামান্য টাকার বেশ কিছু অংশ চলে যাবে মেয়ের জামা কেনায়। এতো টাকা দিয়ে এর আগে কখনও মেয়েকে জামা কিনে দেয়নি। এমনকি কারও জন্যও কিনেনি। তবুও মন চাইছে এই জামাটা কেনার। একটাই তো মেয়ে।

 

অফিস ছুটি শেষে মেসে ফেরার সময় আবারও দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। জামাটা এখনও আছে। আচ্ছা দোকানে আবারও ঢুকে বলে আসবে নাকি জামাটি যেন রেখে দেয়, পরে এসে কিনে নিয়ে যাবে। নাহ ব্যাপারটা ভাল দেখাবে না। সকালেই তো বলে এলো পরে এসে কিনবে। কিন্তু জামাটি যদি বিক্রি করে দেয়! মনের ভেতর একটা সংশয় কাজ করছে। দোকানে যদিও আরও অনেক জামা আছে কিন্তু এই জামাটাই খুব পছন্দ হয়েছে ওর। একটু না হয় দামী, তাতে কি, মেয়েও তো একটাই।

 

দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ হয়ে গেলো। কাল থেকে শুরু হবে ঈদের ছুটি। বেতন বোনাস আজই পাবে রাকিব। সকাল থেকেই কেমন একটা উত্তেজনা কাজ করছে ওর ভেতর। গোলাপি জামাটা আজই কিনতে হবে। সকালে মেস থেকে বেরিয়ে মার্কেটের সামনে আসলো। দূর থেকে দোকানটার দিকে দৃষ্টি দিল। দোকান এখনও খোলা হয়নি। মেস থেকে আজ একটু আগেই বেরিয়েছে রাকিব। এখন বাজে সকাল সাড়ে আটটা। নয়টার আগে তো দোকান খুলবে না। এদিক অদিক পায়েচারি করতে লাগলো রাকিব। কিছুক্ষণ পর দোকানের কর্মচারী আসলো। দোকানের শাটার খোলা হচ্ছে এক এক করে। দূর থেকেই এবার রাকিবের চোখ পড়লো কাংখিত জামাটির দিকে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অফিসের উদ্দেশ্যে যাওয়া শুরু করলো রাকিব।

 

রাকিবের হাতে এখন বেতন বোনাসের টাকা। অফিস ছুটি হতে এখনও দু ঘণ্টার মতো বাকি। একটু আগেভাগে বের হবে কিনা বুঝতে পারছে না। ও যে পোস্টে জব করে তাতে এতো আগে বের হওয়াও মুশকিল। তবুও তর সইছে না। নির্ধারিত সময়ে অফিস শেষ করে বেরিয়ে গেলো রাকিব। মার্কেটের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো গত কয়েকদিনের মতো। বাইরে থেকে জামাটা দেখা যাচ্ছে না। বুকের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল রাকিব। একজন সেলস ম্যান এগিয়ে এলো ওর দিকে।

-কি লাগবে স্যার বলুন?

-ঐ গোলাপি জামাটা কই?

-কোন জামার কথা বলছেন স্যার।

-ঐযে পুতুলের গায়ে পরানো ছিল গোলাপি জামাটা।

-ও আচ্ছা। স্যার জামাটা তো আজ দুপুরেই বিক্রি হয়ে গেছে। আপনি চাইলে অন্য জামা নিতে পারেন।

-ক্যান আপনাদের ভিতরে ঐ জামাটা আর নাই।

-ছিল স্যার। কিন্তু সবই বিক্রি হয়ে গেছে। আমাদের কালেকশন সীমিত ছিল। আমাদের আরও বেশ কিছু সুন্দর জামা আছে। দেখাব?

– আচ্ছা থাক লাগবে না।

 

দোকান থেকে বের হয়েই রাকিবের চোখ টা ঝাপসা হয়ে উঠলো। জামাটা প্রতিদিন চোখেচোখে রেখেও চোখের আড়াল হয়ে গেলো। অথচ কল্পনায় মেয়েকে গোলাপি রঙের ঐ জামাটি পরিহিত অবস্থায় কতবার যে দেখেছে তার হিসাব নেই।

 

এতদিন সাধ ছিল কিন্তু সাধ্য ছিলনা। আর আজ সাধ্য আছে কিন্তু সাধ মিটানো হল না।

…. Rumon Ashraf

৭৬৬জন ৬৬৯জন
0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ