একটি আধপুড়া ডাইরি
সামনের শিশু গাছটি তে হাজারো জোনাকি মিটিমিটি জ্বলছে । আমার ছোট ঘরে ফ্লোরোসেন্ট লাইটটি জ্বলছে । টেবিল ফ্যানটি বন্ধ। বাহির থেকে বাতাস আসছে,আমার ঘেমে যাওয়া শরীরে ঠান্ডা স্পর্শ লাগাচ্ছে মৃদু বাতাস। বিছানায় আমার ছোট ভাই ঘুমাচ্ছে । বয়স আর কতই বা হবে ১৮ কিংবা ১৯ বছর। ইবতেহাজ রেজা রিফাত । খেলতে পারে বেশ। গতবার আন্তঃজেলা ফুটবল টুর্নামেন্টে বেষ্ট খেলোয়াড় হয়েছে সে । কি নিষ্পাপ চেহারা । জগতের নির্লিপ্ততা তাকে এখনো স্পর্শ করে নি ।মাঝে মাঝে অংক নিয়ে আমার কাছে আসে । আর বলে
-ভাইয়া পারছি না ,করে দাও না ।
আমি কানমলা দিয়ে অংক করে দেয় । বুঝিয়ে দেয় ।আমার ছোট ভাইকে। আমার একমাত্র ছোট ভাই । আমার ছোট ভাই বেড়ে উঠেছে দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করে । আমার পুরনো জামা গায়ে দিয়ে,এই ঢাকা শহরের অলি গলিতে খাবার খুজে খুজে । এখন কোন মতে দিন চলে,আগের চেয়ে জীবনে হাল্কা সুখ এলেও জীবনের সুখ এখনো অধরা । আম্মার সারা শরিরে রোগ,ভালমত এখন হাট্তেও পারেনা । আর বাবার কথা নাই বা বললাম । তাদের চিকিৎসা করানোর সামর্থ আমার নেই,১০০০০ টাকার বেতনে সংসার চলে না । ৫০০০ টাকা বাসা ভাড়া গ্যাস,পানি বিদ্যুতেই চলে যায়,আর বাকিটা খাওয়া খরচ,যাতায়াত,অসুধপাতি তে লাগে । রিফাত স্কুল থেকে বৃত্তি পাই,সে টাকাতেই সে চলে । আর আমি ছুটি,পথে পথে ছুটি ।পড়াশুনা করে যে গাড়িঘোড়াতে চড়ে সে । আব্বুর মুখে শুনতাম ছোট বেলা । নাহ কথাটি মোটেও সত্য নয়,গাড়ি ঘোড়া তে চলার জন্যে পড়াশুনার দরকার হয় না,দরকার শুধু মামা আর সার্টিফিকেট ।
আমার ছোট বেলা কেটেছে চরে, ভোলার এক চরে। রিফাতের জন্মের আগে । আমাদের তখন অনেক কিছু ছিল । আমাদের ছোট ক্ষেতে আমি আর আম্মু নানা রকমের শাক-সবজি চাষ করতাম । বিকেল হলে পাঠাগার থেকে ফিরে এসে একসাথে মা ব্যাটা কাজ করতাম । ছোট সংসারে অভাব ছিল না। ছিল অর্থের টানাটানি,তবুও ছিল সুখ । ছিল সন্ধার পরে বিস্মিল্লাহ বলে ঘুমানোর আনন্দ । ছিল প্রশান্তি । রাত ফুরলে আব্বুর সাথে মসজিদে যেতাম । আব্বু ইমাম ছিল,ইমাম হিসেবে সম্মান ছিল । আমি পিছনে নামাজ পড়তাম। মানুষ কম থাকলে ইকামাত দিতাম । নামাজ শেষে দুই বাপ ব্যাটা নদীতে যেতাম । নদীতে মাছ ধরতাম । হাল্কা নোনা পানিতে নানা রকমের মাছ থাকতো । আব্বু বড় জাল দিয়ে মাছ ধরতো আর আমি বরশি দিয়ে মাছ ধরতাম । আমার ধরা মাছগুলা কখনো বিক্রি করা হত না । আমার ধরা মাছগুলা বাসায় রান্না হত । আমরা ৩ জনে খেতাম । আমার আব্বু ভালমত হাটতে পারতেন না । যুদ্ধের সময় পায়ে গুলি লাগাতে হাটতে সমস্যা হত । আমার ছোট চাচা আব্বুর সাথে যুদ্ধ করতে করতে মারা যান । পাকিস্তানিদের একটি গুলি ছিদ্র করে দেয় আমার চাচার বুকের হৃৎপিণ্ড । আরো কত যুদ্ধের ঘটনা আমার মুখস্ত । শুনতাম আর ভাবতাম আমিও একটা গুলি নিয়ে যুদ্ধ করছি । ধাই ধাই করে মেরে ফেলছি হাজার হাজার পাকিস্তানিদের ।
জীবনের রং সময় অসময়ে পালটায়,তাই সমুদ্রের জিহবায় চুসে নেয় আমাদের সুখ । তারপর ঢাকাতে আসি । পুরান ঢাকার বস্তিতে বাসা নেয় । বস্তিতে উঠার সময় রিফাতের বয়স ৬ থেকে ৭ মাস । আব্বা বিড়ি-সিগারেট, চা এর ব্যবসা করতে লাগলেন,আম্মা বাসা বাড়িতে কাজ করতে লাগলেন । ঢাকা শহরের মানুষ গুলো সভ্য,উচা উচা বিল্ডিঙ্গের মাঝে তারা নিস্পাপ,তারা কলংক মুক্ত। রাস্তায় ভো ভো করে গাড়ি ছুটিয়ে চলে এ শহরের বাবুরা কিন্তু এরা মানুষ রুপি জানোয়ার । ঘরের মাঝে শিশ্নওয়ালা পুরুষ । তাই তাদের চোখে আমার মা রক্ষা পায়না । আম্মু বাসা বাড়িতে ঘন ঘন কাজ পাল্টাতেন,আর আব্বুর কাছে রাতে কাদতেন। রাতের বেলা বস্তির দেয়ালের ফাক ফকর দিয়ে এসব আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসতো । আমি পড়তাম । অনেক পড়তাম ।চোখের পানিতে বই ভিজে গেলেও পড়তাম । পড়ে একদিন সব দুঃখ কস্ট ভুলিয়ে দিব ভাবতাম । কিন্তু না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় প্রথম শ্রেণীতে পাস করেও চাকরি হয়নি কথাও । আমার মামা নাই, আমার সার্টিফিকেট নাই ।
আমার আব্বু যুদ্ধের সময় ছিল ছোট, তাই তার আর সার্টিফিকেত নেয়া হয়নি। অশিক্ষিত মুর্খ মানুষ সার্টিফিকেটের কি বুঝে ? দেশকে ভালবেসে গেছিল যুদ্ধে এখন অবশ্য যুদ্ধ নিয়ে নানা রকম চেতনার কথা শুনি । যুদ্ধের সময় আফতাব চাচা ইন্ডিয়াই পালিয়ে ছিল,সে ক্ষমতা দিয়ে সার্টিফিকেট জোগাড় করেছে । তার ছেলে সরকারি চাকরি করে।
মাঝে মাঝে আব্বুকে রাগ করেই বলি “যুদ্ধে না গিয়ে যদি চুরি করতে তাহলে আজ কে আমার মায়ের চিকিৎসা করাতে পারতাম । পা না হারালে দুইজনে কাজ করে চিকিৎসা করাতাম। কি দিছে দেশ তোমারে ? বেহুদা পা নিয়ে গেছে।” আব্বু কিছু বলে না। তার যে কিছু বলার নাই। আমারও কিছু বলার নাই। দেশের কাছে কিছু চাওয়ারও নাই । মাঝে নেতাদের মুক্তি যুদ্ধ নিয়ে বক বক করতে দেখি । মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ বলে চিৎকার করতে শুনি । আমার মায়ের ধর্ষক,আমার বাপের হত্যা কারি,আমার ভাই এর খুনি , আমার বোনের খুনি ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ব্লা ।
এসব কথা শুনি আর আমি হাসি । আমার মা বিছানায় শুয়ে কাতরায়। বাবার চোখের ছানি কাটতে টাকা জোগাড় করতে পারি না । চেতনাধারি নেতারা একদিন খবরও নেয় না। জীবিত মুক্তিযুদ্ধার খবর কেউ নেয় না । মৃতদের নিয়ে পেট পুজার বিলাপ করে । তারা শুশিল । তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে আমি মুক্তিযুদ্ধার সন্তান হয়েও আমি রাজাকার ।
আমি হাসি।আমার হাসি কেউ থামাতে পারেনা । মাঝে মাঝে ভাবি আমার আসলে জন্ম হওয়াটাই ভুল ছিল । আমার জন্ম হল নষ্ট জন্ম।
মুখবন্ধ – কাল্পনিক গল্প । বাস্তবতার সাথে মিলাতে চাইলে নিজ দায়িত্তে মিলাবেন ।
১০টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
‘বাস্তবতার সাথে মিলাতে চাইলে নিজ দায়িত্বে মেলাবেন’
মিল অমিল বুঝি না তবে বাস্তবতা এমনই চিত্র বহন করে ।
হুমায়ুন তোরাব
কি জানি ভাই । আমি কম বুঝি
জিসান শা ইকরাম
ভালো লিখেছেন (y)
হুমায়ুন তোরাব
ধন্যবাদ
লীলাবতী
বাস্তবের সাথে মিলে যায় যে
হুমায়ুন তোরাব
তাইলে আমি কি করব বলেন ??
প্রজন্ম ৭১
এই গল্পের নায়কের বাবা মুক্তিযোদ্ধা , শ্রদ্ধা এমন বাবাকে । কিছু মানুষ জন্মায় দেয়ার জন্য , নেয়ার জন্য নয় । এমন মানুষ উদাহরন হয়ে থাকেন ।
হুমায়ুন তোরাব
জ্ঞান দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ ।
ভোরের শিশির নীতেশ
বাসবতাও অনেক সময় অবাস্তব বলে মনে হয়…
শুন্য শুন্যালয়
কিছু পাবার আশায় কেউ যুদ্ধ করেনি, তাই আমরাও কিছু দেইনি…
না চাইলে আবার কিসের দেয়া…
এই বাস্তবতা চাইনা, কল্পনাতেই থাকুক… 🙁