কয়েক বছর আগে গুলশানের জাপানিজ একটা রেসটুরেন্টে স্কুল-কলেজের গেটটুগেদার পার্টিতে জনের সাথে প্রথম পরিচয়। স্কুলে পড়ার সময় একই শহরে থাকলেও তেমন চেনাজানা ছিলনা। পার্টির শেষদিকে সবাই আমাকে অনুরোধ করলো গান গাইতে । আমার বাবা রবীন্দ্র সংগীত খুব পছন্দ করতেন।উনি বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। ছোটবেলা থেকে আমাকে গান শেখা এবং আউটডোর গেমস গুলোতে প্রবল উৎসাহ দিতেন। বাবা মারা যাবার পর আর কখনো গান গাইতে ইচ্ছে করেনি। অনেক দিন পর গাইতে গেলাম..
মায়বন বিহারিনী হরিণী
গহন স্বপন সঞ্চারিনী
কেন তারে ধরিবারে করি পন
অকারণ
মায়াবন বিহারিনী
থাক থাক নিজ মনে দূরেতে
আমি শুধু বাসরীর সুরেতে
পরশ করিব ওর তন মন
অকারণ
মায়াবন বিহারিনী…
এতটুকু গাইবার পর গানের কথাগুলো আর মনে পরছে না….তখন ছেলেটা আমাকে মনে করিয়ে দিল…
—-চমকিবে ফাগুনেরো পবনে—
আর ভুল করলাম না
“বসিবে আকাশবাণী শ্রবনে
চমকিবে ফাগুনেরো পবনে
চিত্ত আগুনে হবে অনুভব
অকারণ”….
গান শেষ করার পর জানতে চাইলাম —তুমি গান গাইতে পারো..?
ও বললো ..না।
এভাবেই জনের সাথে টুকটাক পরিচয় পর্বটা শুরু হলো।
জনের সাথে আবার দেখা গেল জেরীর ১৮ তম ম্যারেজ এনিভারসারিতে। জেরী মুচকি হেসে বললো…দেখ তোর ফাগুনের পবন এসেছে..। আজকে আমরা সবাই অনেক সাজগোজ করে এসেছি ।জেরীর হাসবেন্ড খুবই রোমান্টিক এবং আমোদপ্রিয় মানুষ।এলাকার বিখ্যাত সব খাবারের (সুরবত আলীর কাচ্চি বিরিয়ানী, ননীর স্পন্জ রসগোল্লা ইত্যাদি )সংগে ৯০ দশকের সব রোমান্টিক গান বাজছিল সাউন্ড বারে। জেরী খুব ভাল রান্না করতে জানে..ও করেছিল দেশী বিদেশী বিভিন্ন ক্যারি , সালাদ এবং ডেজার্ট।ওর বাসায় ফেমাস সব চায়ের কালেকশন থেকে আমরা নিজেদের পছন্দ অনুয়ায়ী আবদার করছিলাম জেরীর কাছে। সেদিন আমি সাদার মধ্যে পিংক কাজকরা একটা জামদানী শাড়ী পড়েছিলাম ..কোঁকড়া চুলগুলো খুলেই রেখেছিলাম। ম্যাচিং চুড়ী -মালা , কানের দুল সাথে কপালে একটা পিংক কালারের টিপও দিয়েছিলাম। হঠাৎ জন আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো ..তোমার টি। প টা একটু সরে গেছে…ঠি ক করে দেই..। না করলাম না। কিছুটা খুশী হলাম ভেবে যে …জন আমাকে ভালোভাবে খেয়াল করেছে।
অনুষ্ঠান প্রায় শেষ ..। কথা ছিল জেরীর হাসবেন্ড আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসবে। উনি তখনও অতিথী নিয়ে ব্যাস্ত। জেরী , জনকে বললো ..তুমি বাড়ী যাবার সময় ওকে নামিয়ে দিও প্লিজ।
গাড়ীতে যাবার সময় অনেক আলাপ হলো।জানলাম ..জন ঢাকায় একাই থাকে..বিজনেস করে..তেমন কোন আত্মীয়-স্বজনও নেই। প্রেম করে বিয়ে করেছিল ..কোন সন্তান নেই ..আর তেমন কিছু বলেনি।
গতবছর পহেলা ফাল্গুনে বন্ধুরা সবাই মিলে গিয়েছিলাম জিন্দা পার্কে। পূর্বাচল থেকে ১৫ মিনিটের ড্রাইভ …কান্চন ব্রীজের কাছ থেকে টংগী রোডের দিকে যেতে হয়। ঢাকার কাছে ডে ট্যুরের জন্য এটা একটা ভাল জায়গা মনেহয় আমার কাছে।এটার সবচেয়ে সুন্দর লাগে রাউন্ড শেপের ৫-৬ তলা লাইব্রেরীটা। চমৎকার বই পড়ার পরিবেশ এবং নির্মল বাতাস। এখানে কোন ফ্যান নেই তবুও তেমন অস্বস্তি লাগেনা ..ডিজাইনটা সেভাবেই করা। সেদিন সবাই বাসন্তী রংয়ের শাড়ী পড়েছিলাম .. । লাইব্রেরীর বারান্দায় দাড়িয়ে জনের সাথে আলাপ করার সময় জানতে চাইলো ..আজকে টি প দিতে ভূলে গেছি নাকি। তখন ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে টিপের পাতা বের করে একটু রহস্য করে বললাম পড়িয়ে দাও….আমি ঠিক মতো দিতে পারিনা..।
সেদিনের পর জনের সাথে আর দেখা হয়নি আমার..। মেসেনজারে কুশল বিনিময় হয়েছিল কয়েকবার। নিজের কাজ , সংসার নিয়ে ব্যাস্ততার কারনে ওর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায়। একদিন সকালে জেরী ফোন করে বললো …খবর শুনেছিস..জন গতরাতে ৩০০ ফিট পূর্বাচল রোডে কার একসিডেন্টে মারা গেছে , লাশ কুর্মিটোলা হাসপাতালে রাখা আছে ,আমি যাচ্ছি ..তুই আসবি?।হঠাৎ করে বুকের ভেতর কেমন একটা শূন্যতা অনুভব করলাম। মনেপরে গেল জিন্দা পার্কের লাইব্রেরীতে জন আমাকে জীবনানন্দ দাশের কবিতাটি শুনিয়েছিল…ওর ভরাট কন্ঠে দারুন মানিয়েছিল…
“আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে …”
গাড়ীতে কুর্মিটোলা যাবার সময় ভ্যানিটি ব্যাগ খুলতেই চোখে পড়ে গেল টিপে র পাতাটা….কালো রংয়ের গুলো কখনো ব্যাবহার করা হয় নি ..। পাতাটি ফেলে দিলাম গাড়ীর জানালা দিয়ে…কার্তিকের নবান্নের দেশের রাজধানীতে…।
১৬টি মন্তব্য
সুপায়ন বড়ুয়া
বড়ই মর্মান্তিক হৃদয় বিদারক
যদি না হয় গল্প।
লেখায় আমায় মন কেড়েছে
যদি ও বা অল্প।
শুভ কামনা।
হালিম নজরুল
খুব ভাল উপস্থাপন
মনির হোসেন মমি
দারুণ রোমান্টিক গল্প।শেষের দিকটায় মন খারাপ হয়ে গেল জনের হঠাৎ মৃত্যুতে।জিন্দাপার্কটা আসলেই খুব সুন্দর ।ভাল লাগল।লিখুন আরো।
মনির হোসেন মমি
নামটা বাংলায় এবং প্রোঃ ছবিটা দিয়ে দিবেন। সোনেলায় অভিনন্দন শুভেচ্ছা।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
সুন্দর একটি বিয়োগান্তক গল্প পড়লাম। ধন্যবাদ আপনাকে। শুভ কামনা রইলো
কামাল উদ্দিন
সোনেলা ব্লগে সুস্বাগতম, লিখতে থাকুন সাথেই আছি।
ফয়জুল মহী
মুগ্ধতা এক রাশ I
রেহানা বীথি
এমন হঠাৎ চলে যাওয়াগুলো মেনে নেয়া যায় না। ভালো লিখেছেন।
জিসান শা ইকরাম
সোনেলার উঠোনে স্বাগতম আপনাকে,
নিয়মিত লেখুন, অন্য লেখকের লেখা পড়ুন।
শুভ ব্লগিং।
নিতাই বাবু
সোনেলায় আপনাকে স্বাগতম!
নাজিয়া তাসনিম
মানুষ একসময় থাকে না। আর তখন তার স্মৃতিগুলো পোড়ায়। টিপের পাতা ফেলে দিয়ে সাময়িক দুঃখ ভোলার চেষ্টাটাই তখন বাস্তবতা।
তৌহিদ
সোনেলায় স্বাগতম। সুন্দর একটি গল্প পড়লাম। ভালো লিখেন আপনি ভাই।
গল্পের নামার কেই শব্দটি কেউই হবে কি?
লিখুন, অন্যদের লেখায় মন্তব্য করুন। ভালো থাকবেন।
মহানন্দ
আপনাকে ধন্যবাদ ভাই
কামাল উদ্দিন
সুন্দর একটা গল্প, শেষের দিকে মনটা মন আদ্র হয়ে গেল, চালিয়ে যান ভাই, আছি সাথে সব সময়।
সাবিনা ইয়াসমিন
মায়বন বিহারিনী হরিণী
গহন স্বপন সঞ্চারিনী
কেন তারে ধরিবারে করি পন
অকারণ
মায়াবন বিহারিনী****** কিছু গান আছে মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে যায়, কিন্তু গাইতে গেলে থমকে যেতে হয়। গানের কথার সাথে সাথে ভিড় করে আরও অনেক কিছু।
ভিন্ন মাত্রার গল্প। পড়তে পড়তে মনেই হয়নি লেখক অন্য চরিত্রকে ( নারী) নিজের মাঝে ধারণ করেছেন! উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ সুন্দর ভাবেই ফুটে উঠেছে।
সোনেলা ব্লগ পরিবারে আপনাকে স্বাগতম দাদা।
নিয়মিত লিখুন, আপনার আরও লেখা পড়তে চাই।
শুভ কামনা 🌹🌹
মহানন্দ
ধন্যবাদ।