চতুর্থ অংশ…
বাস থেকে নেবে আনোয়ারশা রোডের ঠিক সামনের রাস্তা, হরিপদ দত্ত লেনের দিকে হাঁটতে লাগলেন। এক ধরণের অদ্ভুত রোমাঞ্চ অনুভব করতে লাগলেন। সব কিছু পাল্টে গেছে, রাস্তার ডান দিকের বিরাট পুকুরের কোন অস্তিত্ব নেই। ঝোপঝাড় ছোট বড় জঙ্গল সব সাফ হয়ে গেছে। তার পরিবর্তে দাঁড়িয়ে আছে কিছু বড় বড় বাড়ি। চেনার মধ্যেও মাঝে মাঝে পুরনো ঘর দুচারটে আছে বই কি! বাঁদিকে তালার কারখানা ছিল, কল্পনাদের ছিল, কারখানার নাম আজ কমলেশের মনে নেই। এবার আসবে–বাঁ দিকে অনিল সরকারের বাড়ি, অনিল কুটির, ৩৪/১, বাড়িটার দিকে যত এগোছিলেন তিনি ততই উত্তেজনার অনুভবটা বেড়ে যাচ্ছিল তাঁর। কোন নাটকের দৃশ্য বলে মনে হচ্ছিল, কিছুদিন আগেই এখানে তিনি এসেছেন এমনি একটা ভাব এনে, সতের বছর পর আবার দরজার কড়া নাড়া দিলেন কমলেশ। একবার, দু বার, তিন বার।
দু তিনটে মেয়ে এসে দরজা খুলল, কাকে চাই? কোন দিন না দেখা যুবককে দেখে আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল মেয়েদের মধ্যে একজন।
–দিলীপ আছে? -স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন করলেন কমলেশ।
কমলেশের অনেক বার মনে হয়ে ছিল, দিলীপরা এখানে থাকবে তো!–এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে কে জানে মানুষের কত কিছু ঘটনা ঘটে যেতে পারে! এমনও তো হতে পারে যে দিলীপ আর নেই–মারা গেছে অনেকদিন আগে! হাজার প্রশ্ন কমলেশের মনে এসে ভিড় করছিল।
মেয়েটা বলল, আপনি কে?
কমলেশ দ্বিধাহীন ভাবে বললেন, বলো, বন্ধু কমল এসেছে।
সতের বছর পর বন্ধু, কমলেশকে চিনতে না পারারই কথা, বন্ধুত্ব তো ছিল সতের বছর আগের, দুজন পাঁচ বছরের শিশুদের মধ্যে!
একজন যুবক নেমে আসছে, চেহারা চেনার প্রশ্ন উঠে না। নামে না চেনার কথা নয়, তবে কিছু সময় লাগবে স্মরণ করতে।
–কে আপনি? প্রশ্ন করে দিলীপ।
–চিনতে পারছিস না! আমি কমল, তোদের বাড়ির নীচ তলায় ভাড়া ছিলাম!…পুরনো স্মৃতির আবেগ নিয়ে কথা বলে ওঠেন কমলেশ। পর মুহূর্তে, কমল, বলে গলা জড়িয়ে ধরল দিলীপ, মনে কিসের দোলায় কান্নার ভাব এসে গেলো ওর। গদগদ হয়ে বন্ধু মিলন ঘটল। সে দৃশ্য যেন কোন নাটকীয় প্রেক্ষাপট ছিল।
হাজার প্রশ্ন করল পরস্পর পরস্পরকে। দিলীপের মা বাবা অনেক চিন্তা করে কমলেশকে চিনতে পারলেন। দিলীপের দিদিমা অনেক স্মরণ করেও চিনতে পারলেন না।
–কল্পনার বিয়ে হয়ে গেছে, জানালো দিলীপ।
–আর খোকন, চায়না ওদের খবর কি ? কমলেশ প্রশ্ন করেন।
–ওরাও বহুদিন আগে অন্য কোথাও চলে গেছে, ভাড়া ছিল তো তোদের মতই, দুরে কোথাও চলে গেছে, দিলীপ বলল।
–খুকু, পুতুল ওরাও ভাড়া ছিল, আমাদের পাশেই, ওরাও নিশ্চয় এখানে নেই ? প্রশ্ন করেন কমলেশ।
—ওরা টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর পাশেই কোথাও বাড়ি বানিয়ে চলে গেছে, দিলীপ বলে যায়।
তার মানে, দিলীপ ছাড়া বাকী বন্ধুরা কালের চক্রে ছিটকে গেছে কোন অজানায়!
কমলেশ সেই বিশাল তেঁতুল গাছ দেখলেন। শতাধিক বছর আয়ু নিয়ে তখনও বেঁচে ছিল সেটা! বৃদ্ধত্বের জড়তায় ভুগছিল। অর্ধেকের বেশী মরা ডালপালা নিয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এই গাছেই ছোট বেলা কমলেশ কাকেদের ঝাঁককে থাকতে দেখেছেন, কাকেরা এখনো হয়তো এ আস্তানা ছেড়ে যায় নি!
ছোট বেলার ওই বৃদ্ধ তেঁতুল গাছের রাতের করুণ কাক ডাকার এক ভোরেই কমলেশ দেখে ছিল, বিরাট বড়লোকের বাড়ির স্ত্রীর ক্যান্সারে মৃত্যু, রাস্তা ভরা ডাক্তারের গাড়ির ব্যর্থ অপেক্ষা!
দিলীপের সাথে দেখা হবার দিন কাকেরা বোধ হয় করুণ ডাক ডাকে নি, অথবা কাক ডাকা ভোর হয়তো কিছু ভালোর অপেক্ষা সূচক হবে!–তবেই তো দিলুর সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেলো কেমন নাটকীয় ভাবে! বাল্য বেলার সুখ, দুঃখের খেলাঘরের স্মৃতি চারণ হবার সুযোগ মিলল! যদিও কিছু বিয়োগের ব্যাপার ছিল, অনেক বাল্য সাথীরা হারিয়ে গিয়ে ছিল জনারণ্যে–কোন ধোঁয়াশা স্বপ্নের ভিতর!
ক্রমশ…
৬টি মন্তব্য
প্রহেলিকা
গল্পটি বেশ সুন্দর। গুছিয়ে লিখছেন। চলুক পাঠক হিসেবে সাথেই আছি। গল্প লেখা কঠিন লাগে তবে আপনি সেই কঠিন কাজটি সুন্দরভাবে করেছেন। আপনাকে অভিনন্দন।
তাপসকিরণ রায়
আমার পাঁচ বছর আগের লেখা গল্প। নিজের জীবনের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
স্বপ্ন নীলা
দারুন গোছানো একটি গল্প —— চলুক
তাপসকিরণ রায়
ধন্যবাদ জানাই।
জিসান শা ইকরাম
পড়ছি দাদা, লিখুন নিয়মিত ।
তাপসকিরণ রায়
ধন্যবাদ।