বছর কয়েক আগে এক বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম।
বাচ্চাটিকে মায়ের কথায় উঠবস করতে দেখে যারপরনাই ভাল লেগেছিল। উচ্ছ্বসিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম এতো সুবোধ হলো কি করে ? সেই ভাবী চোখে মুখে একঝাঁক হাসি ছড়িয়ে বললেন, মাইরের উপ্রে রাখতে হয়, বুঝলেন ? আমি বলি, দোয়া করবেন, আমার ছেলে দুইটা যেন এমন হয়। সুবোধ বালক হয়ে মায়ের কথা শুনে। তিনি উপদেশ দিলেন, কথা না শুনলে থাব্ড়ায়া দাঁত ফালায়া দিবেন, দেখবেন এক্কেবারে সোজা।
কিন্তু আমি তেমনটি হতে পারিনি।
বড়ছেলে রিয়াসাত চার বছর বয়সেও যখন কথা শিখেনি, তখন স্পীচ থেরাপি’র জন্য আবেদন করলাম।তাঁকে দেখতে বাসায় সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে দু’জন নারী এলেন। রিয়াসাত অচেনা মানুষজন দেখে অন্যরুমে পালিয়ে থাকলো। কিছুতেই সামনে আসে না। জোর করে নিয়ে আসতে বললেন তাঁরা। আমি বললাম, ” দ্যাখো, আমি অনেক কষ্ট করে তাঁকে দুপুরের খাবার খাইয়েছি। জোর জবরদস্তি করলে সে কান্না করবে, পাশাপাশি বমি করে ফেলবে “। অতঃপর তাঁরা আমাকে যা বললেন, আমার জন্যে বড় শিক্ষা হয়ে থাকলো। তাঁরা বলল, ” শুনো ম্যাম, তুমি যা বলবে, সেটি তাঁকে শুনতে হবে। কাঁদলে কাঁদুক, বমি করলে করুক। একদিন, দুইদিন, তিনদিন। তারপর সে লাইনে চলে আসবেই। ন্যায়-অন্যায়, সঠিক-বেঠিক শেখানোর এখনই সময়।” এরপর দিনভর তাঁর কার্টুন দেখা বন্ধ করার জন্যে নির্দিষ্ট সময়ের পর টিভি অফ করি। সে ফ্লোরে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে। একদিন, দু’দিন, তিনদিন চলে বুকফাটা কান্না। তারপর সে বুঝে যায় এটাই নিয়ম। টিভির মাঝে বুঁদ হয়ে না থেকে সে আমার সাথে খেলে। আমি অভিনয় করি, সে হোহো করে হেসে উঠে। খেলার ছলে কথা শেখাই, পড়াই। আমার আনন্দে সে আনন্দিত হতে শিখে, ব্যথায় ব্যথিত হতে শিখে। আমরা বন্ধু হয়ে উঠি। এখন সে তেরো। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতেই সন্ধ্যা নামে। মাগরিব পড়ে। গেইম খেলে, হোমওয়ার্ক করে। এশার নামাজ আদায় করেই ঘুমোতে যায়। আমার আর তাঁকে মাইরের উপ্রে রাখতে হয়নি।
ছোটজন রিহান। স্কুল থেকে ফেরার পথে গুনগুণিয়ে গান গায় দুর্বোধ্য কথা ও সুরে। আমি বলি, কি গাও ? সে লজ্জা পায়, হাসে। বাড়ি ফিরে গেইম খেলে।হোমওয়ার্ক করতে বললে বলে, গেইম শেষ করি, ওকে ? আমি জোর করি না।অপেক্ষায় থাকি। খেলা শেষে পড়তে বসে। হোমওয়ার্ক শেষ করে। নিয়ম অনুযায়ী তিরিশ মিনিট বই পড়ে। ঘুমানোর আগে রাজ্যের গল্প। স্কুলে কে কি করেছে সেইসব গল্প। শিক্ষক হয়ে আমাকে যোগ-বিয়োগ অংক দেয়। নাইন প্লাস থ্রি ইকুয়েল হোয়াট ? উত্তর সঠিক হলে বলে, “এইতো পারসো “। আমার আর তাঁকে থাব্ড়া দেবার প্রয়োজন হয় না।
গত উইকএন্ডে আমি সেই বাসায় জরুরি প্রয়োজনে গেলে ছোট্ট মেয়েটিকে দেখি। অনেক বড় হয়ে গেছে। স্কুল ফেরত মেয়েটিকে মা এটা সেটা খেতে জোর করছিলেন। উপর্যুপরি জোরাজুরিতে বিরক্ত মেয়েটি মায়ের সামনে এসে উচ্চস্বরে বলে উঠে, ” এটা আমার জীবন, আমি কি খাবো, না খাবো, সেটাও তোমার কথা মতো হবে ?” আমায় বৈকালিক চা নাস্তা দিতে দিতে ভাবী আক্ষেপস্বরে বললেন, আজকালকার উঠতি বয়সী পোলাপান, কিচ্ছু কওয়া যায় না, ওমনি তেলে বেগুনে জইল্লা উঠে “।
চা’ টুকু ওয়ান টাইম কাপে নিয়ে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মাঝে বাড়ি ফিরছি। হেঁটে যেতে যেতে বৃষ্টিভেজা চা পান করি আর ভাবি, প্যারেন্টিং আসলেই খুব কঠিন বিষয়। আমরা বাবা-মা’য়েরা সন্তানদের বন্ধু হয়ে উঠি ক’জন ? আমার বাবা-মা’কে খুব মনে পড়ে। চোখের সামনে ভেসে উঠে আমার বাবার বাসার ছাদের কোন এক বিকেলের কথা। তিন ভাই-বোন আর আম্মা, চারজন মিলে ক্যারাম খেলছিলাম। ক্যারাম বোর্ডের গুটির টুংটাং শব্দ, চোরামি করে জিতে যাওয়া, অভিমানে খেলবো না বলে চলে যাওয়া … আরো কতো গল্প, কতো স্মৃতি ! সামনে এক আকাশ ঘন কালো মেঘ। এতো বিষাদ কি করে ধরে রাখে আকাশ ?
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
১৮টি মন্তব্য
নিহারীকা জান্নাত
প্যারেন্টিং এর ক্যালকুলেশন সত্যি খুব জটিল। একবার হিসেবে ভুল হলেই ভুগতে হবে।
শুভকামনা পৃথিবীর সকল বাবা-মা’দের। -{@
রিমি রুম্মান
শুভকামনা আপনার জন্যেও … -{@
ব্লগার সজীব
আমার বাবা মা আমাকে মাইরের উপর রাখেননি।একারনেই আমি মানুষ হয়েছি। আর ট্যালেন্ট এর কথা নাইবা বললাম 🙂
সব মা যেন আপনার মত হয়।
রিমি রুম্মান
আমাকেও মাইরের উপরে রাখেননি ।
মানুষ হয়েছি কিনা জানিনা। মানবিক মন নিয়ে বেঁচে আছি।
ইঞ্জা
মারধর করে কেউ বাচ্চাকে মানুষ করতে পেরেছে কিনা আমার জানা নেই কিন্তু আমি আমার বাচ্চাদের মারধোর করা থেকে সব সময় বিরত ছিলাম আর আমার সিদ্ধান্ত আমাকে ভালো ফলই দিয়েছে বলেই আমার মনে হয়, দোয়া রইল আপু আপনাদের জন্য।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনিও।
অনেক দোআ আপনার বাচ্চাদের জন্যে।
ইঞ্জা
ধন্যবাদ আপু
জিসান শা ইকরাম
আপনি একজন গুড মম, এ কথা আমরা সবাই জানি,
সন্তান প্রতিপালনে আপনার কাছ থেকে শেখার আছে অনেক কিছু।
কিছু স্মৃতি ভুলবার নয়, আমরা ভুলতে চাইওনা।
শুভ কামনা।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন, দাদাভাই।
ছাইরাছ হেলাল
এটি মন দিয়ে সবার পড়া উচিৎ,
” শুনো ম্যাম, তুমি যা বলবে, সেটি তাঁকে শুনতে হবে। কাঁদলে কাঁদুক, বমি করলে করুক। একদিন, দুইদিন, তিনদিন। তারপর সে লাইনে চলে আসবেই। ন্যায়-অন্যায়, সঠিক-বেঠিক শেখানোর এখনই সময়।”
খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা আমাদের জানা থাকলেই হবে না, সফল প্রয়োগও করতে হবে ওদের মঙ্গলের জন্য।
রিমি রুম্মান
কারো একটি ভাল উপদেশ যে এমন ভাবে আমায় উপকৃত করেছে, এটি ভেবে আজো কৃতজ্ঞতায় নত হই।
নীলাঞ্জনা নীলা
সন্তানের প্রতি মাতা-পিতার দায়িত্বপালন পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ। মা হবার পরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আমি অনেক জেদী ছিলাম, কিন্তু মামনি কোনোদিন চিৎকার দিয়ে একটা কথাও বলেনি। অন্যদিকে বাপির বকা খেয়েছি প্রচুর, আর মারও। তো আমার মধ্যে বাপির চরিত্রের ভাগটা বেশী। তাই আমার খুব চিন্তা হতো তীর্থকে নিয়ে। কারণ প্রজন্ম ব্যবধান অনেক কিছুই বদলে দেয় কিনা!
রিমি আপু তুমি মা হিসেবে অনেক ভালো, তাই জানি বাবুরা মানুষ হবেই। আশীর্বাদ করো আমার ছেলেটা যেনো মানুষ হয়।
ভালো থেকো।
রিমি রুম্মান
তোমার ছেলের জন্যে আশীর্বাদ থাকে সবসময়ই।
ভাল থেকো, প্রিয় নীলা’দি।
নীলাঞ্জনা নীলা
কতোদিন পর এলে!
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সন্তানদের মানুষ করতে কিংবা আদেশে বাধ্য করতে শুধু স্নেহ ও ভালবাসার মাঝেই গড়ে তুলতে হয় আর তাদের গতিবিদি লক্ষ্য রাখতে হয়।আর মেরে কাউকে বাধ্য করা যায় এতে হিতে বিপরীত হয়।সুন্দর ভাবনাগুলো সেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ -{@
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন, নিরাপদ থাকুন।
শুভকামনা। -{@
ইলিয়াস মাসুদ
সবাই ভাল থাকুক, সবার জীবন সুন্দর হোক
সবাইকে এক নিয়মে এক ভাষাতে বুঝানো যায় না,ঘরের তিনটা বাচ্চা তিন রকমের হবে,কিন্তু মা তো একটাই,তাই মাকেই বদলে যেতে হবে তিনজনের কাছে তিন রকম, কি জানি আমার তাই মনে হয়,মা হয়ে বাচ্চার মনের ভেতরে কেন যে যেতে পারে না? তা হলে আর এত কষ্ট হত না
খুব সমসাময়িক বিষয় আপা
রিমি রুম্মান
খুব সুন্দর বলেছেন।
ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন। -{@