এক.
##একজন মুক্তিযোদ্ধা##

সন্ধ্যা হতেই আমরা ৫ জন একটা অভিযানের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করলাম। জংগলে লুকিয়ে রাখা অস্ত্রগুলো বের করে কাঁধে ঝুলিয়ে চাদর দিয়ে ঢেকে রাখলাম। আমাদের প্রত্যেকের গায়ে কালো রংয়ের চাদর। কালো রংয়ের পোশাকের সুবিধাটা হল অন্ধকারর সহজে দেখা যায়না। কালো চাদর পরার আরেকটি সুবিধা আছে তা হল শীত কম লাগে। তাই শীতের সময় অনেকে কালো পোষাক পরতে পছন্দ করে। প্রচন্ড শীত পরেছে। আমরা জংগলের পাশের রাস্তা দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। কেউ কোন কথা বলছিনা আর বেশি কথা বলাও ঠিক নয়।
“কোথায় যাচ্ছ তোমরা? আমাকে তোমাদের সাথে নিয়ে চল।”
চমকে উঠলাম আমরা। পেছনে তাকিয়ে দেখি ১৫ – ১৬ বছরের একটা ছেলে দাড়িয়ে আছে।
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বাড়ি কোথায়?
ছেলেটা পিছনে ইশারা করে বলল, ওই দিকে।
আমরা বুঝতে পারলাম ছেলেটার বাড়ি আশে পাশে কোথাও হবে। আমরা বললাম, তুলি আমাদের সাথে যেতে চাচ্ছ কেন?
ছেলেটা বলল, যুদ্ধ করতে যাব।
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কিভাবে জানলে আমরা যুদ্ধ করতে যাচ্ছি?
ছেলেটা বলল, তোমাদের আমি এর আগেও কয়েকবার দেখেছি।
আমরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, জংগলে অস্ত্র রাখতে দেখেছ কখনও? ছেলেটা বলল, তোমরা গতকাল কোথায় অস্ত্র রেখেছিলে তাও আমি জানতাম।
আমরা বললাম, কারো কাছে বলেদিয়েছ।
ছেলেটা না সূচক মাথা নাড়ল। প্রতিটি অভিযানের কার্যক্রমে আমরা খুব সাবধনতা অবলম্বন করতাম, যাতে কেউ কোন কিছু যেনে না যায়। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এরপর থেকে আরো বেশি সতর্ক হতে হবে। আমরা হাটতে শুরু করলাম। ছেলেটা আবার বলল, আমি তোমাদের সাথে যেতে চাই, আমাকে নিয়ে চল।
আমরা বললাম, তুমি এখনও ছোট, এই অল্প বয়সে তোমাকে যুদ্ধে নেওয়া ঠিক হবেনা।
ছেলেটা বলল, আমি মোটেও ছোট না আমার বয়স ২০ বছরের বেশি।
তবে আমরা নিশ্চিত ছেলেটার বয়স ১৬ বছরের বেশি হতে পারেনা।
আমরা বললাম, তোমার বাবা মা তোমাকে বকবে যদি জানতে পারে যে তুমি আমাদের সাথে যুদ্ধে গিয়েছ। ছেলেটা বলল, আমার বাবা আমাকে কিছুই বলবেনা। কিন্তু মা হয়ত বাধা দিতে পারে। তবুও আমি যেতে চাই। আমরা বললাম, ঠিক আছে আমরা তোমাকে আমাদের দলে নিয়ে নিলাম। তুমি এখানে দাড়াও আমরা অভিযান শেষ করে আসছি। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম ছেলেটা হয়ত চলে যাবে। আর যাওয়ারই কথা। কারন প্রচন্ড শীতের মধ্যেও ছেলেটা মাত্র একটা ফুলহাতা জামা গায়ে পরে আছে । মাঝরাতে আমরা ৪ জন অভিযান শেষ করে ফিরলাম। একজনের আর ফেরা হল না। গুলি খেয়ে মারা গেছে সে। জংগলের পাশের রাস্তা দিয়ে হাটছি আমরা চারজন। হঠাৎ সেই ছেলেটার সাথে আবার দেখা হল। ছেলেটা রাস্তার পাশে বসে আছে। রাত আনুমানিক ১ টা বাজে। আমরা ওকে দেখে অবাক হলাম আর অবাক হবারই কথা। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার তুমি বাড়ি যাওনি। ছেলেটা বলল, আমি তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমরা দেখলাম ছেলেটার মুখে প্রচুর মশায় কামড়ানর চিহ্ন। হয়ত সেই সন্ধ্যা থেকেই এখানে দাড়িয়ে মশার সাথে যুদ্ধ করছিল। আমাদের মধ্যে একজনের ব্যাগের মধ্যে একটা সোয়েটার ছিল।
সোয়েটারটা ছেলেটাকে দিয়ে বললাম, ঠিক আছে তুমি কাল থেকে আমাদের সাথে যাবে।
পরের দিন থেকে ছেলেটা আমাদের সাথে অভিযানে যাওয়া শুরু করল। কিছুদিনের মধ্যে অস্ত্র চালান শিখে গেল। আমাদের সাথে অনেক বড় বড় অপারেশনে অংশ নিয়েছে ছেলেটা। খুব দক্ষ যোদ্ধা হয়ে উঠেছিল ও। একদিন যুদ্ধ করতে গিয়ে ওর বুকে গুলি লেগে যায়। তাজা রক্ত বেরিয়ে আসছিল ওর বুক থেকে। ততক্ষনাতই ও মারা গেল। ও মারা যাওয়ার পর একজন দক্ষ ও সাহসী যোদ্ধার অভাব বোধ হল আমাদের। ছেলেটার নাম জয়নাল। পরে জানতে পারলাম ওর এক চাচাকেও পাকিস্তানিরা গুলি করে মেরে ফেলেছিল। সেই চাচা জয়নালকে খুব ভালবাসত। তারপর থেকে আমরা যখনই জংগলের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করতাম, জয়নালের কথা মনে পরত।

দুই.
##কলিংবেল##

টুং টাং টুং টাং। কলিংবেল বেজে উঠল। ৪ বছরের মেয়ে মিতি আনন্দে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। দৌড়ে যায় দরজা খুলতে। মিতির মাও সাথে সাথে যায় দরজা খোলার জন্য। দরজা খুলেই বাবার মুখের দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে থাকে মিতি। কোন কথা বলে না।
“তুমি এখনও ঘুমাওনি আম্মুটা? বাবার জন্য অপেক্ষা করছিলে?” মিতিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে করতে বলে মিতির বাবা।
মিতি চুপ করে থাকে, কোন কথা বলেনা।
মিতির মা বলে,তুমি একটু সকাল সকাল ফিরতে পারনা? মেয়েটাও তোমার জন্য রাত জেগে অপেক্ষা করতে থাকে।
মিতির বাবা পকেট থেকে চকলেট জাতীয় জিনিস বের করে মিতির হাতে দেয়। কিছুক্ষন মিতি কোন কথা বলে না শুধু চুপ করে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে যখন জড়তা কেটে যায়, মিতি তখন স্বাভাবিকভাবেই কথা বলতে শুরু করে, খেলতে থাকে, বাবার কোলে ঝাপিয়ে পরে, এটা ওটা চাইতে থাকে।

“বাবা তুমি আমাকে অফিসে নিয়ে যাওনা কেন?”
“অফিসে যে আমি কাজে ব্যাস্ত থাকি। তুমি আমার সাথে গিয়ে কি করবে, শুধু বসে থাকতে হবে।”
“বাবা সেই ঘোড়া দুইটা কোন দিকে গিয়েছিল যে ঘোড়া দুইটা গত শুক্রবার দেখেছিলাম?”
“অনেক দুর চলে গেছে।”
“আর আসবে না বাবা?”
“হ্যা আবার আসবে?”
“ঘোড়ার পুতুল পাওয়া যায়?”
“হ্যা তোমার লাগবে?” মিতি মাথা নাড়ে।
মিতির বাবা বলে, ঠিক আছে সামনের শুক্রবার কিনে দেব।
মিতি ঘর জুড়ে দৌড়াতে থাকে।

“ঘোড়া চলে টগবগ… ঘোড়া চলে টগবগ…”

মিতি ঘুমিয়ে আছে। টুংটাং টুংটাং কলিংবেল বেজে উঠল। মিতির ঘুম ভেংগে যায় কলিংবেলের শব্দে। মায়ের সাথে দরজা খুলতে যায় মিতি।

ওরা গত কয়েক বছর ধরে ঢাকায় বসবাস করে আসছে। মিতির বাবা একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। ডিউটি শেষ করে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায় তার। মিতির মা মিতিকে নিয়ে সারাদিন বাসায় থাকে। অপেক্ষা করতে থাকে মিতির বাবার জন্য।

সপ্তাহে একদিন অর্থাৎ শুক্রবার ছুটি থাকে মিতির বাবার। মাঝে মধ্যে আরো অনেক ছুটি পায়। ছুটির দিনে বিকেল বেলা মিতি ও মিতির মাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয় মিতির বাবা। কখনও মার্কেটে, কখনও পার্কে, কখনও চিড়িয়াখানায়। চটপটি ফুসকা কিনে খায়। মিতিকে নাগর দোলায় চড়ায়, খেলনা কিনে দেয়। সন্ধ্যার পরে বাসায় ফিরে আসে। আবার বড় কোন ছুটি পেলে অর্থাৎ ঈদ পুজার ছুটি, দেশের বাড়ি চলে যায় বেড়াতে। ছুটি শেষ হওয়ার আগেই ফিরে আসে ঢাকায়।

**********************************

রাত দশটা বাজে। টিভিতে হরতাল আর অবরোধের খবর প্রচারিত হচ্ছে। হরতাল সমর্থকরা গাড়িতে আগুন দিচ্ছে, দোকান পাট ভাংচুর করছে, বিভিন্ন যায়গায় হরতালের কারনে মানুষ মরছে এসব। মিতির মা মিতির বাবার জন্য অপেক্ষা করছে। মিতি জেগে আছে। মিতির মা বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। ঘরির কাটা নিজের নিয়মেই এগিয়ে যাচ্ছে।
মিতি বলে, বাবা এখনও আসছে না কেন?
নিষ্পাপ প্রশ্নের জবাব দেয় না মা। ১১ টা বেজে যায় ১২ টা বেজে যায় কলিংবেল বেজে ওঠেনা। মিতি ঘুমিয়ে পড়ে। মিতির মায়ের ঘুম আসে না। না খেয়ে শুধু অপেক্ষা করতে থাকে। রাত পোহায়, কলিংবেল বেজে ওঠেনা। তারপর দিন যায়, সপ্তাহ যায় মিতির বাবা ফিরে আসেনা। ১৫ দিনের মাথায় মিতিকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায় মিতির মা। পুরো ৬ মাস কেটে যায়।

মিতির নানী মিতির মাকে বলে, একটা ভাল ছেলে আছে, বিয়ে করবি?
মিতির মা বলে, আমার মেয়েকে মেনে নেবে?
মিতির নানী বলে, খুব ভাল ছেলে। ছেলেটা নিজেই তোকে পছন্দ করেছে। তোর ব্যাপারে সব কিছুই যানে। মিতির মা বলে, কি করে ছেলেটা?
মিতির নানী বলে, ঢাকায় চাকরি করে। ভালই বেতন পায়। বিয়েও করেছিল কিন্তু বউটা ওকে ছেড়ে গেছে। বউটাকে অনেক ভালবাসত।

কিছুদিন পরেই মিতির মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে হল। মিতিকে নিয়ে নতুন স্বামীর সাথে ঢাকায় আসল। স্বামী সকাল বেলা ডিউটিতে চলে যায়। অনেক রাতে বাসায় ফিরে আসে।
টুংটাং টুংটাং। টুংটাং টুংটাং। কলিংবেল বেজে ওঠল। মিতির মা দরজা খুলতে গেল। মিতিও মায়ের পিছু পিছু দৌড়ে গেল। দরজা খোলার পর মিতি তার দ্বিতীয় বাবাকে দেখতে পেল।

৫২৩জন ৫২৩জন
0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ