এ পাড়ায় বিশাল বিশাল বিল্ডিং এর নীচ দিয়ে পাশে প্রবাহিত একটি খালের অপজিটে গড়ে উঠেছে কিছু ছিন্নমুল লোক
বসতির একটি বস্তি। সেখানে বেড়ে উঠা কিছু টুকাই ছেলে মেয়েরা রোজই উদোম পিঠে পিছনে প্লাষ্টিকের ব্যাগ নিয়ে কেউ টুকায় কাগজ, কেউ ড্রিংস এর কৌটা, কেউ বা অন্যান্য বস্তুয়াদি। তাদের একজন নান্টু। বেশ পরিপাটি থাকে সব সময়। এ সব কাজ তার ভাল লাগে না। তাই সে দিনের বেশীর ভাগ সময় বড় বড় শপিং কমপ্লেক্সগুলোতে কাষ্টমারদের ক্রয়কৃত মালামালের ব্যাগ কেরিং করত।তবে কাজে যাবার পূর্বে প্রতি দিন তার সম বয়সীদের সাথে কিছু ক্ষণ আড্ডা দিয়ে যেত।সেদিনও তাই করল সে তবে এক সময় তাদের আচরনে ক্ষুব্ধ হয়।এক দল ক্ষুদে কিশোরদের কয়েক জন রাস্তার এক পাশে ময়লা আবর্জনার স্তুবে ওদের রুজি রোজগার খুজেঁ বেড়াচ্ছে আর কয়েক জন ময়লা আর্বজনার স্তুবের এক পাশে বসে পলিথিনের মুখে নাক মুখ লাগিয়ে আইকা বা গামের নেশায় ব্যাস্ত।সেই পথ দিয়েই যাচ্ছিল নান্টু হঠাৎ একজন ডাক দিল তাকে। সে ধীর গতিতে তাদের কাছা কাছি যেতেই তাকে হাত ধরে টান দিয়ে তাদের নেশার আসরে বসিয়ে পলিথিন একটা ধরিয়ে দিয়ে নেশা করার চাপ প্রয়োগ করতে থাকল।কিন্তু নান্টু কিছুতেই এ পথে যায়নি আর যাবেও না তাই সে হঠাৎ পলিথিনটা হাতে নিয়ে দিল দৌড়।সেদিনের পর হতে সে আর ওপথে যায় না।অন্য পথে তার কাজে সে চলে যায়।
ঈদের আছে আর মাত্র এক দিন বাকী,পরশু ঈদুল ফিতর।ঢাকার অভিজাত শপিংমলগুলোতে ক্রেতা বিক্রেতাদের বেশ ভীড়।নান্টু তার ছেড়া ময়লা শার্ট প্যান্ট পড়ে কাষ্টমারের খোজেঁ দাড়িয়ে আছে একটি শপিংমলের সিড়িতে।সে লক্ষ্য করল এক সাহেব তার দু’বাচ্চা ছেলে মেয়ের প্রচুর মার্কেট করে বের হচ্ছিল শপিংমল থেকে।সাহেবও মনে মনে খুজছিল কেউ এক জনকে যেন তার অতিরিক্ত মালামাল গুলো কেরিং করাতে পারেন,ঠিক সে সময় নান্টু তার সামনে গিয়ে হাজির।নান্টুকে দেখে তার বয়সের কথা ভেবে কেরিং করাতে সাহেব তেমন একটা আগ্রহ প্রকাশ করলেন না কিন্তু নান্টুর জোর আবদার।
-স্যার, আমি পারব,আপনি কোন চিন্তা কইরেন না,আমি পারব।
-তুমি পারবে কি পারবে না আমি তা আমি ভাবছি না।তোমার যে বয়স তাতে আমিতো শিশুশ্রম আইনে আটকা পড়ে যাব।
-স্যার কিছু মনে করবেন না, আপনাদের আইন কি আমাদের পেটের খিদে মেটাতে পারবে? আমার ঘরে ছোট এক বোন আছে, আছে মা বাবা। আমার কামাইয়ের উপর অনেকটা সংসার চলে।
-কেন? তোমার মা বাবা কাজ করেন না?
-বাবা কামলা দেয়, মা পরের বাড়ী ঝিয়ের কাজ করেন।
-তোমার কথা শুনেতো মনে হয় তুমি লেখা পড়া করেছ!
-হ, আমাগো গ্রামে দুই তিন ক্লাশ পাস করছিলাম। এরপর পদ্মায় যহন আমাগো ঘর বাড়ী ভাইঙ্গা লইয়া গেল তহন আমরা এই ঢাহা শহরে চইলা আহি।
-ওহ্…ভেরি স্যাড।
-স্যার আমাগো দুঃখের কথা হুনলে রাইতও পোহাইব না…দেন না স্যার আপনার ব্যাগগুলো।
-ও হ্যা নেও…এই কয়টা ব্যাগ তুমি লও।
ব্যাগগুলো কোনটা মাথায়, কোনটা দু’হাতে, কোনটা আবার বোগলের তলে নিয়ে শপিং মল হতে সিড়ি বেয়ে নীচে নামতে লাগল এবং চলন্ত অবস্থায় কথপোকথন চলছে।
-স্যার, আপনি কি গাড়ী আনছেন?
-হ্যা,
-তাইলে ড্রাইভারকে দিয়েওতো কেরিং করাতে পারতেন।
-না না, ওনি আমাদের শুধু ড্রাইভার না ওনি আমাকে আমার চৌদ্দ পূরুষদের রক্ষণা বেক্ষক।ওনাকে নীচে গাড়ীতে রেখেই আমরা শপিংয়ে এসেছি।আসতে চেয়েছিলো, তার কষ্ট হবে ভেবে ওনাকে নিয়ে আসিনি।
-ও’ তাই। আপনি খুব ভালা মানুষ।
সাথে চলা সাহেবের ওর সম বয়সী ফুটফুটে দুই সন্তানদের দেখে বললেন।
-ওরা কে হয় আপনার ?
-এ হল আমার মেয়ে টুম্পা আর ছেলে আরবান।
টুম্পা আর আরবান দু’জনেই নান্টুকে হাই হ্যালো জানাল।সেও সাদরে হাসি মুখে হাই হ্যালোর উত্তর দিল।এর মধ্যে সাহেব তার প্রাইভেট কারের নিকট এসে গেল। ড্রাইভার প্র্রাইভেট কারের দরজা খুলে দিলেন, নান্টু ব্যাগগুলোকে কারের পিছনে রেখে সাহেবের কাছে এল। টুম্পা আরবান আর ড্রাইভার গাড়ীতে গিয়ে বসল। সাহেব এবার আরেক চিন্তায় পড়লেন।ব্যাগগুলোকে তার রুম পর্যন্ত কে নিয়ে যাবে।বাড়ীর চাকর বাকরদেরতো ঈদের ছুটিতে তিন দিন আগেই ছেড়ে দিয়েছেন।মনে মনে ভাবলেন ছেলেটিকে সাথে করে নিয়ে গেলে কেমন হয়।
-আচ্ছা, তোমার নাম যেন কি?
-নান্টু।
-ও হ্যা, তা তুমি কি আমাদের সাথে আমার বাসা পর্যন্ত যেতে পারবে?
-কেন যামুনা স্যার।এডাইতো আমার কাম।
-ঠিক আছে তাহলে টেক্সিতে উঠো।
এর মধ্যে তার মেয়ে গাড়ী থেকে নেমে তার বাবাকে ইঁশারা করল,যেন তার এক কান মেয়ের মুখের বরাবর রাখেন।তার মেয়েটি সাধারণতঃ কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাইলে এ ভাবে তার বাবার কানে কানে বলে।সেও বুঝতে পারেন লাজুক মেয়ে তার বাবাকে কিছু বলতে চায়।বাবা কান পেতে দিল।মেয়ে ফিস ফিস করে কি যেন বলল।অতপর নান্টুকে বলল।
-চলো আবার একটু শপিং মলে যাব।
-চলেন।
সাহেব এবং নান্টু আবারো শপিংমলে গেলেন।নান্টুর পছন্দ মত একটি কমপ্লিট সুট ক্রয় করেন যা নান্টু কিনা শপিংমলের ড্রেসিং রুম হতেই পরিধান করে ফিরে এল গাড়ীর সামনে।পড়নের আগের জামাটা সেই শপিং ব্যাগে ভরে সাথে নিল।নান্টুর চোখ জলে ছলছল।সে সাহেবের পা ছুয়েঁ সালাম করল।
-স্যার, আমার এ জীবনে বহু মানুষের সাথে দেখা হয়েছে, হয়…কিন্তু কেউ বলে, “যা টুকাই জাহান্নামে যা, কেউ বলে ফকিন্নিরপুত যা বাগ” কিন্তু আপনার মত এমন ভাল মানুষ এই প্রথম পেলাম।আল্লাহ আপনেরে আরো বড় করুক।
-ঠিক আছে, ঠিক আছে…চলো এবার।
নান্টু সাহেব সেজেঁ টেক্সি করে সাহেবদের বাসায় গিয়ে নেমে দেখল সাহেবের বাসাটা তার বস্তির অনেকটা কাছা কাছি।সাহেবকে আঙ্গুল উচিয়ে বলল-স্যার ঐতো আমাদের বস্তি।সাহেব প্রত্যুত্তরে বলল।
-এ ভাবে নিজেকে ছোট ভাবতে নেই, বলো ঐতো আমাদের বাসা।আর হ্যা, ঈদের দিন আমরা তোমাদের ওখানে যাব মানে বাসায় যাব। নান্টু সাহেবদের সব মালপত্র রুমে রেখে বাহিরে এসে পড়নের তার স্যুট বদলিয়ে পুরাতনটা পড়ল।নতুন জামাটা শপিং ব্যাগে ভরে বাসার দিকে রওয়ানা হল।পথে কিছু কাজ সেরে বাসায় ফিরল রাতে।
নান্টু রাতে বাসায় ফিরে দেখল ঘরে তার মা বাবা কেউ নেই।ছোট বোনটিও মনমরা হয়ে চকির এক কোণে বসে ছিলো, ভাইকে দেখে দৌড়ে তার কাছে গিয়ে ভাইয়ের হাতের ব্যাগটিকে লক্ষ্য করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে বলল।
—ভাইয়া এইডা কি?আমার জামা আনছো?জানো ভাইয়া,আমার বান্ধবীরা না কত সুন্দর সুন্দর জামা কিনছে।আমার লাইগা কি তাই আনছো?
নান্টু বোনকে এখন কি বলবে বুঝতে পারছে না।স্বার্থপরের মত ছোট বোনটির জন্য জামা না এনে নিজের জন্য নিয়ে এল।এখন ছোট বোনটিকে কি জবাব দিবে।খুব চিন্তায় পড়ে গেল নান্টু।অবশেষে বোনটিকে মমতায় কোলে তুলে নিয়ে বলল হ্যা, এটা তোর জন্যই আনছি তয় এহন না সকালে মা বাবার সামনে তোকে পড়াব।শান্তনা দিয়ে আদুঁরে বোনটিকে ভাত খাওয়াইয়া ঘুম পাড়িয়ে দিল।
রাতে নান্টুর মা বাবা দুজনেরই যার যার কাজ থেকে বাসায় ফিরেন।দুজনেই ক্লান্ত।মা তার বাসা বাড়ী হতে রাতের সেহরীর জন্য টিফিন বাটিতে কিছু খাবার নিয়ে এলেন।বাবা বস্তি ঘরের ভাড়াটা দেবার জন্য ঘরে ঢুকে চকিতে বসে টাকাগুলো গণতে লাগলেন।টাকাগুলো গুণে দেখলো আরো একশ টাকা কম।নান্টুর মাকে ডাক দিল।এরই মধ্যে নান্টু জামার সেই ব্যাগটি হাতে নিয়ে আবারো বাহিরে বেরিয়ে পড়ল।নান্টুকে এ ভাবে হঠাৎ ঘর হতে বের হতে দেখে পিছু ডাক দিয়েও তাকে থামাতে পারেনি তার বাবা।
নান্টুর মা রাহেলা স্বামীর কাছে এসে আচঁলে হাত মুছতে মুছতে বলল।
-কি হয়েছে বলেন?
-কালকের পরদিন ঈদ! বাচ্চাদের লাইগাতো কিছুই আনা হলো না।আমার কাছে যা আছে তাতো ঘর ভাড়াটা দিতেও আরো একশ টাকা লাগে,,, ওদের জামা-কাপড়,দুধ,সেমাই-চিনি আনবো কি দিয়ে? বুঝতে পারছি না কি করব।
রাহেলা বললেন।
-গরীবের আবার ঈদ !
-তবুওতো,,,আমাদের কথা না হয় বাদই দিলাম, পোলাপাইন তো আর বুঝবে না অভাব কি।আর মা বাবা হয়েই আমাগো পরান কি সয় বলো!
রাহেলা চকিতে তার মুখোমুখি বসে কাপড়ের আচঁলে গিটবাধা গিট খুলে কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বললেন।
-এই নেন, এগুলো একখানে করে দেহেন, হয় কি না।
উৎসব এলেই এ সব খেটে খাওয়া মানুষ জন বেশ বিপাকে পড়ে যান।উৎসব এলে কিছুনা কিছু বাড়তি খরচতো অনিচ্ছায়ও করতে হয় অথচ ওদের জীবন ধারণের জন্য দৈনন্দিন কোন মতে পেটের ক্ষুধা নিবারণের আহারে টান লেগেই থাকে যা কি না নুন আনতে পান্তা ফুরালো অবস্থা।
রাহেলার স্বামী লাল মিয়া টাকাগুলো ভাজ করে গুণে দেখলেন। নাহ্ এখনো টান আরো পাচ ছয় টাকার। ততক্ষনে মা বাবার কথা বার্তার আওয়াজে মেয়েটি জেগে চোখ কচলাতে কচলাতে তাদের সামনে এসে বলল।
-বাবা…ওবাবা আমার লাল জামা আনছো?
ছোট চার পাচ বছরের মেয়েটি অনেকটা অভিমানের সুরে মা বাবাকে পড়নে তার ছেড়া জামার ছেড়া অংশটিতে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বলতে লাগল।
– এই দেখ ! জামা ছিড়া, আর একটাও নাই…ওরা (খেলার সাথীরা) কত সুন্দর সুন্দর জামা কিনছে, আমারে কিন্না দিবা না।
কি বলবেন এ জগতে কোন মতে পাশ কেটে যাওয়া পৃথিবীর এ অভাবী মানুষগুলো ! কি জবাব দিবেন তারা লোকে বলে বেহেস্তের ফুল এই ছোট শিশু কিশোরদের প্রশ্নের! যেখানে পৃথিবী সাম্যহীনতায় ডুবে আছে সেখানে এ সব অভাবী মা বাবার সন্তানদের প্রতি সব শখ আহলাদ কি ভাবে মেটাবে ! কি ভাবেই বা মন তৃপ্ত হবে স্বার্থক মা বাবার আদলে।রাহেলা এবং লাল মিয়ার অন্তর জ্বলে উঠে, মনে এ জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে যায়।শত বাধা দিয়েও লাল মিয়া তার চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দিচ্ছেন ঠিক সেই সময় নান্টুর দুহাতে দুটো শপিং ব্যাগ নিয়ে নান্টু হাজির।
-এইতো আমি নিয়া আইছি…।
ভাইকে দেখে বোন পিতার বুক ছেড়ে দৌড়ে ভাই এর কাছে গিয়ে বলল।
-কি আনছো!
-তোমার লাল জামা।এই নাও…।
জামাটি শপিং ব্যাগ হতে বের করতে না করতেই বোন জামাটি ভাইয়ের হাত হতে অনেকটা ছিনিয়ে নিল।জামাটার এ পিঠ ওপিঠ নেড়ে চেড়ে দেখল সে।সে এখন মহা খুশি।নান্টু খুশি মুখে মা বাবার মাঝে গিয়ে বসে বোনের খুশিতে সেও মিটমিটিয়ে হাসছে।নান্টু আরেকটি ব্যাগ হতে বাবার জন্য একটি পাঞ্জাবী আর মায়ের জন্য একটি নতুন কাপড় বের করে দিল।মা বাবা দু’জনেই ছেলের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।বাবা বলল।
-কিরে তুই এতো টাকা পাইলি কই?ঘর হতে বাহিরে যাওয়ার সময় তোর হাতের শপিং ব্যাগে কি ছিল?
-কিছুই না।
-তয় এত কিছু কিনলি টাকা পাইলি কই থেকে?
পিতার অনেক পিরাপিরিতে নান্টুর মুখ খুলল।
-শপিং কমপ্লেক্সে এক সাহেব আমারে অনেক দামী একটা কমপ্লিট স্যুট কিনে দিয়েছিল।বাসায় আইয়া দেহি বোন আমার জামার জন্য কাদঁছে।পরশু ঈদ,ওরতো জামা কিনতেই হবে তাই আমার স্যুটটা একজনের কাছে বিক্রি করে বোনটার জন্য ঐ লাল জামা আর তোমাদের লাইগা এই সব কিনলাম।
-আর?
-আর কি?
-তোর জন্য!তোর জন্য কিছুই কিনলি না!
-আমার জন্য লাগবে না…ছোট বোনটির মুখের হাসিই আমার ঈদের খুশি।তাছাড়া তোমরাইতো কইছো,ছেলেরা যহন বড় হয় তহন বাপ মা ছেলেদের সন্তান হয়ে যায়।
মা রাহেলা এবং বাবা লাল মিয়া মাত্র চৌদ্দ পনের বছরের ছেলে নান্টুর এমন আত্মত্যাগের দান কি ভাবে শোধ করবেন।মোমবাতির ন্যায় নিজেকে জ্বালিয়ে অন্যকে আলো দেয়া মোমের সম্ভব হলেও মানবের ক্ষেত্রে বিরল। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ পিতা হয়ে নিজের অক্ষমতায় কাদঁলেন। মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কান্নাময় কম্পনরত দু’ঠোটের ভাজেঁ ভাজেঁ ঈশ্বরের প্রতি প্রার্থণা “হে দয়াময় তুমি আমার ছেলেকে দেখে রেখো”।
পরদিন ফজরের আযানের পর ছেলে মেয়েকে ঘুমের ঘরে রেখে রাহেলাকে লাল মিয়া বলল।
-একটা কাজ পেয়েছি ওখানে কিছু টাকা পাওয়া যাবে,সেই টাকা দিয়ে বাজার থেকে নান্টুর জন্য সুন্দর সাদা একটা পাঞ্জাবী আর টুপি কিনে আনবো তারপর বাপ-বেটা মিলে ঈদের নামাজ পড়তে যাব।তোমারতো ছুটি দিছে সাহেবরা,তাই না?তুমি নান্টুরে আজ কাজে যেতে দিওনা,ওদের দেখে রেখো,আমি যত তাড়াতাড়ি পারি চলে আসব।
ঘুমন্ত ছেলে মেয়ের কপালে চুমো দিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে ঘর হতে বের হয়ে গেলেন লাল মিয়া।রাহেলা পতির ছায়া যতদূর দেখা যায় চেয়ে রইলেন।
সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো তবুও লাল মিয়ার আসার নাম নেই।ছেলে মেয়ের শত জিজ্ঞাসায় সন্ধ্যায় মায়ের কোন সঠিক জবাব পেল না।এ দিকে সারা বস্তিতে ছোট বড় মানুষদের ঈদের খুশির আমেজ।ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা আকাশে ঈদের চাদ উঠা নিয়ে আনন্দের মিছিলে মশগুল।রেডিও টিভিতে বাজছে…”রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ” সেই কালজয়ী গানের সূর।কোন আনন্দই যেন নান্টুর মনকে খুশির জোয়ারে ভাসাতে পারছে না।সে কেবলি “বাবা কেন এখনো আসছে না”-এই চিন্তায় মায়ের কাছে মনমরা হয়ে বসে আছে-বাবার প্রতীক্ষায়।
বস্তির গলিতে এক দিকে বাচ্চাদের ঈদ আনন্দ মিছিল যায় অন্য দিকে একটি লাশের লাশের ভ্যান গাড়ী আসছে। আশ পাশের মানুষজন অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে ফিসফাস শব্দে বলে-“কার লাশ যায়গো”। ভ্যান গাড়ীটি নান্টুদের ঘরে কাছে আসা
মাত্রই নান্টু মা এর হাত ছেড়ে দৌড়ে ভ্যান গাড়ীটির সামনে গেল। গাড়ীর সাথে ছিলো নান্টুদের প্রতিবেশী তার বাবার সাথে দিন মজুরের কামলা এক যুবক। ভয়ার্ত হৃদয়ে সে তাকে বার বার জিজ্ঞাসা করছে।
-আংকেল ও’আংকেল, আমার বাবা কৈ? আমার বাবারে তুমি দেখো নাই..সেই যে ভোরে কাজে গেছে আরতো এলো না। যুবক নান্টুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। রাহেলা খুব ধীর গতিতে ভ্যান গাড়ীর কাছে আসতেই বুঝতে পারলেন তার স্বামী আর নেই, সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন তার আপণ ঠিকানায়।
যুবকটির হাতে ছিলো একটি সাদা পাঞ্জাবী আর টুপি। পাঞ্জাবীটার প্রায় পুরো অংশটাই রক্তে লাল হয়ে আছে। পাঞ্জাবীটা নান্টুর হাতে দিয়ে বলল-“এই নাও তোমার পপাঞ্জাবী, তোমার বাবা তোমার জন্য কিনছিলেন।
নান্টু পাঞ্জাবীটা হাতে নিল। রক্তে লাল হয়ে গেল তার দু’হাত- এ যেন ঈদে মেহেদী রাঙ্গা তার হাত দুটো। ততক্ষণে ভ্যানে ওগলামুড়িতে লাল মিয়ার নিথর লাশটি উম্মুক্ত করা হয়।বাবা হারা এতিম নান্টুর চিৎকারে আকাশ ভারি হয়ে উঠল। রাহেলা স্বামী হারা এক চিৎকারে অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে ভ্যানে তার নিথর স্বামীর দেহে মাথা ঠেকিয়ে রইল।ছোট মেয়েটিও কাদঁছে অঝর নয়নে।
সব শেষে জানা যায়, লাল মিয়া কাজ শেষে টাকা হাতে পেয়ে ফুটপাত থেকে খোকার জন্য একটি সাদা পাঞ্জাবী আর টুপি কিনে বাড়ী ফিরছিল। বাসে উঠা মুহুর্তে হঠাৎ অন্য এক প্রান্ত হতে চলন্ত ট্রাক এসে তাকে পিষে রাস্তায় ফেলে চলে যায়। পরে পুলিশের তত্বাবধানে তাদের যাবতীয় কাজ সেরে লাল মিয়ার সাথে থাকা যুবকটির মাধ্যমে লাশ বাড়ীতে পৌছায়।
২৪টি মন্তব্য
সাবিনা ইয়াসমিন
আমি প্রথম ❤❤
মনির হোসেন মমি
হুম
ভাইয়ের পোষ্টের বোনের প্রথম মন্তব্য
ভাই হিসাবে গর্বিত।
সাবিনা ইয়াসমিন
এতো সুন্দর গল্প মমিভাই আর একটাও কখনো লেখেননি। পড়তে পড়তে তন্ময় হয়ে গেছি। পথশিশুরা কত দুর্বিষহ জীবন–যাপন করে তা আসলে আমাদের ভাবনার বাইরে। এদের দিয়ে কাজ করালে মামলা খেতে হবে এটা যেমন সত্য তেমনই এদের পেটের ক্ষুধা কাজ না করলে মিটবে না, তাও বাস্তব।
ঈঁদ সবার জীবনে আনন্দ বয়ে আনলেও কিছু মানুষের জন্যে ঈঁদ আতংকের নাম। বিশেষ করে আমাদের দেশে। এখানে ঈঁদ এলেই মানুষ একে অপরকে টাকার জন্য চাপ দিতে থাকে। হোক সেটা ঘর ভাড়া বা অন্যকোনো লেনাদেনায়। অথচ ঘর ভাড়ার চাপ না দিয়ে নান্টুদের ঈঁদ একটু হলেও ভালো হতো। ওর বাবার ঈদের দিন কাজে যেতে হতো না।
গল্প অনেক সুন্দর আর ভালো হয়েছে মমি ভাই। আরেকবার পরে একটু বানান ঠিক করে দিন প্লিজ। তাহলে সম্পাদকের উপর চাপ কমবে। ভালো থাকবেন, আর এমন সুন্দর মন নিয়ে থাকবেন। শুভ কামনা 🌹🌹
সাবিনা ইয়াসমিন
পড়ে হবে 😜
মনির হোসেন মমি
দোয়া করবেন বোন।
শাহরিন
কত কত স্বপ্ন বাস ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে যার প্রতিনিয়। আর কিছু কিছু চাপা দারিদ্র্যতায়।
মাহমুদ আল মেহেদী
অনেক ভালো লাগলো গল্পটা মনির ভাই। তন্ময় হয়ে পড়ে শুনালাম সঙ্গিনীকে, মুগ্ধ হয়ে শুনলো সে। ধন্যবাদ দিলুম মনে মনে দুজন, আপনাকে। অনেক চমৎকার লেখনি ভাই।
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ ভাইয়া।
রিতু জাহান
বুকটা কেমন যেনো করে উঠলো।
বৈষম্যের পৃথিবীতে মানুষই বৈষম্যের সৃষ্টি করে। মায়া কি যে এক জিনিস!!
এ পৃথিবী ছেড়ে যেতে হয় নিয়ম মেনে নিয়ম না মেনে। কেউ পিষে মারে কেউ মারে চিপে।
রক্তের ছোঁপের এ পাঞ্জাবি সন্তানকে করে দিবে রুক্ষ।
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ আপু।
স্বপ্নবিহীন মামুন
—সত্যিই অসাধারণ একটি গল্প ছিল। পড়ে খুবই ভালো লাগছে, এরকম ঘঠনা আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটছে।
মনির হোসেন মমি
হুম।ধন্যবাদ ভাইয়া।
ছাইরাছ হেলাল
এমন মৃত্যুর মিছিল আমাদের পিছু ছাড়ছে না।
যা কুড়ে খাচ্ছে আমাদের প্রতিনিয়ত।
ওদের বহু ঈদ নিরানন্দেই চলে যায়।
কঠিন বাস্তবতা লেখায় উঠে এসেছে।
তৌহিদ
অনেক ভালো একটি লেখা এটি মমি ভাই। এরকম কত স্বপ্ন যে ট্রাকের চাকায় চাপা পরে মৃত্যুবরণ করে তার খবর আমরা কি রাখি?
শুভকামনা জানবেন।
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ প্রিয় ভাইটি।
রাফি আরাফাত
হয়তো এভাবেই মরে যাচ্ছে হাজারো সপ্ন সেটা হয়তো কখনো আড়ালে, নয়তো প্রকাশ্যে। ভালো লাগছে লেখা ভাই।
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ ভাইয়া।
জিসান শা ইকরাম
মনটাই খারাপ হয়ে গেলো,
এত সুন্দর ভাবে নান্টু তাঁর ছোট বোন, বাবা, মা এর জন্য ঈদের জামা, কাপড় কিনে আনলো,
নান্টুর বাবা আনতে গেলো নান্টুর পাঞ্জাবী, সব শেষ করে দিলো ঘাতক ট্রাক।
গল্প ভালো হয়েছে মনির ভাই।
ঈদ ম্যাগাজিনের অন্যতম সেরা গল্প হবে এটি।
শুভ কামনা।
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ ভাইয়া।
মোঃ মজিবর রহমান
মানুষ কত অসহায় হত্ব পারে তা আমি এখন বুঝতেছি । আর এই অসহায়ত্ব নিয়ে অনেকের হাসিতামাশা দেখেছি।
ভাল লেখা। মনির ভাই।
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ ভাই।
সঞ্জয় মালাকার
অসহায় হত্ব জীবনে শুধুই হাসিতামশা তা এখন বুঝে।
পড়ে আনেক ভালো লেগেছে
শুভ কামনা ভাই 🌹🌹
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ ভাইয়া।
সঞ্জয় মালাকার
শুভেচ্ছা রই।