#করোনা_ছুটি_৪
ভোর ছয়টাতেই ঘুম ভাঙলো। কি যে বিরক্তিকর বিছানায় শুয়ে থাকা, আবার করবটাই বা কী? আজকেও দিনের শুরুটা আলো ঝলমলে। তবে অন্যান্য দিনগুলোর তুলনায় স্বচ্ছ আকাশ যা সাধারণত ঢাকা শহরে দেখাই যায় না। অনেকক্ষন জানালার পাশঘেঁষে বসে চারপাশটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। চারিপাশ নীরব নিস্তব্ধ। মনে হচ্ছে সবাই পড়ে ঘুমাচ্ছে। আবার শুয়ে কতোক্ষণ ফেসবুকিং করলাম। ফেসবুকে ঢুকে সাংবাদিক প্রবীর সিকদার দাদার মাধ্যমে জানলাম, ভারতের ব্যাঙ্গালোরে হাজারখানেকের মতো বাংলাদেশী আটকা পড়েছে অথচ আমাদের দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করলে তারা জানিয়েছে তাদের কিছু করার নেই। কী আজব! নিয়ে আসতে না পারুক, তারা যাতে নিরাপদে থাকতে পারে সে ব্যবস্থা তো সরকারি পর্যায় থেকে করা যেতে পারে, এভাবে ডাইরেক্ট কিছু করার নাই বলা কী দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে ঠিক? যাহোক, নিশ্চয়ই ব্যবস্থা একটা কিছু হবে। হাউকাউ করতে হবে আরকি! এদিকে পত্রিকায় দেখছি, ঠাকুরগাঁওয়ে আড়াই বছরের শিশুসহ একই পরিবারের তিনজন ‘জ্বর ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায়’ আক্রান্ত। উফফ! এরথেকেও দুঃখের পরিস্থিতি এখন বিষয়টি জানাজানির পর এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, গ্রামবাসী তাদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে। এমন অবস্থায় পরিবারটি কোনো ধরনের চিকিৎসা সেবা না পেয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে। হায়! করোনা!!! বাঁচার কারণে মানুষ কতোটা স্বার্থপর হতে পারে করোনা হানা না দিলে এতোটা উদোম প্রকাশ ঘটতোই না। মন খারাপ নিয়ে নেট ছেড়ে উঠলাম। কুসুমগরম পানিতে নিত্যদিনের থাইরক্স ডোজটা নিয়ে চুলোয় চা চাপালাম আর ভদ্রলোককেও একমগ কুসুমগরম পানি কালোজিরাসমেত পান করতে দিলাম। ইতোমধ্যে তিনি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে টেলিভিশন ছেড়ে বসেছেন। আমি বিছানা গুছিয়ে এসে দেখি তিনি চা বানাতে কাপে দুধ চিনি মেশাচ্ছেন।
ডিপফ্রিজে চুইপিঠা ছিল, নামিয়ে রেখে চা খেতে খেতে খবরের আপডেট দেখা আর ফেসবুকিং করা চলছে। দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা তেমন না বাড়লেও ইতালি আর যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা দেখছি খুবই খারাপ। অবশ্য আমাদের দেশে ক’জন ই বা পরীক্ষার আওতায় আসছে। পরীক্ষা করার মতো কীট এখনও অপ্রতুল। তবুও মৃতের খবর তো আর চাপিয়ে রাখার মতো নয়। সে হিসাবে সার্বিক অবস্থা পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় তেমন কিছুই না। আজকে সাধারণ ছুটির চতুর্থ দিন চলছে। সেবাখাতগুলো ছাড়া আর সবই বন্ধ। ব্যাংকও সেবাখাতের আওতায়ই বলা চলে। ব্যাংক খোলা, তবে সীমিত সংখ্যক।
হায় আল্লাহ! কী বিভৎস! এ দেশের মানুষ এমন কেন? সারাবিশ্ব যেখানে এই দুর্দিনে সবাই একসাথে অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে। যে যার মতো করে আর্তের সেবায় সাপোর্ট হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সে জায়গায় আমার এ দেশে এসব কী শুনি? চট্টগ্রাম মালিরহাট বাজারে নাকি এক ব্যক্তি মাস্কের দাম কম রাখার কারণে ওই একই বাজারের প্রতিপক্ষ অন্যান্য ঔষধের দোকানদাররা মিলে ওসমান নামের লোকটিকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। চরম আত্মকেন্দ্রিক এক জাতিতে পরিণত হয়েছি আমরা। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তেই এসব মন খারাপের খবরগুলো এখন দেখতে হচ্ছে।
চুইপিঠাগুলো পাতলা করে কেটে পেয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে ভেজে সাথে দুটো ডিম ঝুঁরিভাজি করে সকালের নাস্তাটা শেষ হলো। মোজাফফর হোসেনের ‘তিমির যাত্রা’ বইটা নিয়ে বসলাম। এরইমধ্যে অফিসের দরকারী কিছু ফোনালাপ শেষ করে রান্না চড়াতে উঠে গেলাম। কী হবে রান্না? পাতলা ডাল, মিষ্টি কুমড়ো ভর্তা আর মুরগির মাংস। আজ আর ঘরমোছা নেই, কাপড় ধোয়াও নেই। এক চুলোয় ভাত আরেক চুলোয় ডাল চাপিয়ে লিখতে বসি। হঠাৎই মনে হলো ঐতিহাসিক লকডাউন নিয়ে ধারাবাহিক লিখে যাই। কর্মজীবী মানুষ আমি। এভাবে টানা কর্মহীন বাড়িতে বসে ছুটি উদযাপনটা কেমন হচ্ছে একটু লিখে ফেলাই যায়। ব্যস, রান্নার ফাঁকে ফাঁকে গতকালের সারাদিনের বিবরণ লিপিবদ্ধ হচ্ছে। রান্না শেষ, লেখাও প্রায় শেষ। বাকীটা গোসল সেরে খেয়েদেয়ে একনজর দেখে নিয়ে পোস্ট দেবো।
বাসায় থাকছি, সংকটাপন্ন বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে সারাদিনই টেলিভিশনটা খোলা থাকে। কেবল দুপুরের পর এ সময়টায় ঘন্টা দুয়েক বন্ধ থাকে। আজকে বিকাল বেলায় পাড়ার পোলাপানদের রাস্তায় একটু হৈচৈ করতে দেখা যাচ্ছে। মনেহয় আজ সেনাবাহিনী এখনও টহল দেয়নি। আমাদের আরও একটি জাতিগত সমস্যা আছে। লাঠি না দেখলে কেউ সোজা থাকে না। কারণ ছাড়াই রাস্তায় হাঁটাহাঁটির অভ্যাসের কারণে এই দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতেও তাদের লাঠি দেখিয়েই ঘরে আটকে রাখতে হয়। নিজেদের দায়িত্বশীল চলাফেরা নেই অথচ কথায় কথায় আমরা সরকারের পিণ্ডি চটকাতে ওস্তাদ।
যাহোক, বিকালে ঘুমাতে চাই না কিন্তু এ’কদিনে কেমন বিকালটা বিরক্তিকর লাগে, না চাইলেও একসময় ঘুম চাপে চোখে। বোরিং একটা সময় পার করছি। বই পড়তে পড়তেই ঘুম চেপে বসে।
সন্ধ্যার পর চা-নাস্তা সেরে সালেহ একটু বাজারে গেল কিছু সবজি আনতে। সবজি নিয়ে এসে টিস্যু দিয়ে কলিংবেল চাপলো। আমি দরজা খুলতেই বাইরের সেন্ডেল খুলে ঘরে ঢুকে কিছু স্পর্শ না করে হাতের ব্যাগটি ফ্লোরে রেখেই আগে বাইরের স্যান্ডেলটা নিয়ে ওয়াশরুমে রাখে। বালতিতে রাখা ব্লিচিং মেশানো পানি কয়েক মগ ঢেলে দেয়। এরপর নির্ধারিত স্থানে সবজিগুলো খুলে রেখে হাতটা ভাল করে সাবান দিয়ে ধুয়ে নেয়। ওই সবজিগুলো ৮/১০ ঘন্টা এভাবেই থাকবে।
এরপর যথারীতি টেলিভিশন খবর, ফেসবুক, বই একসময় রাত নামে। অতঃপর খেয়েদেয়ে ঘুম…
১১টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
করোনা আমাদের মানুষ বানাতে পারলো না। আমরা অন্যের সমালোচনাতেই আটকে আছি। খুব ভালো লাগছে আপনার দিনলিপি গুলো। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ।
ফয়জুল মহী
সুচিন্তিত মনোভাবের প্রকাশ, ভালোই ।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
শুভকামনা।
জিসান শা ইকরাম
আমরা বর্তমানে কতটা স্বার্থপর জাতিতে পরিনত হয়েছি, করোনা না আসলে তা বুঝা যেত না।
সব কিছুতে সমন্বয়ের অভাব দেখা যাচ্ছে। মহামারি লাগলে কত মানুষ যে মরবে বিনা চিকিৎসায় তা ভেবে শিউড়ে উঠছি।
করোনা দিনলিপি চলুক।
শুভ কামনা।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আমি সেটাই ভাবছি। এপ্রিলের ১০/১২ তারিখ নাগাদ পরিস্থিতি আদৌ কেমন দেখবো আল্লাহ মালুম। যদি তেমন প্রভাব না পড়ে তো বুঝতে হবে আল্লাহর অশেষ রহমত প্রাকৃতিক সাপোর্ট।
এস.জেড বাবু
সহানুভূতি শব্দটা হয়ত থাকবে-
“সাদর” শব্দটা জাদুঘরে যাবে।
করোনা আতংকে মানুষ বাইরে যাচ্ছে- কোন না কোনও উছিলায়।
ভালো লাগছে নিয়মিত পর্বগুলো।
সুস্থ থাকবেন।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আর দেবোনা এ টাইপ পোস্ট। কিছু ইনফরমেশন কালেক্ট করে পরে প্রকাশ করবো।
আপনিও সুস্থ থাকবেন।
এস.জেড বাবু
আপু
ভালই লাগছিলো- পর্বগুলো চালিয়ে যেতেন।
আমার মন্তব্যটা অসমাপ্ত ছিলো মনে হয়, দুঃখিত- করোনা প্রেক্ষাপটে আগত দিনে “সাদরে” ( হাত মিলিয়ে / বুক মিলিয়ে) এই অভ্যাসগুলো মানুষের মধ্যে থাকবেনা- এই রকম বুঝাতে বলেছি।
মানুষ মানুষকে ছুঁইতে ভয় পায়।
তবে “সহানুভূতি” বলতে মানষিক যে টান- সেটা থাকবে।
অবশ্যই লিখবেন- অপেক্ষায় থাকলাম।
হালিম নজরুল
ভারতের ব্যাঙ্গালোরে হাজারখানেকের মতো বাংলাদেশী আটকা পড়েছে অথচ আমাদের দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করলে তারা জানিয়েছে তাদের কিছু করার নেই। কী আজব! নিয়ে আসতে না পারুক, তারা যাতে নিরাপদে থাকতে পারে সে ব্যবস্থা তো সরকারি পর্যায় থেকে করা যেতে পারে।
——একমত
সুরাইয়া পারভীন
মানুষ যে শুধু নিজেকে ছাড়া আর কাউকে নিয়ে ভাবে না তা করোনা প্রমাণ করে ছাড়লো। নিজস্বর্থ ছাড়া যেনো আর কিছু ই করার নেই মানুষের।
লকডাউনের ৪দিন ভালো কাটুক।