কেমন হতে পারে গনতান্ত্রিক সরকারের বিকল্প সরকার?
কোন না কোন সময় আমাদের মনে কি উঁকি দেয় না এমন প্রশ্ন?রাষ্ট্র বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে আমরা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সহ আরো কিছু পদ্ধতি সম্পর্কে পড়েছি। তবে চলুন দেখি কেমন হতে পারে হেনরি ডেভিড থরোর সরকারব্যবস্থা?আপনাদের সুবিধার্তে আমেরিকান প্রবন্ধ “সিভিল ডিসওবিডিয়ান্স” থেকে আমি মূলকথাগুলো তুলে ধরছি মাতৃভাষা বাংলায়।
থরো বলেছেন,
সেই সরকার উত্তম সরকার, যে শাসন করে সবচেয়ে কম।বরং সেই সরকার সর্বোত্তম সরকার, যে কোন শাসনই করে না।
সরকার কাজ করবে শুধু জরুরী মুহুর্তে। যেমন :ঘূর্ণিঝড়, বন্যা,খড়া ইত্যাদি দূর্যোগের মুহুর্তে সরকার সাহায্যের হাত বাড়াবে, পাশে এসে দাঁড়াবে।
থরোর মতে মানুষের বিবেকই হল সবচেয়ে বড় আদালত। তাই সেই বিবেকই মানুষকে শাসন করবে,নিয়ন্ত্রণ করবে, সরকার নয়।
আমাদেরকে আগে মানুষ হতে হবে,অতপর নাগরিক হতে হবে। অর্থাৎ অন্ধের মত সরকার যা বলে তাই শুনলে চলবে না,বরং নিজস্ব বিবেক দিয়ে তাকে যাচাই করে নিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, সরকারের কোন নিজস্ব বিবেক নেই, আছে শুধু কিছু নিয়ম নীতি। যেমন, ওপর থেকে আদেশ এল, মিছিলরত মানুষের ওপর গুলি চালাও। তখন ভাল কি মন্দ তা ভাবার সুযোগ পুলিশের নেই। অর্থাৎ বিবেকের কথা শোনার কোন সুযোগ তাদের নেই। গুলি তাদেরকে চালাতেই হবে।
আবার, সরকারের কোন বিবেক না থাকলেও থাকে কিছু ক্ষমতা বা শক্তি, যা তারা সাধারন মানুষের ওপর প্রয়োগ করে মানুষকে আইন মানতে বাধ্য করে।
কিন্তু মানুষের রয়েছে বিবেক, যা তাকে বুঝতে সাহায্য করে কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল। তিনি উদাহরন দিয়ে বলেছেন, কোন চারাগাছকে তার নিজের নিয়মে বাড়তে না দিলে গাছটি যেমন মরে যায়, তেমনি মানুষকে তার নিজের নিয়মে অর্থাৎ তার বিবেক অনুসারে চলতে না দিলে মানুষও ঠিকভাবে বাঁচতে পারেনা।
তিনি আরো বলেন, ভোট দিয়ে সরকার গঠন করা মানে স্বাধীনতা নয়, বরং এর মানে হল,নিজের স্বাধীনতাকে অন্যের হাতে সোপর্দ করা।
এবার তিনি দেখিয়েছেন, রাষ্ট্র পরিচলানা করতে গিয়ে সরকার যদি কোন অন্যায় সিদ্ধান্ত বা ভুল পদক্ষেপ নেয়, তবে জনগন কিকরে তা প্রতিহত করবে?
প্রথমেই তিনি বলেন, জনগন যদি দেখে সরকারের সিদ্ধান্ত তাদের বিবেকের সাথে সাংঘর্ষিক, তখন তারা এই আইন মানবে না।
তারা সরকারকে অসহযোগিতা করবে, দরকার হলে ট্যাক্স দেয়া বন্ধ করে দেবে।
বেশির ভাগ লোক যদি ট্যাক্স দেয়া বন্ধ করে দেয়, তখন সরকার তাদেরকে জেলে ঢোকাবে। কিন্তু কতজনকে জেলে ঢোকাবে? বেশিরভাগ ভাল মানুষ যদি জেলে চলে যায়, শুধু খারাপরা বাইরে থাকে, তখন সরকার বাধ্য হবে তার আইনকে পূনর্বিবেচনা করতে।
এতে করে সরকার যদি তার (ভাল মানুষের) সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেয়,তবে নিক। ভাল মানুষের সম্পদ এমনিতেই কম থাকে। তাছাড়া, যার সম্পদ যত কম,তার চিন্তাও তত কম।
তিনি এ বিষয়ে স্মৃতিচারণ করে বলেন, একটা বিষয়ে সরকারের সাথে তাঁর মতামত না মেলাতে,তিনি ছ’বছর ট্যাক্স দেননি। অতপর জেলে যান।
কিন্তু তিনি উপলব্ধি করেন, জেলে থেকে তার শুধু মাত্র শারীরিক শাস্তিটুকু পাওয়া হয়, কিন্তু মানসিকতার কোন পরিবর্তন আসেনা। অর্থাৎ রাষ্ট্র সৃষ্ট আইন ও রাষ্ট্র প্রদত্ত শাস্তি একটা মানুষকে কখনো নীতিবান করতে পারেনা। তার অশুদ্ধ আত্নাকে শুদ্ধ করতে পারেনা। সেটা একমাত্র মানুষের ভেতরের আইনের দ্বারাই সম্ভব।
তাঁর মতে, একজন সত্যবাদী নাগরিক দূর্নীতিপরায়ন রাষ্ট্রের জন্য মারাত্নক হুমকি।
একজন সরকারী চাকরিজীবী, যেমন ট্যাক্স সংগ্রাহক, তিনি যদি সৎ হন, তবে তার উচিত হবে নিজ চাকরি থেকে অব্যাহতি নেওয়া। এভাবে সকল কর্মকর্তা, কর্মচারী যদি চাকরি থেকে অবসর নেয়,তখন সরকার অচল হয়ে পরবে এবং বাধ্য হবে তার আইন সংশোধন করতে।
অপরদিকে,
অসৎ ও ধনী নাগরিকরা তাদের আত্নাকে সরকারের নিকট বিক্রি করে দেয়, তাই তাদের নিজস্ব কোন ভাল মন্দ জ্ঞান নেই। তারা শুধু সরকারের চামচেমী করে আয়েশে দিন পার করে।
রাষ্ট্র অনেকসময় নিজ স্বার্থে মানুষকে ধংসের দিকে ঠেলে দেয়। তাদের দূর্নীতি ঢাকতে, জনগনের দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘুড়িয়ে দেবার জন্য অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত করে জননগনকে। এতে যা ক্ষয়ক্ষতি, সব সাধারন জনগনের হয়। যেমন : আমেরিকা তার দূর্ভিক্ষের দায় এড়াতে ম্যাক্সিকোর সাথে যুদ্ধের ডাক দিয়েছিল। তাই জনগনের উচিত এমতাবস্থায় নিজের বিবেককে কাজে লাগানো।
জনগনের ট্যাক্সের টাকায় তারা যুদ্ধ করবে, নিজেদের অস্ত্র বেচাকেনা করবে, তাতো হতে পারেনা। তাই সকল জনগন ট্যাক্স দেয়া বন্ধ করে দেবে, সরকারী কর্মকর্তারা তাদের পদ ছেড়ে দেবে। তখন সরকার তার সিদ্ধান্ত
বদলাতে বাধ্য হবে।
যাই হোক, থরোর মতে, সরকারের বিরোধীতা করতে চাইলে করতে হবেবে অহিংস অান্দোলনের মাধ্যমে, সরকারকে অসহযোগিতা করে।থরো কখনো বিরোধীতা করার অস্ত্র হিসেবে জ্বালাও পোড়াও, ভাঙচুর,রক্তবন্যা ইত্যাদিকে সমর্থন করেন নি। তিনি দেখিয়েছেন, কতটা নীরব ও শান্ত হয়ে ন্যায্য দাবীর নিমিত্তে আন্দোলন করা যায়।
পরিশেষে বলা যায়, থরোর এ কাল্পনিক পদ্ধতি হয়তো পুরোপুরি মেনে চলা সম্ভব নয়, তবে এটা আমাদের চিন্তাজগতে নতুন সূর্যরশ্মি হয়ে প্রবেশ করতে পারে। আমরা পুরোটা না হলেও কিছুটা ধারনা গ্রহন করতে পারি,কি উপায়ে সৎভাবে বাঁচা যায় এবং ধংসাত্নক রাজনীতি ও অান্দোলনের পরিবর্তে কিভাবে অহিংস অন্দোলনের মাধ্যমে ন্যায়নীতিকে প্রতিষ্ঠা করা যায়।
সিভিল ডিজওবিডিয়্যান্স
হেনরী ডেভিড থরো
থেকে মূলকথা: নীরা সাদীয়া
২০টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
দারুণ একটা পোষ্ট! আমাদের দেশের সরকার জীবনেও এতোকিছু মেনে চলতে পারবেনা। আর সাধারণ জনগণ তো আছে নিজের চরকায় তেল দিতে। বেশিরভাগ মানুষ আছে চামচামি করতে।
নীরা তোমার এসব ভিন্নতর পোষ্টগুলো সোনেলার সম্পদ।
নীরা সাদীয়া
দিদি, আপনারা আমার পোস্ট পড়েন, এটাই আমার অনেক বড় পাওয়া। সোনেলাতে এসেই আমি এমন পাঠক পেয়েছি, যারা সুচিন্তিত মতামত দিয়ে আমাকে অণুপ্রানিত করেন। বরাবরই আপনার মিষ্টি মন্তব্যে অাপ্লুত হই। ভাল থাকবেন। শুভকামনা। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
তোমার লেখা আরোও সমৃদ্ধ হোক।
ভালো থেকো।
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ ও শুভকামনা জানবেন।
নীহারিকা
সৎ ও বিবেকবান জনগণ ছাড়া দেশ চালালে দেশ রসাতলে যাবেই। শুধুমাত্র এই দুই গুনাবলীসম্পন্ন জনসম্পদ থাকলে সরকারকেও দেশ চালাতে বেগ পেতে হয় না বা সরকারও স্বেচ্ছাচারিতা করতে পারে না। তাতে উভয়েরই লাভ।
ভালো লেগেছে লেখাটি।
নীরা সাদীয়া
একদম ঠিক বলেছেন। সততা শব্দটি যেন কোথায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে এই অবস্থা আজ।
শুভকামনা রইল।
মিষ্টি জিন
এই কথা গুলো শিক্ষিত এবং বিবেকবান মানুষদের জন্য। আমাদের জন্য নয়।এসব মানে বলেই উন্নত দেশ গুলো আস্তে আস্তে উন্নতির শিখরে পৌছে যাচ্ছে। আর আমরা দিন দিন পিছু হচ্ছি।
আমাদের শিরা উপশিরায় দূরনীতি। বিবেক কি তা খেতে কেমন তা আমরা জানি না।
অনেক ভাল একটা পোষ্ট ।বেশ পরিপক্ক তোমার লেখনি।
নীরা সাদীয়া
খুব ভাল বলেছেন। আমাদের মাঝে দেশপ্রেমের খুব অভাব। সততা নেই বললেই চলে। এজন্যই পিছিয়ে যাচ্ছি আমরা প্রতিনিয়ত।
অনেক শুভকামনা রইল।
জিসান শা ইকরাম
এসব আমাদের দেশের প্রক্ষাপটে আকাশ কুসুম কল্পনা,
যদিও এমন হওয়াটা অসম্ভব কিছু না,
এমন কিছু কিছু দেশে আছে।
ভাল পোষ্ট।
নীরা সাদীয়া
ধন্যবাদ। যদিও এটা সম্ভব না, তবু থরো একটা নতুন আইডিয়া দিয়েছেন, যা আমাদের মনে নতুন চিন্তার খোরাক জোগায়।
ধন্যবাদ দাদা।
ছাইরাছ হেলাল
হেনরি ডেভিড থরোর নামই জানিনা, অবশ্য জানার কোথাও না।
এমন একটি ব্যবস্থাপনা হতে পারে জেনে রাখলাম।
তবে আপনি আপনার পছন্দানুযায়ী অনুবাদ করতে থাকুন, আমরা উপকৃত হব।
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। শুভকামনা রইল।
ইঞ্জা
দারুণ পোষ্ট, দুঃখজনক ভাবে এই দেশের সরকার এইসব চাইনা বা হতেও দেবেনা।
নীরা সাদীয়া
এতে সরকারেরই ভাল হত। সকল মানুষ যদি ন্যায়নীতি মেনে চলত, দেশ কতদূর এগিয়ে যেত।
শুভকামনা।
ইঞ্জা
সরকার তার ভালো বুঝে বলেই তারা এইসব করবেনা, ভোট পাওয়ার পর ওরা রাবণ হয়ে যায়।
নীরা সাদীয়া
সরকারে দলে যদি অসৎ লোকের বসবাস থাকে তবেতো সমস্যাটা গোঁড়াতেই।
সঞ্জয় কুমার
আমাদের সরকার এখন প্লান করছে কিভাবে জনগনের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ভ্যাট নেয়া যায় !
অথচ দূর্ণিতী বাজ ঋন খেলাপি, গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে
নীরা সাদীয়া
হুম। সৎ লোকেদের সারাক্ষণ কোণঠাসা হতে হচ্ছে। কিন্তু সকল ভাল মানুষ একজোট হলে সবকিছুর মূলকে উপড়ে ফেলা যেত।
অপার্থিব
প্রথমত সরকার নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সেটা কি প্রক্রিয়ায় গঠিত সরকার তা নিয়ে আলোচনা জরুরী। দেশে যদি সুষ্ঠ গণতান্ত্রীক শাসন ব্যবস্থা বিরাজমান থাকে তবে যে কোন সরকার তার নাগরিকদের উপর গুলি চালাতে কিংবা জনগণের কল্যাণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নীতি প্রণয়ন করতে দুই বার ভাববে কারন একটা সময় তাকে ভোটের জন্য আবার সেই জনগণের কাছে যেতে হবে তবে সেই সরকার যদি স্বৈর তান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কিংবা কর্পোরেট মদদে গঠিত হয় তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। আমাদের দেশে এরশাদ আমলে গদি রক্ষায় এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সো কলড গণতান্ত্রীক সরকারের আমলে কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষায়(যেমন ফুলবাড়িতে এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে আন্দোলন) জনগণের উপর গুলি চালানোর উদাহরণ দেখা গেছে। আধুনিক গণতন্ত্রে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা একটা অনেক বড় বিষয় । গণ মাধ্যম সরকারের অন্যায় কাজের সমালোচনা করে, জনগণের রাগ ক্ষোভকে সরকারের সামনে তুলে ধরে , সংসদে প্রচলিত বিরোধী দলের বাইরে সরকারের এগেইনষ্টে আরো একটা নুতুন বিরোধী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
ভাল পোস্ট। চালিয়ে যান
নীরা সাদীয়া
সুন্দর বলেছেন। গঠনমূলক সমালোচনা। ধন্যবাদ আপনাকে।