বিকেলের সূর্য দিগন্তের ওপারে সবে ডুবতে শুরু করেছে। ছড়ানো সোনার কুচির সঙ্গে টকটকে লালের মাখামাখিতে এমন এক অপরূপ রঙের সৃষ্টি হয়েছে যে, চোখ সরানো যায় না। নদীতীরে বসে এই দৃশ্য দেখছিলো নানী আর নাতি। সালেহার বয়স বেড়েছে। বেশ ডাগর হয়েছে নাতি রেজাউলও। সে যে কত কথা বলে! মুগ্ধ বিস্ময়ে সেসব কথা শুনতে শুনতে সালেহার মনটা উদাস হয়ে যায়।
‘নানী এই নদী কতদূরে গেছে?’
নাতির এরকম প্রশ্নে নানী অবাক বিস্ময়ে তার দিকে চোখ মেলে তাকায়। বলে, ‘সে-ই অনেক দূরে।’
‘সে-ই অনেক দূরে মানে কত দূরে নানী?’
এ প্রশ্নের উত্তর সালেহারও জানা নেই। কী উত্তর দেবে সে? নাতিকে ভোলাবার জন্য বলে, ‘দ্যাখ নানু, ঐ যে আকাশে সূর্যটারে কেমন সুন্দর দেখাইতেছে।’
নাতি আকাশের দিকে তাকায়। তারও ছোট্ট চোখে মুক্ত আবেশের ঘোর লাগে। হঠাৎ তার চোখ চলে যায় ডানদিকে ভেঙে পড়া এক বিশাল মাটির চাকের দিকে। ঐ চাকের ভেতর সে দেখতে পায়, কী যেন একটা ঝুপ করে নদীর গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো।
সে চীৎকার করে উঠলো, ‘নানী দেখো, দেখো, কী য্যান্ একটা নদীতি পড়লো।’
সালেহা চমকে তাকিয়ে দেখতে পেলো, ভেঙে পড়া মাটির চাকের সঙ্গে মানুষের আস্ত একটা কঙ্কাল। ধীরে ধীরে জলের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। চমকে উঠলো সালেহা।
হ্যাঁ, এই তো এখানটাতেই ছিলো তাদের খড়ের গাদা। নদী ভাঙতে ভাঙতে এদিকে ছুটে আসাতে ঘরগুলোর সঙ্গে সঙ্গে খড়ের গাদা আর গোয়ালঘরটা আরও পেছনে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু নদী আগের জায়গার খানিকটা অংশ মুহূর্তেই গিলে ফেললো, তার সঙ্গে সেই কঙ্কালটাও।
সালেহার মনটা হঠাৎ করে কেমন বিষণ্ন হয়ে যায়। বুকের ভেতরে ধুকপুক করতে থাকে। এতোদিন ভুলে ছিলো। হঠাৎই ঘটনার স্রোত মনের ভেতরে ঘুরপাক খেতে থাকে। পেছন ফিরে তাকায় সে। তার চোখে ভেসে ওঠে এক জিঘাংসু ঘটনার প্রতিচ্ছবি। তখন এই যমুনা ভাঙতে ভাঙতে প্রায় ওদের বাড়ির কাছে চলে এসেছে। বন্যার তোড়ে জলের ঘূর্ণিপাক যখন তীব্র বেগে পাড়ে এসে ঘাই মারছে, তখন মাটির বিশাল এক একটা চাক দৈত্যের মত নদীগর্ভে আছড়ে পড়ছে। আর নদীর জল মুহূর্তেই তাকে গিলে ফেলে কোন্ অতলে যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেউ তা জানে না।
এদিকটাতেই নদী খুব ভাঙে। বিশাল নদীর দুই তীর প্রায় দেখাই যায় না। তার মধ্যেই কখনও কখনও দু’একটা স্টিমার হুঁইসেল বাজিয়ে চলে যায়। বড় বড় নৌকা পাল তুলে নদীর এপার থেকে ওপারে যায় বাণিজ্য করতে। নদীর ওপারে সিরাজগঞ্জ। সেখানে নদীতীরে সপ্তাহে দু’দিন হাট বসে। ব্যবসায়ীরা দল বেঁধে যায়, দল বেঁধেই ফিরে আসে। দক্ষিণে গোয়ালন্দ অনেকটা দূর বলে ওদিকে তেমন কেউ যায় না।
শহীদুলের বাপ রহমতও নৌকায় করেই ওপারে যায়। যেদিন হাটবার থাকে, সেদিন আটদশজন মিলে আরিচাঘাট থেকে একটা বড় নৌকা ভাড়া করে। ঘাটের মহাজনদের অনেকেই যায়। কিন্তু এবার যমুনার যে ভয়ঙ্কর রূপ, দেখে বুক কেঁপে ওঠে। নদী পাড়ি দিতে গিয়ে হঠাৎ যদি ঝড় ওঠে, তা হলে রক্ষে নেই, নির্ঘাৎ মৃত্যু। তাই এ বছর এখনও হাট করতে যাওয়া হয়নি রহমতের। অপেক্ষায় আছে বানের তোড় কমে এলে তারপর যাবে। নদী থেকে সামান্য দূরে রহমতদের ঘর। রাক্ষুসী নদী তাদেরকে গিলে ফেলবার জন্যে হা করে আছে। থাকার জন্য বড় একটা টিনের ঘর, পাশে শহীদুলের চাচাদের ঘর। একান্নবর্তী পরিবার বলে সকলেই এক উঠোনে বাস করে। বাপ-চাচাদের মিল-মোহাব্বত খুব বেশি। তিন ভাইয়ের মধ্যে রহমতই সবচাইতে ছোট। সকলেরই সংসার আছে, বাড়ি ভর্তি লোকজন। রহমত বছর আটেক আগে বিয়ে করেছে। একটা মাত্র ছেলে তার এই শহীদুল। বয়স সাত। শহীদুলের মা সালেহা এখনও দেখতে ভারী সুন্দর। মনেই হয় না তার সাত বছরের একটি ছেলে আছে।
বাড়িতে নিজস্ব পুকুর নেই। সামান্য দূরে খাঁ সাহেবের একটি পুকুর আছে। পাড়ার লোকেরা সেখান থেকেই পানি আনতে যায়। খাঁ সাহেব গ্রামের মাতব্বর। সুখে-দুঃখে জনগণের পাশে থাকার চেষ্টা করেন। সারাদিন পুকুরে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আসে। এখান থেকে পানি নেয়; এতে থালা-বাসন ধোয়, গোসল করে-খাঁ সাহেব কিছু বলেন না। মাঝে মাঝে অবশ্য লাঠিতে ভর দিয়ে পুকুরের পাড়ে এসে দাঁড়ান। দেখেন গ্রামের ছেলে-মেয়ে, বৌ-ঝি, ছোট-বড় সকলেই তাঁর পুকুর ব্যবহার করছে। হাঁক দিয়ে সকলকে সতর্ক করে দেন, ‘খবরদার পুকুরের পানি কেউ নষ্ট করবি না। তা-অলি সব শালার হাড়গোড় ভেঙে গুঁড়ো কইরে দেব।’
সকলেই জানে, এটা খাঁ সাহেবের মনের কথা নয়। তাই চোখ তুলে তাকিয়ে খাঁ সাহেবকে একটু দেখেই যে যার কাজে মন দেয়। খাঁ সাহেবও মৃদু হেসে ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
সালেহা প্রায় প্রতিদিনই কলসী কাঁখে পানি নিতে আসে। যে পথে সে আসা-যাওয়া করে, সেই পথটা একটু নির্জন। লোক চলাচলও কম। ঘর থেকে বাইরে বেরুলেই পর পর বিশাল আকারের কয়েকটি আমগাছ, তারপরে দীর্ঘ বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড় পেরিয়ে পুকুর। অন্য বউয়েরা আগে থেকেই যাওয়া-আসা করে। ছোট বউ বলে অন্য সবাই সালেহাকে তেমন একটা যেতে দিতে চায় না। শহীদুলের জন্মের পর থেকে এখন মোটামুটি নিয়মিতই পানি আনতে যায় সে।
আজও যাচ্ছিল সালেহা। ঘর থেকে বাইরে পা দিয়ে সামান্য এগুতেই দেখতে পেলো, পশ্চিমের বড় একটা আমগাছের আড়ালে একজন লোক একটুখানি মুখ বাড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটার চোখে একঝলক চোখ পড়তেই তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টেনে দ্রুতগতিতে পুকুরের দিকে হেঁটে চলে গেল সালেহা। একবারমাত্র পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো, লোকটা উল্টোদিকে ঘুরে তার গমনপথের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
সালেহা এর আগে লোকটাকে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ে না। এতোদিন ধরে এ পথে চলাচল করছে, এ উপদ্রবের মুখোমুখি হতে হয়নি কখনও। কী চায় লোকটা? কোনও বদ মতলব নেই তো? ভাবতে গিয়ে বুকটা একটুখানি কাঁপল তার। ঘাটে গিয়ে পানি ভরতে ভরতে কিছুটা দেরি করলো। তারপর কলসী ভরে ধীরে ধীরে বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করলো। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেলো, সেই লোকটা তখনও তেমনি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। সালেহা কোনও দিকে না তাকিয়ে হন্ হন্ করে এগিয়ে বাড়ির উঠোনে গিয়ে ধপাস করে পানির কলসীটা নামিয়ে নিজেও বারান্দায় বসে হাঁপাতে লাগলো। বুকের ধরফড়ানি থামতে চায় না। ছোট বউকে ঐ রকম করে আসতে দেখে মেজ বউ তড়িঘড়ি ছুটে এসে সালেহার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হইয়েছে রে সালেহা। অমন কইরে ছুটতি ছুটতি এসে কলস ধপাস কইরে নামিয়ে’ রাখলি যে বড়।’
সালেহা মেজ বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘না কিছু না তো! এই এমনি একটু জোরে হাঁইটে আসিছি, তাই।’
‘ও তাই বল্। আমি ভাবলাম কী জানি আবার কী অলো?’
সালেহা একথার উত্তর না দিয়ে বেশ খানিকক্ষণ দাওয়ায় বসে থাকল। ঘুরেফিরে বারবার ওই লোকটার অর্ধেক অবয়ব চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো। হঠাৎ করে অচেনা, অজানা এই লোকটা তার চলার পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কী উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়, বুঝে উঠতে পারে না সালেহা।
সংসারের কাজকর্মের মাঝেও এই একটা ব্যাপার তাকে আনমনা করে তোলে। ঘরের পুরুষ মানুষেরা সূর্যোদয়ের আগেই কাঁধে লাঙল নিয়ে ক্ষেতের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। কাজ শেষ করে ফেরে সন্ধ্যায়। ঘরে এখন পুরুষ মানুষ বলতে একমাত্র ওই শহীদুলই। অন্যান্যদের ঘরে শুধু মেয়ে। নিজের মনে এক ধরনের সংশয়ের ভারী পাথর চেপে বসে। লোকটা যদি হুট করে বাড়িতে এসে হাজির হয়, তা হলে কেলেঙ্কারীর একশেষ হবে। না, না, অত সাহস হবে না ওর। আশেপাশে লোকজন আছে না। এ কথা ভেবেও নিঃশংশয় হতে পারে না সালেহা।
(চলবে…)
১৩টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
পড়া শুরু করলাম , দেখি কত দূর নিয়ে যান ।
সাতকাহন
এটার প্লট ছোটো
জিসান শা ইকরাম
লেখার শুরু থেকেই পাঠকের আগ্রহটা ধরে রাখতে জানেন আপনি 🙂
শুরুটা বেশ ভালো — অপেক্ষা করছি পরের অংশের জন্য —
সাতকাহন
ধন্যবাদ ভাই, সাথে থাকবেন।
মিসু
খুব ভালো লেগেছে । অপেক্ষায় রইলাম ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ, মিশু ভাই
"বাইরনিক শুভ্র"
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম । ভালো লেগেছে ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ, বাইরনিক শুভ্র
ব্লগার সজীব
একজন প্রকৃত গল্পকারের সমস্ত গুনই আপনার মাঝে বর্তমান । প্রথম পর্ব শেষ হলো মুগ্ধতা দিয়ে। অপেক্ষা করছি পরের পর্বের ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ
প্রজন্ম ৭১
চলুক 🙂