।।।। হারান দিন।।।।
মাত্র ৭ কিলোমিটার দুরে বাড়িটা।
যে বাড়িটি হারিয়েছিলাম আমরা;
গত ১৭ বছর আগে। কিন্তু কেন
হারিয়েছিলাম তা আমি কোনদিন
জানতে চাইনি আর বাবাও কোনদিন
বলেননি। শুধু এটুকুই জানতাম যে আমার
বাবাকে ঠকান হয়েছে। আর
যে ঠকিয়েছে;যতদুর আত্মীয়
সজনকে বলাবলি করতে শুনেছি সে
আমাদের আপন লোক। যাই হোক
আমাদের ওই
বাড়িটা ছাড়তে হয়েছিল ১৭ বছর
আগে। আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম; ৬
বছর বয়স। তবে বাড়িটা ছেড়ে আসার
দৃশ্য এখনও মনে আছে আমার। আমরা দুই
ভাই;আমি ছোট। আমার বড় ভাইয়ের
কাঁধে একটা স্কুল ব্যাগ ছিল।
যে ব্যাগটার পেছনে একটা নৌকার
ছবি আঁকান ছিল। যে ছবিটা আমিই
আঁকিয়েছিলাম। ছবিটা আঁকার
অপরাধে ভাইয়া আমাকে ধমকেছিল
কিনা মনে নেই। তবে আমি কোন
কারনে বুঝে গিয়েছিলাম
ছবিটা আকার কারনে ভাইয়ার
দামি ব্যাগটার সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছিল।
ভাইয়া যখন ছবিটা মুছে ফেলার জন্য
অনেক ঘষা মাজা করত তখন
নিজেকে অপরাধী মনে হত। আর
মনে মনে আশা করতাম
ছবিটা যাতে মুছে যায়। কিন্তু
ছবিটা সম্পুর্ন মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি।
মা বলত “কি করেছ তুমি এটা,
তুমি তোমার ভাইয়ার কোন কিছু
নিয়ে খেলবেনা।” আমি মায়ের
কথা মনে মনে মেনে নিয়েছিলাম।
কিন্তু হা সুচক জবাবটা দিতেও
লজ্জা পাচ্ছিলাম।
খুব তারাতারি আমরা আমাদের নতুন
বাড়িতে পৌছে গিয়েছিলাম।
বাবা ঘরোয়া জিনিসপত্রগুলো গাড়ি
থেকে নামিয়ে নতুন ঘরটির এক
কোনে জড় করে রাখলেন। তারপর
প্রয়োজন অনুযায়ী সবকিছু সাজান হল।
আমার আর ভাইয়ার রুমটায় দেয়া হল
দুটি টেবিল আর ঘুমানর জন্য একটি খাট।
আমরা পড়াশুনা করতাম
আলাদা টেবিলে বসে কিন্তু
ঘুমাতাম একই বিছানায়। আমার স্পষ্ট
মনে আছে আমি খুব উৎসাহ নিয়ে নতুন
ঘর;নতুন বাড়ি;নতুন বাড়ির আশপাশের
পরিবেশ;নতুন নতুন মানুষ দেখছিলাম
যদিও আমি বুঝতাম
না যে আমরা এখানেই সারা জীবন
থেকে যাব। আমি দেখছিলাম মানুষ
কে কোথায় কি কাজ করছে। সময়ের
সাথে সাথে নতুন যা কিছু সব পুরান
হয়ে গেল। পুরান হয়ে গেল
যারা আমার অচেনা ছিল। এখন
অনেকের সাথেই আমার ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব
যারা আমার সমবয়সী। তাদের
সাথে একসাথে খেলা ধুলা করি;
ঘোরাফেরা করি;
লেখাপড়া করি আর
মাঝে মধ্যে গল্পের
আড্ডা নিয়ে বসি। কখন ও দুজন
থাকি কখনো তিনজন
কখনো কখনো অনেক কয়জন থাকি;
একসাথে ঘুরি;লেখাপড়া করি;খেলি;
গল্পকরি। কিন্তু এরকমটা ছিলনা যখন
আমি এখানে নতুন ছিলাম। সময়ের
সাথে সাথে ওরা আমার বন্ধু হয়;কেউ
স্কুল বন্ধু আবার কেউ পাড়ার বন্ধু।
আমাদের সেই
ফেলে আসা বাড়িটার দুরুত্ব মাত্র ৭
কিলমিটার। কিন্তু ছেড়ে আসার পর
আমরা আর কোনদিন
সেখানে ফিরে যাইনি। যাবার
প্রয়োজন ও পড়েনি কখনো। যদিও
আমরা সেখানে বারটি বছর
থেকেছিলাম। বাবা সেখানকার
অনেক মানুষের সাথে পরিচিত
হয়ে গিয়েছিলেন;তাদের
সাথে ভাল সম্পর্ক
গড়ে উঠেছিল;ভাইয়ার স্কুলের বন্ধু
ছিল। আমার বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর; এ
বয়সে কারো সাথে বন্ধুত্ব
গড়ে উঠবে ; এটা অস্বাভাবিক নয়।
আমার স্পষ্ট মনে আছে সেই মাঠটার
কথা যে মাঠটার এককোনায়
একটা প্রাইমারী স্কুল ছিল। স্কুলটায়
পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
বাবা আমাকে ক্লাস
ওয়ানে ভর্তি করিয়েছিলেন। প্রথম
দিন ক্লাসে ঠিকঠাক উপস্থিত
থাকলেও দ্বিতীয় দিন যখন দেখলাম
শিক্ষক পড়া না পারার
অপরাধে অনেককে শাস্থি দিচ্ছেন
তখন ভয় পেয়ে ক্লাসের মধ্যে বই
রেখেই
পালিয়ে বাড়ি চলে এসেছিলাম।
বাবা বুঝতে পেরেছিলেন আমি খুব
ভয় পেয়েছি। তাই স্কুল
থেকে পালিয়ে এসেছি।
বাবা পরে স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের
বলে আসেন
যাতে আমাকে শাস্তি না দেওয়া হয়।
তারপর থেকে আমি যথাযথ
স্কুলে উপস্তিত হওয়া শুরু করি।
আমি যার সাথে স্কুলে যেতাম
সে ছিল আমারই প্রতিবেশি বন্ধু দিপ।
আমি যত দুর মনে করতে পারি ও ই
আমার প্রথম ও ঘনিষ্ট বন্ধু ছিল যার
সাথে আমি খেলতাম; স্কুলে যেতাম।
সেদিন ছিল ছুটির দিন; সকাল
বেলা দিপ একটা নতুন ফুটবল
নিয়ে আসল আমাদের বাড়ি। বলটির
উচ্চতা ছিল আমাদের উচ্চতার
চারভাগের একভাগ।
সুতারাং বলটি দেখতে আমার
কাছে খুব বড় আর ভারি মনে হয়েছিল।
দিপ
আমাকে উঠনে দাড়িয়ে ডাকতে শুরু
করল আর সেই সাথে ওর বলটার ড্রপের
শব্দ ও শুনতে পেলাম। শব্দটা আমার
কাছে খুব পরিচিত ছিল কারন
আমাদের স্কুল মাঠে বড়
ছেলেরা এসে প্রায়ই ফুটবল খেলত। আর
আমি আর দিপ
দাড়িয়ে দাড়িয়ে ওদের
খেলা দেখতাম। তখন আমার ও
খেলতে খুব ইচ্ছে হত। আমি ভাবতাম
একটা ফুটবল
পাওয়া গেলে দিপকে নিয়ে খেলা
করতাম। আমি ভাবতাম একটা ফুটবলের
দাম কত হতে পারে। তাই বাবার
কাছে বলতাম “বাবা একটা ফুটবলের
দাম কত?” কিন্তু বাবা নিজের
কাজের প্রতি এত মনযোগী থাকতেন
যে আমার কথা শুনতেই পেতেন না।
আমিও ভয়ে দ্বিতীয় বার প্রশ্ন করতাম
না। দিপ দুর থেকে বলটা আমার
কাছে ছুড়ে মারল। বলটি আমার
পায়ের
কাছাকাছি এসে থেমে গেল। দিপ
বলল “শট কর”
আমি বুঝতে পারলাম না বড় আর নতুন
একটা ফুটবলকে কোন মাত্রায় শট
করা উচিত। আমি আস্তে করে মারলাম
যাতে বলটার কোন ক্ষতি না হয়।
তারপরেও দেখলাম বলটি দ্রুত অনেকদুর
চলে গেল। সেই মুহুর্তে আমার মনের
মধ্যে একটা আনন্দ খেলে গেল।
আমি দ্বিতীয় শটটা করার জন্য
পায়ে একটু জোর বাড়িয়ে দিলাম।
দেখলাম বলটি হাওয়ার মত
উড়ে অনেকদুর গেল। দিপ বলল
“এভাবে খেললে মজা হবেনা। গোল
পোষ্ট দিয়ে খেলতে হবে।”
আমরা উঠনের দুইপাশে দুইটি গোল
পোষ্ট বানিয়ে সারাদিন ফুটবল
খেললাম। পরেরে দিন
সকালে আমি ও দিপ
স্কুলে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু
আমার মন পড়েছিল ফুটবলের দিকে।
কিন্তু দিপকে তা মনে হল না। দিপ
যদি আমার মত ফুটবলের
কথা চিন্তা করত তাহলে সেদিন হয়ত
স্কুলেই যাওয়া হত না। স্কুল
থেকে ফিরেই আবার ফুটবল খেলতে শুরু
করলাম আমরা। কিন্তু দুপুরে খাওয়ার
জন্য বেশি সময় ব্যায়
করতে হয়নি আমাদের।
বাবা মা আমাকে কথায় কথায় প্রায়ই
স্কুলে বই রেখে পালিয়ে আসার
কথা বলতেন ; এমনকি এখনো বলেন
তবে আগের চেয়ে কম। তারা যখন
বলে “তুমি ছোট বেলা একবার
স্কুলে বই
রেখে পালিয়ে এসেছিলে।
তুমি শিক্ষকদের খুব ভয় পেতে তাই এমন
করেছিলে।”
বাবা মা হাসতে হাসতে এরকম বলত
তখন আমার ভালই লাগত। কারন শৈশবের
সুন্দর সৃতিগুলো আমার কল্পনায়
চলে আসত। বাবা বলত “তখন তুমি অনেক
ছোট ছিলে।” আমি বাবা মায়ের এসব
কথা শুনে মুচকি হাসতাম।
তবে কথা গুলো শুনে যে আমার ভাল
লাগত; বাবা মা বুঝতে পারলে হয়ত
আরো অনেক ঘটনা বলতেন। আমি শুধু
মাঝে মধ্যে দু একটি প্রশ্ন করেই
থেমে যেতাম। “তখন আমি কত বড়
ছিলাম” “খুব ছোট ” বাবা বলত।
আমি আবার কল্পনার রঙিন
জগতে চলে যেতাম।
নিজেকে একটা ছোট
বাচ্চা ছেলে কল্পনা করতাম।
কল্পনা করার জন্য হয়ত আমার মত
দেখতে কোন
বাচ্চা ছেলেকে মনে করার
চেষ্টা করতাম। আর হঠাৎ মনে হত
কতগুলো বছর কেটে গেল। সেই
সাথে মনে পরত দিপের কথা।
আমরা আসলে একই বয়সের ছিলাম।
দীর্ঘ ১৭ বছর আগের বন্ধু। আমি নিশ্চিত
ও
আমাকে দেখলে চিনতে পারবেনা।
এমনকি আমিও ওকে চিনতে পারবনা।
ওর কথা ভাবতে গেলেই আমাদের
ছোট বেলার সৃতিগুলো ভেসে ওঠত।
কিন্তু আমার কল্পনায়
এটা আসতে চাইতনা যে আমরা দুজনই
বড় হয়ে গেছি। ১৭ বছর কেটে গেছে।
দিপ যেমন পরিবর্তন
হয়েছে তেমনি আমিও হয়েছি। এখন
আর সেই দিনটা নেই যে দিনটায়
আমরা সারা দিন ফুটবল খেলেছি আর
আরো একটি দিনের জন্য
অপেক্ষা করেছি। তারপর
আরো একটা দিন ; তারপর
আরো একটা দিন তারপর
আরো অনেকগুলো দিন। কিন্তু সেই
দিনগুলো হয়ত অসামাপ্ত রয়ে গেছে।
আমি বলতাম
“বাবা স্কুলটা কি এখনো আছে? ”
বাবা বলতেন “না থাকার কি আছে।
এখন হয়ত অনেক উন্নত হয়ে গেছে।”
স্কুলের সামনে একটা মাঠ ছিল। বর্ষার
সময় রাস্তা দিয়ে পানি নেমে আসত
মাঠের মধ্যে। ফলে, মাঠ ও রাস্তার
মধ্যবর্তী যায়গায় বালুর সমতল
একটি স্তর তৈরী হত। আমি আর দিপ
সেই বালুর সমান স্তরের উপর
ছবি আঁকতাম আর যার যার নাম
লিখতাম। দিপ আঁকত পশু পাখির ছবি।
কিন্তু আমি পশু পাখির
ছবি আঁকতে পারতাম না। তাই
আমি আঁকতাম ঘর অথবা নৌকার ছবি।
কারন ঘর আর নৌকার ছবি আকা আমার
কাছে সহজ মনে হত।
ছবি আঁকতে আঁকতে যখন সমতল বালুর স্তর
অসমতল হয়ে যেত তখন
আমরা পাতা অথবা হালকা কোন বস্তু
পানিতে ভাসিয়ে দিতাম। স্কুলের
সামনে অনেকগুলো ঢালু যায়গা ছিল।
তাই একটু বর্ষা হলেই ঢালু
যায়গাগুলো পানিতে তলিয়ে যেত।
সেই পানির মধ্যে হালকা বস্তু
ভাসিয়ে দিতাম। আর
আকৃতি অনুযায়ী ভাসমান
হালকা বস্তুগুলোর নাম দিতাম।
আমি বলতাম “এটা আমার
নৌকা ভেসে যাচ্ছে।” দিপ বলত ”
আমিও একটা জাহাজ
ভাসিয়ে দিলাম।” আমি বলতাম “আর
ওইটা হল আমার জাহাজ।
এখনি পাড়ে ভিরবে।” তারপর
জাহাজের হর্নের অনুরুপ শব্দ করতাম
আমারা। নৌকা আর জাহাজগুলো যখন
মাঝখানে গিয়ে স্থীর হয়ে যেত তখন
পানি ছিটিয়ে আবার গতিশিল করার
চেষ্টা করতাম। ফলে, কোন কোন
জাহাজ
বা নৌকা পানিতে উল্টে গিয়ে
ভেসে থাকত। আমাদের
খেলাটা ততক্ষন চলত যতক্ষন পর্যন্ত
খেলাটা আমাদের
কাছে একঘেয়েমি মনে না হত
অথবা আমাদের কেউ
ডাকতে না আসতেন। দুপুরে খাবার
পরে আমাদের শারীরিক ও মানুষিক
অবস্থা সাভাবিক হত তখন হয়ত
আমরা আবার অন্য কোন কিছু
নিয়ে মেতে থাকতাম। আমাদের স্কুল
মাঠটিতে মাঝে মধ্যে মাইক্রোবাস
চলে আসত। স্কুলের মাঠে কোন
গাড়ি দেখতে পাওয়া আমাদের
কাছে বিস্ময়কর মনে হত। কারন
আমাদের স্কুলের পাশের
রাস্তা দিয়ে তেমন কোন গাড়ি চলত
না। ফলে হঠাৎ কোন
গাড়ি আসলে আগ্রহ নিয়ে দেখতাম
আমরা। আবার গাড়িটি যখন চলে যেত;
গতি পর্যবেক্ষন করতাম।
বাবা বলতেন “স্কুলটা এখনও আছে। হয়ত
কিছুটা উন্নত হয়েছে।” ১৭
বছরে উন্নতি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
তবুও আমার স্কুলটা দেখতে ইচ্ছে করত।
আমার দেখতে ইচ্ছে করত ১৭
বছরে স্কুলটার কি পরিবর্তন হয়েছে।
নাকি আগের মতই আছে। বিশেষ কোন
পরিবর্তন হলে তা আমি বুঝতে পারব।
কারন আমি যে স্কুলটা ১৭ বছর
আগে দেখেছিলাম সে স্কুলটা ছিল
কাঠের তৈরী আর ছাউনি ছিল
টিনের। আমার
মনে হয়না স্কুলটা আগের মতই আছে।
বরং মনে হয় স্কুলটি এখন ভবনে পরিনত
হয়েছে এবং রাস্তাঘাটও উন্নত
হয়েছে। কারন দীর্ঘ ১৭ বছর
কেটে গেছে। এই ১৭ বছরে স্কুল
রাস্তাঘাট আগের মতই থাকবে;
সরকার অন্তত অত ধিরুচ হতে পারেনা।
মা মাঝে মধ্যে বলতেন “তুমি একবার
রাতের
বেলা হারিয়ে গিয়েছিলে। আমি,
তোমার ভাইয়া, তোমার বাবা,
আমাদের প্রতিবেশিরা সবাই
মিলে তোমাকে খুজছিলাম।
অবশেষে তোমাকে একটা বাগানের
মধ্যে খুজে পায় জিতুর মা।”
আমি জিতুকে চিনতাম। দিপের বড়
ভাই। আমার ভাইয়ার সমবয়সী ছিল।
ভাইয়া আর জিতু
আলাদা আলাদা স্কুলে পরলেও থাকত
একসাথে। একসাথে খেলাধুলা করত
তারা। মা হাসতে হাসতে বলতেন ”
আমরা কি দুঃচিন্তায় ছিলাম!
তুমি বাগানের
মধ্যে একা একা কি করছিলে?”
আমি বলতাম “সে কথা আমার
মনে নেই।” মা বলতেন
“আসলে তুমি তখন অনেক ছোট। ২ বছর
বয়স।’ আমি মাকে বলতাম ”
তুমি দিপকে চিনতে? ” মা বলতেন
“হ্যা চিনি। জিতুর ছোট ভাই। তোমার
তো সমবয়সী ছিল। তোমার
তা এখনো মনে আছে?”
আমি মুচকি হাসতাম আর
মাথা নেড়ে হা সুচক জবাব দিতাম।
মা বলতেন “জিতুর মা খুব ভাল
মহিলা ছিল।
আমাকে আপা বলে ডাকত।
তাকে এবং তার পরিবারকে খুব আপন
মনে হত।” আমি মনে করার
চেষ্টা করলাম, যখন আমার বয়স দুই বছর
ছিল তখন আমি একবার রাতের
বেলা হারিয়ে গিয়েছিলাম।
মা বলতেন
“তুমি অন্ধকারে একটা চালতা গাছের
নিচে চুপচাপ বসে ছিলে। তখন রাত ৮
টা বাজে। গ্রামে চিৎকার
চেঁচামেচি শুরু হয়ে গিয়েছিল। সবাই
তোমার নাম ধরে ডাকছিল আর
খুঁজছিল।” আমি মনে করার
চেষ্টা করলাম কিন্তু
মনে করতে পারলাম না।
আসলে আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম।
আর এত ছোট বয়সের সব
ঘটনা মনে না থাকারই কথা। সবার
দৃষ্টিতে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম
আর আমার
দৃষ্টিতে আমি অন্ধকারে চুপচাপ
বসে আপন মনে কিছু দেখছিলাম। হয়ত
সেটা হতে পারে রাতের
অন্ধাকারে মানুষের
বাড়িতে বাড়িতে প্রদিপের
আলো ছায়ার খেলা।
আমার অনার্স পরীক্ষা শেষ হয়েছে।
আমি বাবাকে বললাম “বাবা, দিপ
এখন কোন ক্লাসে পড়ে?”
বাবা বললেন “তোমার
সাথে পড়ে অথবা তোমার থেকে দুই
একবছর নিচে বা উপরে।” আমি এস এস
সি পরীক্ষায় একবার ফেল
করেছিলাম তাই স্বাভাবিক ভাবেই
একবছর পিছিয়ে আছি। পরের বছর পাশ
করলেও রেজাল্ট ভাল ছিল না। কিন্তু
আমি জানি দিপ খুব ভাল ছাত্র ছিল।
ও ভাল ছবি আঁকতে জানত।
লেখাপড়ায় যেমন মনযোগি ছিল
তেমনি ভাল ছিল। তাই আমার মনে হল
না ও পরীক্ষায় ফেল
করে পিছিয়ে যেতে পারে। বরং ওর
রেজাল্ট ভাল হবে এটাই স্বাভাবিক।
আমি আমার সাইকেলটা ভাল
করে ঘষে মেঝে পরিস্কার করলাম। গত
১২ দিন ধরে পরে আছে সাইকেলটি।
তার মধ্যে একবারও হাত দেয়া হয়নি।
তাই প্রচুর ধুলা ময়লা জমে গিয়েছিল।
চাকা দুটিতেও হাওয়া ছিলনা। তাই
গ্যারেজ
থেকে হাওয়া দিয়ে নিলাম।
বিকেল বেলা আমার মনটা খুব
ভালছিল। ভাবলাম
সাইকেলটি নিয়ে কোথাও
ঘুরে আসি। আমার সাইকেল
নিয়ে একা একা ঘোরার অভ্যাস
আছে। হয়ত বিকেলে নদীর
পাড়ে ঘুরতে গিয়েছি।
সেখানে গাংচিলদের
উড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখেছি।
গাংচিলরা দুর
থেকে উড়ে এসে নদির
পানিতে পাতি হাসের মত
ভেসে বেড়ায়। আবার
দলবদ্ধভাবে উড়ে দুরে চলে যায়।
খাবার সন্ধান করতে থাকে। আমি কখন
ও গাংচিল দেখেছি আবার কখন ও
নদীর নিরীহ ঢেউ পর্যবেক্ষন করেছি।
নদীর ওপারে একটা জংগল আছে;
দেখলে মনে হয় নদীর ওপার
একটা রেখা অস্পষ্টভাবে অনেক
দুরে মিলিয়ে গিয়েছে।
আমি জানিনা জংগলটায় কোন
ভয়ংকর প্রানী যেমন রয়েল বেংগল
টাইগার আছে কিনা। আর জানার জন্য
কাউকে প্রশ্ন করিনি কখন ও। নদীর
জেলেরা এখানকার সব কিছুর
সাথে পরিচিত। কিন্তু তাদের ও
কখনো প্রশ্ন করিনি। যখন
সন্ধ্যা হত;দুরের
জংগলটা ঝাপসা দেখাত;গাংচিলরা
তাদের গন্তব্যে চলে যেত;
আমি ফিরে আসতাম বাড়ি।
সাইকেলটি ঘরের এক কোনে যত্ন
করে রেখে দিতাম।
আমি দেখলাম সাইকেলটির
চাকা ভালই ঘুরছে;যদিও
আমি সাইকেলটি আস্তে
চালাচ্ছিলাম। পিচের
তৈরী রাস্তাটি উচু নিচু।
সাইকেলটি উচু রাস্তায় উঠার সময়
গতি কিছুটা কমে যায়। কিন্তু উচু
অঞ্চলটি ত্যাগ করার সময়
গতি বেড়ে যায়। তখন
সাইকেলটি সয়ংক্রিয়ভাবে চলছে
বলে মনে হয়। আমি কোন একটা বিষয়
নিয়ে ভাবতে থাকি। হঠাৎ
দেখি আমার সাইকেলের
গতি কমে গেছে। আমি দ্রুত প্যাডেল
মেরে সাইকেলের
গতি স্বাভাবিকে নিয়ে এসে আস্তে
আস্তে চালাতে থাকি।
ভাবতে থাকি ১৭ বছর
আগে ফেলে আসা বাড়িটির
কথা;১৭বছর আগের আমাদের
প্রতিবেশিদের কথা; দিপের
কথা;দিপের বড় ভাইয়ের কথা;দিপের
বাবার কথা;দিপের মায়ের
কথা যে আমার
মাকে আপা বলে ডাকতেন;স্কুলের
কথা;স্কুলের মাঠটির কথা। ১৭ টি বছর
কেটে গেছে। আমি নিশ্চিত দিপ
আমাকে দেখে চিনতে পারবেনা।
এমনকি ওর মা ও আমাকে চিনবেন না।
তবে আমি যদি নিজের পরিচয় দিই,
তবে দিপের
মা বাবা আমাকে চিনতে পারবেন।
আমি ভাবলাম দীর্ঘ ১৭ বছর পর
আমাকে দেখতে পেয়ে ওরা খুব
আনন্দিত হবে। সেই সাথে দিপুর
মা দিপুকে বলবে “দেখত
একে চিনতে পার কিনা? ” তখন দিপ
অবাক হয়ে আমার
দিকে তাকিয়ে থাকবে তারপর
বলবে “না।” দিপুর মা তখন বিস্তারিত
সব কিছু বলতে শুরু করবে।
প্রথমে বলবে আমার মায়ের
কথা;তারপর আমার বাবার কথা;তারপর
আমার ভাইয়ের কথা। দিপুর
মা আমাকে প্রশ্ন করবে “আপা কেমন
আছে? কি করছে” ইত্যাদি। দিপুর
বাবাও অনেক কিছু জানতে চাইবে।
দিপের ভাই জিতু
জানতে চাইবে ভাইয়ার কথা।
ভাইয়া এখন কি করছে,
লেখা পড়া কতদুর ইত্যাদি। সব
শেষে আমার
বিষয়ে জানতে চাইবে সবাই।
আমি সব বলতে থাকব আর সবাই খুব আগ্রহ
নিয়ে শুনতে থাকবে। আমি হয়ে উঠব
সকলের আকর্ষনের পাত্র।
আমি ভাবলাম এত দিন
পরে আমি তাদের
সাথে কিভাবে কথা বলব। দুরুত্ব মাত্র
৭ কিলমিটার। তাই তারাতারিই
পৌছে গেলাম।
আমি সাইকেলটি স্কুলের এক
কোনে তালাবন্ধ করে রাখলাম আর
চারপাশের
পরিবেশটা একনজরে দেখে নিলাম।
আমি স্কুল আর স্কলের মাঠটাকে অনেক
বড় ভেবেছিলাম। এখন
বাস্তবে দেখে ওগুলো আমার
কাছে ছোট মনে হল। তবে স্কুলটা এখন
ভবনে পরিনত হয়েছে। কিন্তু
মাঠটি দেখে মনে হল আগের মতই
আছে। তার লক্ষন হিসেবে বলা যায়
মাঠের সবুজ ঘাস
যা আমি দেখেছিলাম ১৭ বছর আগে;
তেমনই আছে। আসে পাশের প্রধান ও
অপ্রধান
রাস্তাগুলো পাকা করা যা ১৭ বছর
আগে কাঁচা দেখেছিলাম।
আমি কল্পনা করতাম স্কুল মাঠটায়
ছেলেরা দল বেঁধে খেলাধুলা করে;
কিন্তু দেখলাম বিকেলবেলাও
মাঠটি শুন্য। তবে রাস্তায় কয়েকজন
লোককে ঘোরা ফেরা করতে দেখলাম।
আমি নিশ্চিত ওদের কাছে দিপের
নাম বললে ওরা চিনতে পারবে।
আমার স্পষ্ট মনে আছে স্কুল
থেকে আমাদের বাড়িটা ছিল মাত্র
দুই মিনিটের পথ; উত্তর দিকে।
আমি বাড়িটার
সামনে এসে দাড়ালাম
যে বাড়িটা আমরা ১৭ বছর
আগে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম।
আমার মনে আছে আমাদের বাড়ির
পাশেই দিপদের বাড়ি ছিল। আমি সব
কিছু স্থীর হয়ে দেখতে লাগলাম।
আমাদের ঘরটা যেখানে ছিল
সেখানে ঘরের চিহ্ন পর্যন্ত নেই।
আমি দেখলাম রাস্তা দিয়ে অনেক
লোকজন যাওয়া আসা করছে।
আমি চিন্তা করলাম ওরা যদি আমার
পরিচয় জানতে চায় তাহলে কি আসল
পরিচয় বলব নাকি এড়িয়ে যাব।
আমি দিপদের বাড়িটায় একজন বয়স্ক
মানুষ দেখতে পেলাম। আমি অনুমান
করলাম লোকটা হয়ত দিপের
বাবা হতে পারে। কিছুক্ষন পর একজন
মধ্য বয়স্ক মহিলাকে দেখতে পেলাম।
আমি নিশ্চিত ওই মহিলাই দিপুর
মা যিনি আমার
মাকে আপা বলে ডাকতেন। আমার সব
চেয়ে বেশি দেখতে ইচ্ছে করল
আমার ছোট বেলার প্রথম ও ঘনিষ্ট বন্ধু
দিপকে। কিন্তু দেখতে পেলাম না।
কিছুক্ষন দিপদের বাড়ির
সামনে ঘোরা ফেরা করলাম আর
ভাবছিলাম বাড়ির ভিতর
গিয়ে নিজের পরিচয় দেব কিনা।
কিন্তু কেন জানি সাহস পেলাম না।
আমি স্কুল মাঠের
কাছাকাছি আসতেই মাঠের
দিকে চিৎকার
চেঁচামেচি শুনতে পেলাম।
আমি দেখলাম একদল ছেলে মাঠের
মধ্যে ফুটবল খেলতে শুরু করেছে।
আমি খুব আগ্রহ নিয়ে ওদের
খেলা দেখতে লাগলাম আর ভাবলাম
ওদের ভিতরে দিপ আছে কিনা।
খেলার মাঠের পরিবেশটা আমার
কাছে চিরচেনা মনে হল। আমার
মনে পরল দিপ আর আমি এই মাঠের
পাশে দাড়িয়ে বড়দের ফুটবল
খেলা দেখতাম; দিপ একটা নতুন ফুটবল
কিনেছিল; আমরা সারাদিন ফুটবল
নিয়ে মেতে থাকতাম।
বর্ষাকালে ছোট ছোট ঢালু যায়গায়
পানি জমত। আমরা সেই
পানিতে নৌকা আর জাহাজ
চালাটাম।
আমি দেখলাম ওরা মোট ৭ জন।
একটা দলে ৪ জন আরেকটা দলে ৩ জন
ভাগ হয়ে খেলা করছে। মিনি ফুটবল
খেলছে ওরা। হাড্ডা হাড্ডি লডাই
চলছে। আমি বুঝতে চেষ্টা করলাম
এদের ভিতর দিপ আছে কিনা। ১৭ বছর
আগের দিপের সৃতি আমার
মনে আছে কিন্তু ওর চেহারা আমার
একটুও মনে নেই। আমি ওর
চেহারাটা কল্পনা করার
চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুই স্পষ্ট
করতে পারলাম না। আমি ওদের
খেলা দেখছিলাম। হটাৎ ওদের ভিতর
একজন বলে উঠল ” দিপ খেলবি? ”
আমি রাস্তার দিকে তাকালাম আর
দিপ নামের
ছেলেটিকে দেখতে পেলাম। ও
মাঠে নামল। ওদের সাথে খেলতে শুরু
করল। আমি ওদের খেলা দেখছিলাম।
সেইসাথে দেখছিলাম ১৭ বছর পর
দিপের পরিবর্তন। দিপ
আমাকে চিনতে পারেনি।
চিনতে পারলে হয়ত বলত “তুই
দাড়িয়ে কি দেখছিস? আমাদের
সাথে খেলতে আয়।”
আমি সাইকেলটি নিয়ে বাড়ির
দিকে যেতে শুরু করলাম আর
মনে পরতে লাগল নদীর
গাংচিলেরা উড়ে বেড়ায়।
উড়তে উড়তে বহুদুর চলে যায়।
৭টি মন্তব্য
আবু জাকারিয়া
কেমন হল জানাবেন
লীলাবতী
ভালো হয়েছে ভাইয়া?কিন্তু লাইনের এ অবস্থা কেনো?আপনার লেখা কেমন হয়েছে জানতে চেয়েছেন বলেছি।এখন আমার লেখা কেমন জানান 🙂
নুসরাত মৌরিন
ভাইয়া গল্প ভাল এগিয়েছে কিন্তু লাইনগুলো এমন হয়ে যাওয়ায় পড়তে একটু সমস্যা লাগছে।আপনি চাইলে সম্পাদনা করে লেখাটিকে ঠিক ভাবে ফরম্যাট করে দিতে পারেন।
গল্পে ছোটবেলাকে বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন।
শুভকামনা রইলো। (y) -{@
হৃদয়ের স্পন্দন
স্মৃতিচারণ সাথে ভালোবাসার প্রকাশ, মনের গহীণে বাড়ি আর বন্ধু হারানোর দির্ঘশ্বাস, ভালো হয়েছে -{@
মরুভূমির জলদস্যু
“গ ল প” টা কি? গল্প?
নীলাঞ্জনা নীলা
কত ব্যস্ত ব্লগার/লেখক। ‘ গলপ ‘ পোষ্ট দিয়ে নিরুদ্দেশ। ফিরে আসুন আগে,এরপর গল্প পড়বো।
ছারপোকা
ছোটবেলার স্মৃতিচারন ভাল এ লেগেছে সেই সাথে বন্ধুর জন্য টান ।
হারিয়ে গিয়েছেন নাকি ? ফিরে আসুন তাড়াতাড়ি ।