‘ রুমি মারা গেছে ‘ খবরটি জানার পর আমার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়ায়নি। প্যানসিলভেনিয়া থেকে অতিথিরা আসবে। আমি ব্যস্ত। ভীষণ ব্যস্ত। কারো জন্যে দু’ফোটা জল ফেলবার সময় কই ! দিনভর বাড়িঘর ঝাড়-মোছ করেছি। দুপুরের খাবারে কী কী মেনু দিবো, সেগুলোর আয়োজন করেছি। ওরা আসে। গল্প করি। একসাথে ঘুরতে যাই। বিকেল, সন্ধ্যা, রাত, ভোর অবধি ঝলমলে আলোয় মাখামাখি ম্যানহাটান শহর ঘুরে বেড়াই। ছবি তুলি। হিলটন হোটেলের পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে জায়রো খাই।
এতকিছুর মাঝেও সকলের অলক্ষ্যে আমার ভেতরে ভীষণ এক নৈঃশব্দ্য ! আন্মনা। আমিও যে রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ। স্মৃতির জানালায় ফিরে ফিরে যায় মন। শ্যামলা মত একটি মেয়ে দু’বেণী দুলিয়ে স্কুলে যেতো ! সে আমার বন্ধু, রুমি। আমরা সমবয়সী ছিলাম। তবে আমাদের স্কুল ভিন্ন ছিল। একই পাড়ায় বসবাসের সুবাদে আমরা খেলার সাথী সেই ছোট্টবেলা থেকে। পুতুল খেলা, পুতুলের বিয়ে দেয়া, মান-অভিমানের কতো স্মৃতি ! বড় হয়ে আমি ঢাকায় ভর্তি হলাম, পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। ছুটিতে আমার শহরে বেড়াতে গেলে রুমিদের বাসায় যাওয়া চাই-ই চাই। তবে কোথাও যেন একটু দূরত্ব মনে হতো। চোখের আড়াল হলে মনেরও আড়াল হয় জানি। আর তাই হয়তো আগের মত প্রাণখুলে মনের সব কথা খলবলিয়ে বলতো না আমায়। কিছু যেন আড়াল করছিলো রুমি। অতঃপর একদিন আব্বার কাছে খবর পেলাম, ভালোবাসার মানুষটির হাত ধরে রাতের অন্ধকারে কাউকে না বলে চলে গিয়েছে রুমি। এর ক’দিন বাদে আমি এলাম বিদেশ বিভূঁইয়ে। বছরের পর বছর আমাদের দেখা নেই। কিন্তু সব খবর পেতাম আব্বা কিংবা আপার মাধ্যমে। জানলাম, রুমি এক পুত্র এবং এক কন্যা সন্তানের জননী। ভালোই আছে।
প্রতিবার দেশে গেলে কেন যেন আমার শৈশব, কৈশোরের মানুষগুলোকে দেখতে খুব মন চায়। আমি খুঁজে খুঁজে তাঁদের সাথে দেখা করি। গতবার যখন দেশে গেলাম, আমার মফঃস্বল শহরে এক বৃষ্টিস্নাত মনখারাপ করা বিকেলে আপা বলল, ” রুমি পাশের পাড়ায় নতুন বাড়ি করেছে, যাবি ? ” আমার ভেতরটা আনন্দে নেচে উঠে। আহা,কতকাল দেখিনি রুমিকে ! সন্ধ্যার কিছু আগে রুমির বাসায় গিয়ে হাজির হই। ছিমছাম সাজানো বাড়ি। স্বামী, এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে সংসার। ওকে একটু অসুস্থ মনে হল। বয়সের চেয়েও অনেক বেশি বয়স মনে হলো। আতিথেয়তার কমতি করেনি। রুমি খাবার দেয়। চা খেতে খেতে আমরা গল্প করি। পুরনো দিনের গল্প, ফেলে আসা স্মৃতির গল্প। সন্ধ্যা পেরিয়ে আঁধার নামে। টিপটিপ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ফিরে আসবার সময় রুমি গেট পর্যন্ত এগিয়ে আসে। লোহার গেট ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি আর পিছু ফিরে চাই না। যে কোন বিদায়ে পিছু ফিরে চাইতে নেই। এতে কষ্ট বাড়ে। মায়া বাড়ে। খামোখা মায়া বাড়িয়ে কী লাভ ?
সেই শেষ দেখা আমাদের। সেই দেখাটা এমনভাবে বুকের বাঁ পাশে গেঁথে থাকবে ভাবিনি। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে আপা যেদিন রুমির মৃত্যু সংবাদ দেয়, এই বিদেশ বিভূঁইয়ের বাড়িতে আমি এক মুহূর্ত হিমশীতল নিস্তব্দতায় চেয়ারের হাতল ধরে বসে থাকি, পৃথিবীটা দুলে উঠে যেন। কিন্তু আমার যে অনেক কাজ পড়ে আছে ! এই শহরে থার্টিফাস্ট নাইট সেদিন। কাজ গুছিয়ে আমি দিব্যি নিউইয়র্কের আলো ঝল্মলে টাইম স্কয়ারে ঘুরে বেড়িয়েছি আমার অতিথিদের নিয়ে ! কোলাহলের মাঝে হেঁটেছি রাতভর ! অথচ আমারই খেলার সাথী রুমি তখন শুয়ে আছে গহিন অন্ধকারে ! কী ভীষণ একাকী এক নৈঃশব্দ্যের মাঝে !
প্রিয় রুমি, আমরা তো একই সাথে খেলেছিলাম শৈশব, কৈশোরে। তোমার বুঝি সবার আগে ওপারের ডাক এলো ! তোমার মনে আছে, আমরা ছাদে বসে একসাথে গেয়ে উঠতাম,
” ওপারের ডাক যদি আসে,
শেষ খেয়া হয় পাড়ি দিতে …
মরণ তোমায় কোনদিনও
পারবে না কভু কেড়ে নিতে …
আজো, এই বিদেশ বিভূঁইয়ের পরিচ্ছন্ন পথ ধরে দুই বেণী দুলিয়ে কোন বালিকার হেঁটে যাওয়া দেখলে আমার হৃদপিণ্ডের ঠকঠক শব্দ ঘন হয়ে আসে। ভেতরটায় অব্যক্ত এক অনুভূতি হয়। অদ্ভুত এক আশায় চমকে উঠে। সমস্ত পৃথিবী সহ থেমে থাকি যেন ! মনে হয়, রুমি নয়তো !
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।
১২টি মন্তব্য
ইঞ্জা
প্রথমেই প্রিয় আপুকে স্বাগতম নতুন করে আবার সোনেলায় পদার্পণ করার জন্য, অপেক্ষায় ছিলাম কবে আপু আবার লিখবে প্রিয় সোনেলায়।
আপু, রুমি আপুর বিষয়ে আগেও আপনার লেখা পড়েছি, কিন্তু হটাৎ করে উনার চলে যাওয়া আমাকে আহত করলো, আপনার প্রতিটি লেখা জীবন নির্ভর হওয়ায় আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলি আপনার প্রতিটি লেখায়, যার কারণে বুকটা ধক করে উঠলো, দোয়া করি আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন যেন রুমি আপুকে জান্নাত নসিব করেন।
আপু মনটা আসলেই খারাপ হয়ে গেলো, এরপরেও জীবন চলে সময়ের তালে তালে, দোয়া রইলো আপু, ভালো থাকবেন
রিমি রুম্মান
সোনেলায় এসে ভাল লাগছে। পূরোনো যায়গা, প্রিয় মানুষজন, সব। মাঝে রাজ্যের ব্যস্ততা গিয়েছে। লেখালেখিও কম করেছি। ২০১৮ তে কোন বইও প্রকাশিত হয়নি।
ইঞ্জা
আগামীতে ইনশা আল্লাহ্ হবে, ভালো থাকবেন আপু।
জিসান শা ইকরাম
দিদি ভাই লেখাটা পড়ার সময় আমি যেন তুমি হয়ে গিয়েছিলাম। চোখে পানি চলে এলো। ভিতরে কান্নার হুহু বাতাস। আমার ছোট বেলার কয়েকজন বন্ধু চলে গিয়েছে, নেই তারা এই জগতে। সবার স্মৃতি এসে সামনে দাড়াল মুহুর্তের মধ্যে।
এমন প্রকাশ কিভাবে করো দিদি ভাই!!
-{@
রিমি রুম্মান
কত কী মনে পড়ে! সব অনুভূতি তো আর প্রকাশ করতে পারি না আমরা। চেনা কাছের মানুষগুলো খুব দ্রুতই নাই হয়ে যাচ্ছে!
মৌনতা রিতু
সময়, জীবন অবশেষে মন বড় স্বার্থপর আপু এবং বড় বেশি যান্ত্রীক।
জীবনের নিয়মে এগিয়ে যেতে হয়। তোমার লেখাটা পড়ে আমার মনে পড়ে গেলো দরিয়াকে। যাইহোক, যেদিন মৃত্যু আসবে সেদিন নিরবে চলে যাব। আমি ইদানিং চাই খুব জান, যে সব কর্তব্য শেষ হওয়ার সাথে সাথে যেনো চলে যাই। আর কিছুদিন বাঁচতে চাই।
রিমি রুম্মান
আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয় ছেলে দুইটার জন্যে অনন্তকাল।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
মৃত্যু নির্ধারিত আর স্মৃতি অনন্তকাল শৈশব এক যাদুকর সময় যা কখনোই ভুলা যায় না।এই সব নিয়েই আমাদের ক্ষণিকের জীবন।রুমির জন্য যেখানেই থাকুক ভাল থাকার কামনা।
রিমি রুম্মান
শৈশব মাঝে মাঝে এত জীবন্ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় ! ভাল থাকুক চলে যাওয়া মানুষেরা।
নীলাঞ্জনা নীলা
শৈশবের বন্ধুদের সাথে একটা সময় দূরত্ব তৈরী হয়ে যায়। তবুও কিন্তু স্মৃতিতে অমলিন থাকে।
খুব খারাপ লাগছে শুনে আপু, তোমার শৈশবের স্মৃতিতে একটা ক্ষতের উপর দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস এসে জায়গা করে নিলো।
নিজেকে ভালো রেখো রিমি আপু। (3 -{@
রিমি রুম্মান
জীবন এমন করেই এগিয়ে যাচ্ছে সমাপ্তির দিকে। ভাল থেকো তুমিও, নীলাদি। (3
নীলাঞ্জনা নীলা
ওভাবে বলোনা আপু।
বেঁচে থাকো সুস্থতার সাথে। (3