এ কে খন্দকারের ‘১৯৭১ ভেতরে বাইরে’ ইতিহাস বিকৃতির পাঠোদ্ধারকল্পে আমার এই সামান্য আলোচনা। এ কে খন্দকার তার ফরমায়েশি গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু, ৭ মার্চের ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মিথ্যা ও মনগড়া তথ্য দিয়েছেন প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত তার উল্লেখিত গ্রন্থে। খন্দকারের গ্রন্থটি যে, ফরমায়েশি লেখা তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। গ্রন্থটি প্রকাশ হওয়ার পর বাঙলার গণ-মানুষের মধ্যে প্রবল গণরোষের পরেও তার নিরবতাই প্রমাণ করে তিনি মিথ্যা ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে আওয়ামী বিরোধী একটি আন্তর্জাতিক প্রেসক্রিপশনে গ্রন্থটি রচনা করেন।
বাঙলা ভাগের বিষয়টি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি মূখ্য বিষয় হিসেবে দেখা দেয়। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে এই ভূখণ্ডে ভাগের রেখা টেনে দেয় ব্রিটিশরাজ। সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি সংস্কৃতির মানুষগুলোকে একটি দেশের পতাকাতলে নেয়ার জন্য ব্রিটিশরাজের কূটকৌশল সেই সময়ে সফল হয়েছিলো। ভাগ হয়েছিলো ভারতবর্ষ, দুটি দেশে রূপান্তরিত হয়েছিলো, ভারত ও পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্বিচারে শোষণের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠতে থাকে বাঙালিরা।
বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ, সত্যরঞ্জন বকশী, সত্যগুপ্ত, মাস্টারদা সূর্যসেন, পূর্ণ দাস, যতীন দাস, পঞ্চানন চক্রবর্তী, প্রতুল ভট্টাচার্য, জগদীশ চ্যাটার্জী, বিনোদ চক্রবর্তী, যতীশ জোয়ার্দার, বিনয় বসু, দীনেশ গুপ্ত, ননী চৌধুরী, সৌরভ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, গনেশ ঘোষ, লোকনাথ বল, আবদুল খালেক, শেরে বাঙলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী’র রাজনৈতিক বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয় একটি নাম, বিত্তশালী চিত্তের অধিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ায় বাঙালি, গড়ে ওঠে পাকিস্তান বিরোধী তুমুল গণ-আন্দোলন, আন্দোলন সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ৩০ লাখ শহীদের রক্ত ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আমরা পেলাম এক টুকরো বাঙলা, আমাদের রক্তের দামে কেনা বাংলাদেশ; লাল সবুজের পতাকায় ঢেকে যায় আমাদের প্রিয় ভূখণ্ড। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন একদিনেই তৈরি হননি, ঠিক একইভাবে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারাবিকতার ফসল ‘বাংলাদেশ’।
১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স এ্যাক্ট’-এ ভারতবর্ষের দুটি প্রধান মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করা হয়। ১২ আগস্ট প্রকাশিত ‘র্যাডক্লিপ রোয়েদাদ’-এ পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সীমানা আনুষ্ঠানিকভাবে নির্ধারিত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে ব্রিটিশ রাজত্বের অবসান ঘটে রক্তপাত, পারষ্পরিক ঘৃণা ও ধর্মীয় ছলনাময়ী তথাকথিত ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’র ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি রাষ্ট্র। ভারতবর্ষের বিভাজনে বাঙলা ভূখ-টিও বিভক্ত হয়ে পড়ে পূর্ব ও পশ্চিম বাঙলা নামের আড়ালে। পূর্ব বাঙলায় থেকে যায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ, রাজশাহী বিভাগের রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী ও পাবনা জেলা; প্রেসিডেন্সি বিভাগের খুলনা জেলা, চারটি থানা ছাড়া সিলেট; নদীয়া, যশোর, পশ্চিম দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি ও মালদা জেলার অঙ্গচ্ছেদ করা হয়। বাঙালিরা অনেক সম্ভব-অসম্ভবের বুক-বাঁধা আশা নিয়ে, জিন্নাহ’র উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলিম উৎপীড়নের মিথ্যা অভিযোগ মেনে নিয়ে ‘ধর্ম-ভিত্তিক’ পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হয়।
পাকিস্তান তৈরির কিছুদিনের মধ্যেই বাঙলার জনগণ অনুভব করলেন, যে আশা নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে, সে আশা পূর্ণ হওয়ার নয়। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকবর্গ প্রথমেই বাঙলায় সাংস্কৃতিক আঘাত শুরু করে। এই সূত্রেই সৃষ্টি হয় ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন।
১৯৪৭ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের সুপারিশসহ প্রচারমাধ্যম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেবলমাত্র উর্দু ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। এই সময় বাঙলার বুদ্ধিজীবী এবং বাঙলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ তাৎক্ষণিকভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবাদ শুরু করে। এরই সূত্রে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। কালক্রমে এই আন্দোলন সমগ্র বাঙলার জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার উপর পুলিশ গুলি করে। শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকে।
১৯৫৪ সালে ১০ মার্চ পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ববঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। কিন্তু পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী বাঙালির এই আধিপত্য মেনে নিতে পারেনি। এই নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট লাভ করে ২২৩ আসন। কিন্তু মাত্র আড়াই মাসের মধ্যে ৩০ মে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে সামরিক শাসন জারি করা হয়। ঐদিন বঙ্গবন্ধু করাচি থেকে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন এবং গ্রেফতার হন। ২৩ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি লাভ করেন। উল্লেখ্য, যুক্তফ্রন্ট এই নির্বাচন উপলক্ষে যে নির্বাচনী কর্মসূচি দিয়েছিলো তা একুশ দফা নামে পরিচিত।
এরপর ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন। সামরিক সরকার ১৯৫৯ সালে সমগ্র পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করে। এর ফলে বাঙালিদের মধ্যে বিপুল সাড়া পড়ে যায়। পুরো জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ বাঙালি, অতএব এই নির্বাচনের ফলাফল চিন্তা করে কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। একই সময়ে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের কৌশলে কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যেও বিরোধ সৃষ্টি করে। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা এবং সেনাবাহিনী প্রধান আইয়ুব খান দেশে সামরিক শাসন জারি করে এবং সকল ধরনের রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন তুলে নেয়া হয়। পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে এই সময় দেশব্যাপী একটি আন্দোলনের সূচনা করে শিক্ষার্থীরা।
পাকিস্তানের কাঠামোয় বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশ ঘটা অসম্ভব বিবেচনা করে তৎকালীন ছাত্র-সমাজের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গোপনে ছাত্রদের সংগঠিত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ এই ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব দেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদ। এই সংগঠন ‘স্বাধীন বাঙলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে পরিচিত ছিলো। ধীরে ধীরে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আন্দোলন গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়। এই আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন ও সব রকমের সহযোগিতা প্রদান করে বাঙলার প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। ১৯৬৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, ‘শিক্ষা দিবস’ পালন উপলক্ষে মিছিল বের করা হয়। এইদিন আন্দোলনরত ছাত্রদের মিছিলের উপর পুলিশ গুলি বর্ষণ করে। গুলিতে তিনজন ছাত্র নিহত হন। এঁরা হলেন ওয়াজিউল্লাহ, মোস্তফা ও বাবুল।
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়কালে দেখা যায়, বাঙলাকে প্রায় অরক্ষিত রেখে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাকে সুদৃঢ় করা হয়েছিলো। এই যুদ্ধ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণ সামাজিক, সাংস্কৃতিক নিপীড়ন ও অর্থনৈতিক শোষণের ধারাবাহিকতায় বাঙলার নিরাপত্তা ব্যবস্থার ন্যূনতম উন্নতি করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি, বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের প্রতি জাতিগত এই বৈষম্যের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে লাহোরে আহুত ‘সর্বদলীয় জাতীয় সংহতি সম্মেলন’-এ তিনি ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে এই ৬ দফা পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলনকে ভিন্নমাত্রা দান করেছিলো। বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সামরিক বাহিনীর কিছু সংখ্যক সদস্য আওয়ামী লীগের সহযোগিতায় লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে বাঙলাকে বিচ্ছিন্ন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের এক প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। সংগঠনের নৌ-বাহিনীর কোনো এক সদস্যের অসতর্কতার ফলে পাকিস্তান সরকারের কাছে এই পরিকল্পনার কথা ফাঁস হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে, ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান সরকার সামরিক বেসামরিক ২৮ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে এক রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করে। এই মামলা ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত।
১৯৬৮ সালের ১৯ জুন, ঢাকা সেনানিবাসে এই মামলার বিচার শুরু হয়। বিচারকার্য চলার সময় থেকেই স্লোগানে স্লোগানে কেঁপে ওঠে, ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো।’ এই গণ-আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় বলা যায়, দেশব্যাপী সরকার বিরোধী আন্দোলন পূর্ণতা লাভ করে এবং ধীরে ধীরে বাঙলার স্বায়ত্বশাসনের দাবি প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। এইসূত্রে সে সময়ের রাজনৈতিক স্লোগানও পরিবর্তিত হয়। যেমন, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা।’ ‘জাগো জাগো, বাঙালি জাগো’। এই ধারাবাহিকতায় স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথকে উন্মূক্ত করে। এই আন্দোলন শুরুতে অহিংস আন্দোলন ছিলো, ক্রমান্বয়ে তা সহিংসতার দিকে ধাবিত হতে থাকে। ফলে ৬ দফা দাবি গণদাবিতে পরিণত হয়।
আন্দোলন তীব্রতর হয়ে উঠে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে। মূলত এই আন্দোলনের কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে ছাত্র-সমাজ। ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, সামসুদ্দোহা, মোস্তফা জামাল হায়দরসহ অনেকে।
ছাত্রদের সাথে যুক্ত হয়েছিলো সে সময়ের নানা পেশার মানুষ। এই আন্দোলনের তীব্রতা বুঝা যায়, সে সময়ের আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের তালিকা দেখলে। ২০ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। ২৪ জানুয়ারি স্কুলছাত্র মতিউর রহমান পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকায় শহীদ আসাদ-মতিউর দুটি উল্লেখযোগ্য নাম। শেরে বাঙলা নগর ও মোহাম্মদপুরের সংযোগ স্থলের আইয়ুব গেটের নাম পরিবর্তন করে ‘আসাদ গেট’ এবং বঙ্গভবনের সামনের উদ্যানের নাম ‘মতিউর রহমান শিশু উদ্যান’ করা হয়।
১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত অবস্থায় বন্দী আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত সার্জেন্ট জহুরুল হক মৃত্যুবরণ করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। এই দুটি মৃত্যু সংবাদ গণ-আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত করে। এই মামলায় অভিযুক্ত ও বন্দী অবস্থায় সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ড. শামসুজ্জোহাকে জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। উভয়েই স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক হিসাবে চিহ্নিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল’ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শহীদ শামসুজ্জোহা হল’ তাঁদের স্মরণে নামকরণ করা হয়েছে।
প্রচণ্ড গণ-আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার ১৯৭০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অভিযুক্ত সকলেই ঢাকা সেনানিবাস থেকে মুক্তি লাভ করেন। ধারাবাহিক এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির একক এবং অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল গণ-সম্বর্ধনায় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে কিংবদন্তির ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৭০ সালের ২৫ মার্চ তিনি সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের হাতে হস্তান্তর করেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খানও গণ-দাবিকে উপেক্ষা করার মত শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সারাদেশে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। তিনি ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার তফসিল ঘোষণা করেন।
পূর্ব ঘোষিত তফসিল অনুসারে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর গতিশীল নেতৃত্বে বাঙলার গণ-মানুষের স্বতস্ফূর্ত ভোটে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের উত্তরণ ঘটে। বাঙলার জনগণ প্রত্যাশা করেছিলো নির্বাচিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে বাঙলার দীর্ঘদিনের বঞ্চনার ইতিহাসের গতি পাল্টাবেন। পাকিস্তানের শাসকবর্গ ষড়যন্ত্রের গ্রন্থিগুলো এমনভাবে বিন্যস্ত করেন যেনো শাসন ক্ষমতা কোনোক্রমেই বঙ্গবন্ধুর হস্তগত না হয়। বাঙলার জনগণ তা সঠিকভাবে অনুধাবন করেন।
তৎকালীন রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি লক্ষ্য করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অনুভব করেছিলেন যে, খুব শীঘ্রই পৃথিবীর মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি দেশ সম্পৃক্ত হতে চলেছে এবং এর জন্য কঠিন লড়াই করতে হবে। এরই সূত্র ধরে ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে ছাত্রনেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, একটি সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলতে হবে এবং এই সিদ্ধান্ত অনুসারেই বঙ্গবন্ধুর অনুমতিক্রমে ১৫ ফেব্রুয়ারিতে একটি ব্রিগেড গঠন করা হয়েছিলো। এই বাহিনীর নাম দেওয়া হয়েছিলো ‘জয় বাঙলা’। প্রথাগতভাবে তখন এই বাহিনীর জন্য একটি পতাকা তৈরির পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছিলো। এই পতাকার নকশা কি হবে, তা নিয়ে ছাত্রনেতাদের মধ্যে বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আ স ম আবদুর রব এবং শেখ মণি’র মত ছিলো পতাকার জমিনটা হবে সবুজ রঙের, যা শ্যামল বাঙলার প্রতীক হিসাবে কাজ করবে। শাহজাহান সিরাজ লাল রঙের পক্ষে ছিলেন। কাজী আরেফ পতাকায় ‘বাংলাদেশের মানচিত্র’ যুক্ত করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এই আলোচনার এক পর্যায়ে ছাত্রনেতা কামরুল আলম খান খসরু কালি-তুলি ও কাপড় জোগাড় করে ফেলেন। ছাত্রনেতাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক, পতাকার বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য থেকে শিব নারায়ণ দাশ আসেন এবং একটি পতাকা তৈরি করেন। এই পতাকাটি তৈরি হওয়ার পর, তা নিরাপত্তাজনিত কারণে ঘরে লুকিয়ে রাখা হয়। এই পতাকাই পরবর্তীতে বাংলাদেশের পতাকা হিসাবে গৃহীত হয়।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। পৃথিবীর ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য দিন, তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের, তিনি দৃঢ়চিত্তে সেদিন বলেছিলেন:
“আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবাই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।
আজ বাঙলার মানুষ মুক্তি চায়, বাঙলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাঙলার মানুষ তার অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম, নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এই দেশকে আমরা গড়ে তুলবো, এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তেইশ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাঙলার অত্যাচারের, বাঙলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। তেইশ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নরনারীর আর্তনাদের ইতিহাস; বাঙলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে দশ বৎসর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ছয়দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পর যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন। আমরা মেনে নিলাম।
তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাঙলায় নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসবো। আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো; এমনকি আমি এ পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো।
জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন যে, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরও আলোচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করলাম, আপনারা আসুন বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসেন, তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। তারপর হঠাৎ ১ তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো।
ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসাবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। দোষ দেওয়া হলো বাঙলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্দুকের মুখে মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলো।
আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। কি পেলাম আমরা? যে আমরা পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী আর্ত মানুষের বিরুদ্ধে, তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম, জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের উপরে, আমার বাঙলার মানুষের উপরে গুলি করা হয়েছে, কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স ডাকবো।
আমি বলেছি, কিসের বৈঠক বসবে, কার সঙ্গে বসবো? যারা মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার উপরে দিয়েছেন, বাঙলার মানুষের উপর দিয়েছেন।
ভাইয়েরা আমার, ২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি যে, ঐ শহীদের রক্তের উপর পা দিয়ে কিছুতেই শেখ মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। এসেম্বলি কল করেছে। আমার দাবি মানতে হবে প্রথমে, সামরিক আইন মার্শাল ল’ উইথ্ড্রো করতে হবে, সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে, যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে, আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে যেতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।
আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলির হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে; শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমিগভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোন কিছু চলবে না।
২৮ তারিখে কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।
আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।
আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা পয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই সাতদিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছায়ে দেবেন।
সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো, কেউ দেবো না। মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটপাট করবে। এই বাঙলায় হিন্দু, মুসলমান, বাঙালি, অবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে। আমাদের যেনো বদনাম না হয়।
মনে রাখবেন রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনেন, তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোনো বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না।
দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নিবার পারে। কিন্তু পূর্ববাঙলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না।
টেলিফোন টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ববাঙলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে চালাবেন। কিন্তু যদি এদেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে শুনে কাজ করবেন।
প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাঙলা। জয় বাঙলা।”
বঙ্গবন্ধুর সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণার ফলে বাঙলাজুড়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র প্রস্তুতি, বাঙলার সাধারণ কৃষক, ছাত্র, মজুর, শ্রমিক এবং বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মুক্তিকামী মানুষ বঙ্গবন্ধুর ডাকে একত্রিত হতে শুরু করে।
১৯৭১ সালের শুরুর দিকে বাঙলার মানুষের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসকবর্গ এবং রাজনৈতিক নেতারা বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। ধীরে ধীরে তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে নেতৃত্বে বাঙলার স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ লাভ করে। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর গণহত্যার ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশে নামটি পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নেয়।
‘১৯৭১ ভেতরে বাইরে’ বইটিতে এ কে খন্দকার মুক্তিযুদ্ধের ভেতরটা যেমন গভীরভাবে দেখেননি, তেমনি বাইরের ঘটনাবলি সম্পর্কে যথাযথভাবে আলোকপাত না করে বিতর্কিত ও ছন্নছাড়া স্মৃতিচারণামূলক বর্ণনা দিয়েছেন, যা তার মতো মানুষের কাছ থেকে আশা করা যায় না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্যানভাস বিশাল ও ব্যাপক, যা সারা বিশ্বকে আলোড়িত, আন্দোলিত করেছে। এ কে খন্দকার বইটিতে স্বাধীনতার ঘোষণা ও অস্থায়ী সরকার শীর্ষক অধ্যায়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করেছেন, যা অসম্পূর্ণ ও বিক্ষিপ্ত মন্তব্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে বিশ্ব পরিস্থিতি কেনো, কিভাবে আবর্তিত হয়েছিল এবং তার প্রতিক্রিয়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কতটা প্রভাব ফেলেছিল তার সার-সংক্ষেপ তুলে ধরতে তিনি অপারগ হয়েছেন। কেনো মুসলিম দেশগুলো সাহায্য করেনি? কেনো চীন-মার্কিন আঁতাত পাকিস্তানকে সক্রিয় সাহায্য করেছিল, কেনোই বা সোভিয়েত-রাশিয়া শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিল, তার বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যা না থাকায় আশ্চর্য হয়েছি! যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে তিনি ‘আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার’ যুক্তিতে দেখিয়েছেন। চীন পাকিস্তানকে সমর্থন দেওয়ার পরও কেনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি, তারও কোনো ব্যাখ্যা তার বইতে উল্লেখ নেই। অথচ মার্কিন গোপন দলিলে দেখা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে দুই পরাশক্তির মধ্যে বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি এনে দিয়েছিলো। যুক্তরাষ্ট্র প্রথম থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি। সেজন্য গোপনে যুদ্ধ বিমানসহ সামরিক অস্ত্র পাঠিয়েছে। চীনকে কিসিঞ্জার বলেছেন, বাংলাদেশ সীমান্তে সৈন্য পাঠাও। নিক্সন তাকে বারবার এ ব্যাপারে তাগাদা দিয়েছেন। অন্যদিকে সোভিয়েত-রাশিয়া চীনের সিয়াকিং সীমান্তে ১০ লাখ সৈন্য মোতায়েন করে, যে কারণে চীন বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার সাহস পায়নি। যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর পাঠালেও তার বিপরীতে সোভিয়েত-রাশিয়া পাল্টা নৌবহর পাঠিয়ে তার মোকাবিলা করে। এ কে খন্দকার তখন মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি হিসেবে দায়িত্বরত, এসব কথা তার অজানা ছিলো, তা কেউ বিশ্বাস করবে না।
নিক্সন সরকার খন্দকার মোশতাককে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ভাঙ্গন সৃষ্টি করার জন্য কিভাবে ষড়যন্ত্র করেছিলেন এ কে খন্দকারের বইয়ের ‘ভেতরে’ তা স্থান পায়নি। এটা ছিলো মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্ত। বইতে রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কে যে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে, এটি তাকে দোষারোপ করে লাভ নেই। ১৮ বছর একটানা পাকিস্তানে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিশাল জটিল-কঠিন প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তার যোগসূত্র ছিল সীমিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতা-কর্মী দীর্ঘ ২৩ বছর জেল-জুলুম, সংগ্রাম, লড়াই, আত্মত্যাগ ও আত্মবলিদানের মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বর্ণদুয়ারে জাতিকে প্রস্তুত করেছিলেন, সে পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের প্রতি প্রাপ্য মর্যাদা-সম্মান প্রদর্শন তো দূরে থাক, তাঁদের অবমূল্যায়ন করার মিশন নিয়েই এ কে খন্দকার বইটি লিখেছেন।
বইটিতে প্রতিবেশী ভারতের অসামান্য অবদানকে তিনি সামরিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন করেছেন। অথচ ভারতের অস্ত্র এবং কূটনৈতিক ও মানবিক সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রাথমিকস্তরে আঁতুড় ঘরে মারা যেতো। এ ক্ষেত্রে ‘১৯৭১ ভেতরে বাইরে’ বইটিতে যেসব বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে তার পুরোটাই নেতিবাচক। আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও অখ- একটি রাষ্ট্রের মধ্যে থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় ছিলো জটিল ও রক্তক্ষরিত। প্রচ- বৈরী শক্তির মোকাবিলা করেই ভারত ও বাংলাদেশ সরকারকে ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যেতে হয়েছে ২৩২ পৃষ্ঠার বইতে তার উল্লেখ নেই। বিশ্লেষণ নেই এবং পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে তিনি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন।
৩০ পৃষ্ঠার শেষাংশে এসে এ কে খন্দকার অসহযোগ আন্দোলনের বর্ণনা দিলেন এভাবে, ‘এ সময়ে যে লুটপাট শুরু হয়েছিল তা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। …অবাঙালিরা নিরাপত্তাহীনতার জন্য ঢাকা ছেড়ে যখন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এলাকা বা পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছিল, তখন রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাদের সোনার-গহনা, টাকা-পয়সা ও মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী লুট করে নিয়ে গিয়েছিল বাঙালিরা।’
এমন মিথ্যা কথা এবং অপবাদের ছড়াছড়ি ২৩২ পৃষ্ঠার বইটির প্রায় সর্বত্র। আমি এতে দোষের তেমন কিছু দেখি না। এ কে খন্দকার তো তখন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একজন অনুগত কর্মকর্তা। আর পাঁচজন বিমানসেনা ঐ সময়ের ঘটনাবলী যেভাবে বুঝেছেন ও ব্যাখ্যা করেছেন এ কে খন্দকার সাহেবও তাই করেছেন। তবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার পরেও তিনি বাঙালিদের এই ‘লুটতরাজ’ দেখে দেখে কেবল হা-হুতাশ করেছেন। তিনি ৩১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধকালেও এ ধরনের কিছু অপরাধমূলক বাঙালি দুষ্কৃতকারীদের সংবাদ আমরা পেতাম…।’
এ কে খন্দকারের পুরো বই ঘেঁটে বাঙালিদের প্রতি তার সহমর্মীতার চিত্রটি কোথাও পাওয়া যায় না। বিহারিদের হাতে সারা বাংলাদেশে যে হাজার হাজার নিরীহ বাঙালি নিহত হলো, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে, এ কে খন্দকার সে খবর পাননি। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করলে চলবে না। কারণ, তখন তো তিনি কলকাতায় আওয়ামী নেতাদের মাঝখানেই বসবাস করছিলেন। থিয়েটার রোডে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের পাশের ঘরেই তিনি থাকতেন। এছাড়া রক্তপিপাসু পাকিস্তানি হায়েনাদের নয় মাসব্যাপী নারকীয় হত্যাকাণ্ডের উল্লেখও তার বইতে নেই। আছে কেবল ২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল করা হলে নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের বিমানবাহিনীর গাড়িতে করে আজিমপুর থেকে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যাওয়ার সময় পথে-ঘাটে পড়ে থাকা ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার শিকার হাজারো লাশের কথা।
তিনি ৫১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘২৭ মার্চ সকালে ওদের (স্ত্রী, পুত্র, কন্যা) নিয়ে আসার জন্য নিজেই জীপ চালিয়ে আজিমপুর যাই। পথে রাস্তার দুই পাশে ভয়ঙ্কর ও বীভৎস দৃশ্য দেখি। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। কালো পিচের রাস্তা রক্তে লাল হয়ে গেছে। …স্ত্রীকে রাস্তার ডানে বামে তাকাতে নিষেধ করি এবং ছেলেমেয়েরাও যেন না তাকায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে বলি। কারণ রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা বীভৎস সব লাশ থেকে তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে।’
এ কে খন্দকার ২৭ মার্চ যেমন স্ত্রী ও পুত্র কন্যাদের রাস্তায় পড়ে থাকা লাশের থেকে চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখতে বলেছিলেন তেমনি যুদ্ধের গোটা নয় মাস তিনিও পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে নিহত লাখ লাখ মানুষের স্তুপাকার লাশ থেকে তার চোখ দুটো সরিয়ে রেখেছিলেন। বইটির কোথাও পাকিস্তানিদের হামলা, হত্যা, নারী নির্যাতন, লুণ্ঠন এসবের কোনো উল্লেখ নেই।
চট্টগ্রাম বেতার থেকে বেতার কর্মীদের ও চট্টগ্রামের জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নানের পঠিত বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা বহুবার প্রচারিত হলেও একদিন পরে রাস্তা থেকে ডেকে এনে মেজর জিয়াউর রহমানকে দিয়ে পাঠ করানো ঘোষণাটিই যে আসল ঘোষণা এ নিয়ে এ কে খন্দকারের মনে কোনো দ্বন্দ্ব নেই।
২৫ মার্চের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বাঙালি অফিসার ও সৈন্যরা যখন মুক্তিযুদ্ধে শরিক হওয়ার জন্য ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালাচ্ছে, সে সময়ে ২৭ মার্চ পাকিস্তানি হানাদারদের বিশ্বস্ত লোক না হলে এ কে খন্দকার কি কারণে আজিমপুরে তার ভায়রা ভাইয়ের নিরাপদ বাসা থেকে স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাদের ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে এলেন? পরদিন অর্থাৎ ২৮ মার্চেই তিনি ১৫ দিনের ছুটি নিলেন পালানোর জন্য। কিন্তু যেতে পারলেন না। ১৮ এপ্রিল ফিরে এসে ফের কাজে যোগ দিলেন। এর দশদিন পরেই তিনি আবার তিন মাসের ছুটি চাইলেন। অমনি মঞ্জুর হয়ে গেলো তার তিন মাসের ছুটি। এখানেও রহস্য রয়ে গেলো, এ কে খন্দকার কি স্বতস্ফূর্তভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন? নাকি, পাকিস্তানের পক্ষে বিশেষ কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন?
এ কে খন্দকার ৭৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘(১৫ দিন ছুটি ভোগের পর) চাকরিতে যোগদান করার দিনদশেকের মধ্যে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল এ রহিম খান ঢাকায় আসেন। তিনি আসার পর আমি আবার ছুটির দরখাস্ত করি। আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়, আমি ক’দিনের ছুটি চাই? আমি বললাম যে আমার কমপক্ষে তিন মাসের ছুটি লাগবে। তারা আমার ছুটি অনুমোদন করলেন।’
বইটিতে তিনি রাজনীতিবিদদের কর্মকাণ্ডের যথার্থ মূল্যায়ন করেননি। এর বিপরীতে তিনি অবমূল্যায়নের দিকে অগ্রসর হয়ে মুক্তিযুদ্ধকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছেন। তার মতো মানুষের পক্ষে এই ভ্রান্তি সহজে মুছে ফেলার নয়। তার অজানা থাকার কথা নয় যে, ভারত-বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তে ১২৫টির মতো যুব ক্যাম্প গড়ে উঠেছিলো। অনেক ক্যাম্পেই যুদ্ধ করতে আসা টগবগে যুবকদের ট্রেনিং দেয়া হতো। বেশ কয়েকজন গণপরিষদ সদস্য গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছেন এবং রণাঙ্গনে অংশ নিয়েছেন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া জনপ্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিমূলে সংগঠকের দুরূহ কাজ সম্পাদন করেছেন। ইতিহাস নাড়াচাড়া করলেই এ কে খন্দকার অনায়াসে এই তথ্যগুলো পেতে পারেন, যা তার বইতে স্থান পায়নি; বরং বিভ্রান্তিকর মিথ্যা বক্তব্য ছড়ানো হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার খসড়া সনদ রচনা করেন, যা সর্বসম্মতিক্রমে গণপরিষদ সদস্যরা এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়। এই খসড়া সনদের ভিত্তিতেই মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। সেই সরকার ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। রাজনৈতিক নেতা ও গণপরিষদের সদস্যদের কাছে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের উদাত্ত আহ্বান ছিলো, ‘জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে শত্রুদের আমরা অবরুদ্ধ করে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে দেশে ফিরিয়ে আনবো।’
প্রকৃতপক্ষে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিলো রাজনৈতিক যুদ্ধ এবং এর মূলভিত্তি ছিলো সর্বসাধারণের অংশগ্রহণে জনযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধের কোনো বিষয় নিয়ে অযথা বিতর্ক বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খণ্ডিত ফরমায়েশি রচনা স্বাধীন বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিতর্ক অনেক সময় সত্যকে আবিষ্কার করে, আবার কখনো কখনো তা ইতিহাস বিকৃতির সূত্র হয়ে দাঁড়ায়, এ কে খন্দকারের এই বিকৃতি অন্ধকারে ভ্রান্তি ছড়ায়।
১২টি মন্তব্য
রিমি রুম্মান
অনেক তথ্য সম্বলিত লেখা। ভাল লাগলো
সাতকাহন
ধন্যবাদ, রিমি।
মোঃ মজিবর রহমান
অজানা অনেক তথ্য জানলাম।
কপিও করলাম।
অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে।
সাতকাহন
ধন্যবাদ মজিবর রহমান।
মোঃ মজিবর রহমান
আমরা আপনাদের তথ্য থেকেই জানব বেশি।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
লেখাটা পর্ব ভাগ করে দিলে ভাল হতো তখন আর কেউ এড়িয়ে যেত না ।ভাল হয়েছে ইতিহাসকে এই আমরা এত বিতর্কীত করেছি যে কোনটা সত্য বলা মুসকিল।
সাতকাহন
ভালো বলছেন, তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সামরিকীকরণ করার ফলে আপনার মনের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে।
জিসান শা ইকরাম
কিছু কিছু অংশ পড়লাম।
ভালোভাবে অবশ্যই পড়বো।
সাতকাহন
ধন্যবাদ জিসান ভাই।
প্রজন্ম ৭১
এনার লেখাকে এত গুরুত্ব না দিলেও চলতো। এনার বইয়ের প্রচারটা আওয়ামী লীগই করে দিয়েছে। এমন কত বই আছে দেশে। প্রতিক্রিয়া এমন না হলে এনার এই বই একশত কপিই বিক্রী হতো কিনা সন্দেহ আছে।
বঙ্গবন্ধু কি জাতি জানে। কারো লেখায় বঙ্গবন্ধুর অবস্থান পাল্টে যাবেনা। বঙ্গবন্ধু যদি জয় পাকিস্থান বলেও থাকেন, তাতে সমস্যা কি ? তিনি একটি নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের মাঝ দিয়ে জাতিকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষনা দিলে, তাতে পাকিদের সুবিধা হতো। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিলে মুক্তিযুদ্ধই হতো না আর। ৭ মার্চ থেকে ধীরে ধীরে তৎকালীন পুর্ব পাকিস্থান সম্পুর্ন ভাবে বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রনে চলে আসে। ৭মার্চ থেকে ২৫ মার্চ এই সময়টুকু দরকার ছিলো আমাদের। প্রতিটি স্থানে যুদ্ধের ট্রেনিং হয়েছে। বাঙ্গালী প্রস্তুত হতে সময় পেয়েছে।আমার কাছে মনে হয়, জয় পাকিস্থান যদি বঙ্গবন্ধু বলেই থাকেন, তবে তা সঠিক ছিলো। পাকিরা বিচ্ছিন্নতাবাদি নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে চিনহিত করতে পারেনি সারা বিশ্বের কাছে।
আওয়ামী লীগ প্রচারে বারবার ভুল করে, এই বইয়ের লেখা নিয়ে প্রচারে আবার ভুল করেছে, এটা প্রমানিত হলো আবার।
১৯৭১ এর প্রেক্ষপটকে নিয়ে কতটা লেখা আছে নেতাদের ? যারা ঐ সময়ে মুজিব নগর সরকারে ছিলেন, সিনিয়র নেতা যারা মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করেছেন, তাঁরা কিছু লিখতে পারেন না ? বই লিখতে যদি না পারেন তাঁরা, ইতিহাস যদি লিখতে না পারেন, তবে বাইরের দু একজন যা বলবে তাই সত্যি মেনে নিবে জাতি।
সাতকাহন
গুরুত্বহীন করে রাখার ফলেই বারবার ইতিহাস বিকৃত হয়, তাই এর জবাব না দিলে এই ভুল তথ্য সম্বলিত বইটিকে এক শ্রেণীর মানুষ আঁকর গ্রন্থ হিসেবে আখ্যা দেবে।
শুন্য শুন্যালয়
আমরা যখন কোন একটি বই পড়ি, তখন কয়জনই বা তার সত্যি মিথ্যে যাচাই করি? বরং সেই বইটিকেই একটা সত্যি ধরে নেই। একজন নিরপেক্ষ মানুষ সেদিন ইউটিউবের একটা ভিডিও দেখে আমাকে জানালো শেখ মুজিবর রহমান তো আসলে এই দেশটি চায়নি, সে চেয়েছিল সায়ত্বসাশন। এই তো প্রমান দেখা যাচ্ছে এখানে। মূল ঘটনা বোঝার মতো যাচাই বাছাইয়ের ধৈর্য কই তার?
আপনার পোস্ট টি আমি সংরক্ষনে রাখছি অবশ্যই। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।