কনফেশন

জাকিয়া জেসমিন যূথী ৮ এপ্রিল ২০২০, বুধবার, ০৮:৪৪:২২অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২৬ মন্তব্য

 

অনেকেই জানেন দুই ভাইয়ের একমাত্র আদর ও শ্রদ্ধার বড় বোন আমি। আমার এক টুকরো হাসি আর আনন্দের জন্য দুটো ভাই কী না করে। এই যে আমার বর্তমান সত্তা, আমি বহুমুখী কার্যক্রমের সাথে মিশে আছি, যেমন প্রফেশনাল পরিচয়ে আমি একজন সফল গ্রাফিক ডিজাইনার। এর সাথে আরও যা যা করছি সবকিছুর পেছনে প্রধান উৎসাহ দাতা এই দুজন।

বিএড এ ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার উপহার হিসেবে বড় ভাইটা ডিজিটাল ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলো। তখন সে সানিএসবি (স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক) তে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পিএইচডি করছে এবং স্কলারশিপ এর অংশ হিসেবে সপ্তাহে ২০ ঘন্টার ক্লাশ নেয়ার বিপরীতে সে সামান্য কিছু ডলার ইনকাম করতো। সেই সামান্য ইনকাম থেকে ওর বাসা ভাড়া, থাকা খাওয়া খরচ বহন করতে হতো। দেশে আসার সময় সে এই ক্যামেরা কিনে নিয়ে এসেছিলো যাতে তার বোন সুন্দর দৃশ্য ক্যাপচার করে সেই ইমেজ থেকে অয়েল পেইন্টিং করতে পারে। চিত্রশিল্পের প্রতি বোনের যে অনেক আগ্রহ।

এম এড এর ফার্স্টক্লাসের উপহার ছিলো নোটবুক। যেন আপু তার মনের মাধুরী মিশিয়ে লেখালেখি করতে পারে। তখন সে গুগোলের পার্ট টাইম ইঞ্জিনিয়ার পদে কাজ করতো ভার্সিটির ছুটিতে। এরপরেও থেমে থাকে নি তার একের পর এক উপহার এবং তার বোনের হাত খরচের ব্যবস্থা করার।

যখন গুগোলে পার্মানেন্ট চাকরি হয়ে গেলো তখন দেশে টাকা পাঠানোর সময় ছোট ভাইয়ের মেইলে লিখতো বাবাকে যেন বলা হয়, “টাকা তুলে অতি অবশ্যই আপুর পার্লারের বিল, পোশাক আশাক কেনা সহ অন্যান্য খরচের জন্য প্রতি মাসের টাকা থেকে এতটা অংশ দিয়ে তাকে খুশি রাখবেন।” এটা প্রত্যেক মাসে বলতেই হতো। ছোট ভাই রেমিটেন্সের পিনকোড বলার সাথে সাথে বাবাকে জোর দিয়ে জানিয়ে দিতো কথাটা। বাবা পুরনো দিনের মানুষ, পার্লার খরচের বিষয়টা বুঝতেন না আর এত টাকা কেন হাতখরচ দিতে হবে এতেও একমত ছিলেন না। তাই প্রত্যেক মাসেই বাবার কানে গানটা গাইতেই হতো নইলে টাকা হাতে আসতো না কোনভাবেই আমার।

গ্রাফিক ডিজাইন শেখার জন্য প্রয়োজন ছিলো হাই কনফিগারেশনের কম্পিউটার। সেই ব্যবস্থাটাও সেই করে। এমনকি এখন আমি আগের চেয়ে অনেকটাই ভালো অবস্থানে থাকা সত্বেও গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে যখন ল্যাপটপ টা অনেক জোড়াতালি দিয়েও আর জীবিত রাখা গেলো না তখন আম্মাকে বললো আপুকে যেন পঞ্চাশ ষাট হাজার যত টাকাই লাগে ডেস্কটপ কম্পিউটার কেনার জন্য যেন খুশীখুশী মনে দেয়া হয় এবং বোনকে পূর্ণ সাপোর্ট দিয়ে পাশে থাকা হয়।

ছেলের টাকার জোরে মা তার মেয়েকে ঢাকা ভার্সিটিতে এম এড করিয়েছেন। ভাইয়ের কল্যাণেই ঢাকা শহরের বুকে একটুকু মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়া।

বাবা মা আমাদের তিনজনের জন্যেই অনেক অনেক অনুপ্রেরণা হলেও বিভিন্ন সময়ে তাদের সাপোর্ট না পেয়ে ভেংগে পড়েছি, কষ্ট পেয়েছি, অভিমানে জড়িয়েছি। তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে দুই ভাই।

আমি যখন টিটিসি থেকে নেপালে শিক্ষাসফরে যাবো তখন সংসারের কঠিন অবস্থা। বসের সাথে রাগ করে বাবা চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিন সন্তানের পড়াশোনার খরচ বহনই যেখানে ভীষণ রকম কঠিন তখন বোকা মেয়েটা বিদেশ ভ্রমণে যাবে বলে গাল ফুলিয়েছে। পাসপোর্ট করার টাকা দিলো ছোট ভাইটা। সে তখন গণিত অলিম্পিয়াডের বিভিন্ন সেমিনারে এটেন্ডের বিনিময়ে যে অর্থ পুরস্কার পেতো তা দিয়ে দিলো আমাকে। সে যাত্রায় অভিমানীনির আশা পূরণ হয়েছিলো বেশ ভালোভাবেই।
এরপর পূর্বিতার সাথে চিত্রশিল্পের প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করলাম কয়েকবার। সেই পেইন্টিং গুলোর বাইন্ডিং সহ হল ভাড়া ও রেজিষ্ট্রেশনের খরচও বাবার পকেট থেকে খসালো দু ভাইই। আর প্রতিনিয়ত আমার চলার পথে দু ভাই দু দিক থেকে ধরে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার মেন্টাল সাপোর্ট কিন্তু আজও থামেনি। এখন ওর সাথে সাথে সাপোর্ট দেয়ার মানুষ বেড়েছে আরেকজন, সে আমার ভাইয়ের বউ। দেশে আসার আগে ওদেরকে কিছুই বলতে হয় না, বোনের কী চাই তার সবই জানে ওরা, নিয়ে আসে সুটকেস ভরে।

কিন্তু যত ওরা দেয় ততই নিজের মধ্যেকার এক ছোট্ট ছোটলোকি আচরণের জন্য মনে মনে ভীষণ অনুতপ্ত হই আমি।

বলবো সেই কথা। সেই ঘটনা।

২০০৫ সাল। তখন ডিজুস সিম উঠেছে বাজারে। আশেপাশের সবার মোবাইল ফোন আছে অথচ আমাদের পরিবারের কারোরই একটা ফোন সেট নেই। আম্মার চার নাম্বার বোন যে, আমার সেই খালার হাতে আমার ছেলেবেলা কেটেছে অনেক। তিন ভাইবোনের মধ্যে খালার বাড়তি স্নেহ যত্ন সব আমার জন্য। একদম ছোট বেলা থেকে আমার জন্য যত্ন করে ড্রেস বানিয়েছেন, আমাকে এস এস সি কোচিং এও নিয়ে যেতেন। বিয়ের পরে খালামনি নিঃসন্তান। তো ওই ডিজুস সিমের সময়ে উনি নিজের ব্যবহার করা স্প্রিন্ট ফোনসেট টা আমাকে দিয়ে দিলেন আর নিজের জন্য ভালো একটা সেট কিনলেন। সেই সাথে আমাকে বললেন সিম টা নিজে কিনে নিতে। তার সাথে গিয়েই সব কিনে বাসায় ফিরলাম।

ওই সময়টায় সংসারের দুরবস্থা শোচনীয় থেকে একটু ভালোর দিকে। দুই ভাই বোনের টিউশনির টাকায় চলতো সংসার। সাথে মাঝেমধ্যে যুক্ত হতো এলজিডির আন্ডারে বাবার প্রজেক্ট বেজ এনজিও জব এর অর্থ।

ভাইটা তখন বুয়েটে পড়ছে। একদিন হরতালের জন্য বুয়েট এর পরীক্ষা হবে কিনা সেটা নিশ্চিত করতে ফোন করা জরুরী। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। আমার ফোনটা আমি এমন কলিজার ভেতরে ভরে রেখে দেই যে সেটা বাসার অন্য কেউ চাইতেও সাহস করতো না।
ভাইয়ের হয়ে মা ই আমাকে বললো, “ওকে একটা কল করতে দেও না! সিচুয়েশন টা তো বুঝতেই পারতেছো। এই বৃষ্টির মধ্যে মোবাইলের দোকানে কেমনে যাবে?”

এখন ভাবলে খুব হাস্যকর লাগে। সেদিনের সেই স্মৃতি নিজেকেই ধিক্কার দেয় বহুবার। খুব বিরক্ত হয়েই ফোনটা দিয়েছিলাম আর ‘মোবাইলের টাকা সব খরচ করে ফেলতেছে রে’ টাইপের একটা কলিজার খিঁচুনি শুরু হয়েছিলো। ভাইটাও বেশ অস্বস্তিতেই ফোন টা ব্যবহার করেছিলো। ওর সেই অস্বস্তি ভরা ভয় ভয় পাওয়া চাহনী আজও আমার হৃদয় এফোড় ওফোড় করে দেয়। বোনেরা ভাইদের জন্য কতকিছু করে! জীবনটাই দিয়ে দেয়। আর আমি কেমন একটা ফকিন্নি আচরণ করেছিলাম সেদিন। আর আল্লাহর কি বিচার দেখুন, সেই ভাই এখন বছর বছর নতুন সেট দেয় আমাকে। এবারেও বাদ যায়নি। ছোট ভাইটা বলে দিয়েছিলো “আপুর আগের সেট একেবারে আধামরা। অবশ্যই একটা ভালো সেট আনবা।” বড়টা সেই অনুরোধ ফেলে দেয়নি। এনেছে মটরোলা সেট।

সেই যে অনুশোচনা ঢুকেছে কলিজার ভেতরে, তখন থেকে ভাইয়ের কাছে কিছু চাইতেই লজ্জা আর খুব সংকোচ আমার। অনেকেই বলে, ভাইয়ের কাছে বলে এই জিনিস, ওই জিনিস আনিয়ে নিতে পারো না? কেমন করে বুঝাই সে যে আমার ছোট ভাই আর না চাইতেই ভরিয়ে দিয়েছে শুন্য থালা।

ভাইটা সম্পুর্ন নিজের চেষ্টায় আল্লাহর রহমতে স্কলারশিপ পেয়ে আনেরিকা পড়তে চলে যায় ২০০৭ সালে। আর তখন থেকেই ক্ষরণ শুরু হয় আমার। দেশে আসলেই ওর জন্য কিছু করার প্রচেষ্টা থাকে সবসময়। সবাই যখন আনন্দে ভরপুর সময় কাটাই, পুরনো সেই ঘটনাটা আমার হৃদয় ভিজিয়ে দেয় প্রায়ই।

দিন বদলে গিয়েছে। একটা জীবন অনেক কষ্টের সাগরে হাবুডুবু খাওয়ার পর এই ভাইয়ের হাত ধরেই আল্লাহ এই সংসারের প্রত্যেকটা প্রাণকেই জীবনযুদ্ধে জয়ী করে দিয়েছেন।

সবশেষে বলি, আমি ওর চেয়েও আড়াই বছরের বড়। যথেষ্ট মানবিক অনুভূতির বোধবুদ্ধি সম্পন্ন মেয়ে। মেয়ে শব্দটাই ব্যবহার করলাম। যে আচরণ ছিলো সেদিনের, তাতে নিজেকে মানুষ আখ্যা দেয়া যায় না কোনভাবেই।

//
জাকিয়া জেসমিন যূথী
৮ এপ্রিল ২০২০

৬৪৯জন ৫০৭জন

২৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ