বিষয়—
২) এক অবহেলিত বৃদ্ধের কাহিনী—–
——————————————
আজকাল বৃদ্ধাশ্রম ই বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের একমাত্র স্থান —সেটা চিরন্তন হচ্ছে—বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যঁারা প্রতিষ্ঠিত তঁাদের একটুখানি যত্নে রাখা হয় কিন্তু রিটায়ার্ড পারসন রাও পয়সার জোরে ভালোই যত্ন পান বা অল্পবয়সী বৌমা বা গরিব হাঘরে পরিবারের মেয়েকে হুমকি দেখিয়ে সারাজীবন চাকরানী বানিয়ে ফাএ ফরমাস খাটিয়ে নিতেও পারেন–কিন্তু বিশেষ করে যারা সৎ ভালো প্রকৃতির লোক জীবনের সবকিছু ছেলে মেয়েদের দিয়েছেন –সয়তানী কি বা টরচার কি সেটাই জানেন না –তঁাদের কপাল ই বেশীরভাগ দুঃখ জোটে-কথায় আছে না সরল লোকের মরন ভালো–সেইসব লোকের ভাগ্যে টাকা থাকলে বৃদ্ধাশ্রম না থাকলে ছেলে মেয়ে বৌ র ধিক্কার শুনে বঁাচতে হয় । আ্যকচুয়ালি একজন বৃদ্ধ মানুষের অনেকটা ভালোবাসা প্রয়োজন –যেহেতু জীবনসঙ্গিনী শেষ বয়সে থাকেন একটা আপন হিউম্যান টাচ এইসময় খুব দরকারী অপরিহার্য বলে মনে করি– যঁারা খুব ভালো মানুষ তঁারা এই বয়সে ছেলে মেয়ে নাতি নাতনীর সামান্য ডাক ভালোবাসাতে অনেকটাই সহায় ও বঁাচার ভর পান — আত্মার মধ্যে একটা বঁাচার শক্তি কাজ করে –যতদিন বঁাচত তঁার থেকেও বেশিদিন বঁাচতে পারে । শুধু একটা ভালো আকর্ষের প্রয়োজন বেশী দরকার।
নব্বই বছরের একজন বৃদ্ধ মানুষের কথাই বলছি । চোখে ছানি পড়া,শ্যামলা ,তোতলানো কথা বলা ,কথা বলতে বলতে চারিদিকে থুথু ছিটকানো –এটা ওই বুড়ো মানুষটার একটা স্বাভাবিক রোগ বলা যেতে পারে ।
এই বুড়োর মেয়ে সাতজন –আগেকার দিনের লোক –খুব হিসেবী ও কিপটে । এক টাকা ও এদিক ওদিক যাওয়ার যো নেই–বুড়োর নাম চন্দ্রনাথ রায় ।
বুড়োর নিজের ছেলে ছিল না তবে পোষ্যপুত্র করে নেওয়া ছেলে কেই নিজের ছেলে হিসেবে মানুষ করেছে –ছেলেকে অনেককষ্টে পড়াশোনা করিয়ে ছেন –এখন ছেলেটি এক মস্ত বড় কোম্পানীর ইঞ্জিনীয়ার । খুব নামডাক –পরিবারে খুশির বণ্যা –ভাই চাকরী পেয়েছে মেয়েদের মানে বোনেদের আনন্দ কে ধরে –এটা দিতে হবে ওটা দিতে হবে বায়না —রায় পরিবারে তখন আনন্দের হুড়োহুড়ি।
দু তিনবছর বেশ ভালোই কাটছিল চন্দ্রনাথ বাবুর । কোন কষ্ট দুঃখ যে আসতে সে আন্দাজটাও করতে পারেন নি।
চন্দ্রনাথবাবুর তখন ষাট কি সত্তর । ছেলে রমেশ বিয়ে করে ফেললেন বাবাকে না জানিয়ে –তিনি খুব আহত হলেন –মনে খুব কষ্ট পেলেন কিন্তু ছেলে বৌকে খুবই ভালোবাসতেন । ছেলে ও ছেলে বৌ গ্রামের বাড়ি প্রতি বছর বেড়াতে আসতেন –খুব আনন্দ হত –পূজোতে সবার সংগে দেখা হত –যাইহোক ছেলেকে একদিক দিয়ে মন থেকে ক্ষমা ই করে দিয়েছিলেন —
রমেশের দুটি মেয়ে নাম চৈতালী আর মিতালী –ফুটফুটে নাতনী দেখে মন ভরে উঠল । এদিকে দশবছর চাকরী করার পর রমেশের কি হল কে জানে –হঠাৎ বলল–“জ্যাঠাবাবু আমার সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিন”—
শুনেই চন্দ্রনাথ বাবু কেমনজানি অসহায় মনে করলেন –ভাবলেন ভাইয়ের ছেলে নিজের রক্তের ছেলে তো নয় তাহলে কি করে বিশ্বাস করবেন–তাই তিনি মেয়েদের ডেকে জানতে চাইলেন –মেয়েরা বাবাকে কুবুদ্ধি দিয়ে সরাসরি মানা করলেন —রমেশ সেই কথা শুনেই কেমন মনমরা হয়ে থাকতেন –ভাবলেন কার জন্য এতসব করবেন?কেন করবেন?
এতোটাই চিন্তা করতে থাকলেন যে তিনি ডিপ্রেসনে চলে যেতেন –মদ খেতে শুরু করলেন–মদ সিগারেট খেয়ে প্রতিরাতে বৌকে মারধর করতেন –এমনকি ছোটো ছোটো মেয়েদের সামনে বৌকে অর্ধনগ্ন করে খাটের পা তে চুল বেঁধে বেদম পেটাতেন –দরজা বন্ধ থাকত তাই লোকে বেশীরভাগ সময় টের পেতেন না —
চন্দ্রনাথবাবু ছেলেকে ডেকে বোঝালে উল্টে ছেলে বাবার উপর তেড়ে মারধোর শুরু করতেন –এদিকে রমেশের চাকরী ছাড়ো ছাড়ো অবস্থা । চন্দ্রনাথবাবু এই বয়সে বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না । বৌ মারধর না সহ্য করতে পেরে দুটো মেয়ে ছেড়ে বাপের বাড়ি–তখন রমেশের বয়স চল্লিশ ।
বৌ হীন সংসার কি করে চলবে –বিয়ে করার জন্য অনেক জোরাজুরি করলেন –কোন ফল হল না –উল্টে কিছু বলতে গেলেই চন্দ্রনাথ বাবুর উপর তেড়ে আসতেন –আর পাগলের মতো একটা ছুরি নিয়ে ঘরের ভিতর বসে থাকতেন । পাগলামির চিকিৎসার জন্য অনেককেই ডাকা হল –কিছু ফল হয় নি –উল্টে ডাক্তারকে মারধর গালিগালাজ দিয়ে তাড়িয়ে দিতেন —
মেয়েদের উপর এই পাগলামির ফল মারত্মক –দুটো মেয়েকেই কারনে অকারনে মারধোর –দাদু বাধা দিতে গেলে তঁাকেও–দুটো বাচ্চা আর চন্দ্রনাথ বাবুর জীবন পুরো নরক হয়ে উঠেছিল—মেয়ে দুটো কোনক্রমে মাধ্যমিকের দোড়গোড়ায় পৌঁছালো –ছোটো মেয়েকে কাকু অশিক্ষিত কু পরামর্শে প্রায় জোর করেই ষোল বছরে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় –বিয়েতে মেয়েকে একপ্রকার খালি হাতেই পাঠানো হল–বড় জ্যাঠি মেজো জ্যাঠি এরা তো নরকের নর রাক্ষসী–মেয়েদের মমতাময়ী রূপের ডাইনি রূপের এক প্রতিবিম্ব–!
যাইহোক ছোটো মেয়ে শশুড়বাড়িতে লাথি ঝঁাটা খেয়ে বঁাচতে লাগল। কোনক্রমে বেঁচে আছে –সেটাই বলা যেতে পারে—মা র কোন খবর পাত্তাই নেই–সত্যি সংসারে এমন মা যেন কারো কপালে না জোটে–!
বড় মেয়ে নিজের চেষ্টায় গ্র্যজুয়েশনটা কোনক্রমে কমপ্লিট করলেও শ্বশুড়বাড়িতে তঁার অশান্তির শেষ নেই—
চন্দ্রনাথবাবু সব দেখছেন বুঝছেন –কিন্তু কিছুই করতে পারছেন না —একজন নব্বই বছরের বৃদ্ধ কি করতে পারে বলুন তো —তঁার চোখ কেবলই আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃত্যু কামনা করে —তাকিয়ে তাকিয়ে চোখের জল ফেলতেন আর রান্না করা ভাত বমি করে ফেলতেন —একপ্রকার মন থেকে মরেই গিয়েছিলেন—¡
রমেশ একজন পুরোপুরি বদ্ধ পাগল –চিকিৎসার খুব প্রয়োজন কিন্তু কোনো বোন ই চিকিৎসা করাতে রাজি হলেন না বরং বাবাকে বললেন
এরকম ভাই মরে গেলেই নাকি মঙ্গল–¡
একদিন সকালে চন্দ্রনাথ বাবু পাগল ছেলেকে ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলেন — কিন্তু কোথায় যাবেন ? ভিটে মাটি /জন্মস্থান ছেড়ে যেতে মন চাইলো ই না— ছেলের হাতে এই বুড়ো বয়সে লাথি গঁুতো খাওয়া একপ্রকার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল–
তাছাড়া মেয়েরা এতোটাই লোভী স্বার্থপর যে তঁাদের কাছে গিয়েও কোন লাভ হত না–¡
একদিন নাতনীর মার খাওয়া শুনে দুঃখে ক্ষোভে হার্ট আ্যাটাক করলেন –ভাইয়ের আর ছেলেগুলো এই সময়ের সুযোগ খঁুজছিল –তঁারা চন্দ্রনাথবাবুকে ভালো ডাক্তার না দেখিয়ে প্রায় একপ্রকার মেরেই ফেললেন —হায় ভগবান মানুষটা র এতো সম্পত্তি থাকতেও –ছেলে থাকতেও –নাতনী থাকতেও মৃত্যুকালে নাতনীদের মুখ দেখতে পাননি–মৃত্যুকালে এতোটুকু শান্তি মানুষটাকে কেউ দিল না—ভগবানের কাছে চন্দ্রনাথ বাবুর আত্মার শান্তি কামনা করি—¡
নাতনীদের জীবনেও এতোটুকু সুখ ছিল না–হয়তো অদৃশ্য অভিশাপ কাজ করছিল–হয়তো দাদুর আশীর্বাদ জীবনে থাকবে বিষময় অশান্তি রূপে —ভুল মানে একটা ভুল মানুষের জীবনে মারাত্মক বিভীষিকা হয়ে দঁাড়ায়–!
আপনারা চন্দ্রনাথ বাবুর আত্মার শান্তির পাশাপাশি দুই নাতনী র জীবন যাতে সুখময় হয় সেই প্রার্থনা করুন—ফুলের মতো বাচ্চা দুটোর জীবন নষ্ট হয়ে শেষ হয়ে কোনোরকম মরেই বেঁচে আছে লাথি ঝঁাটা খেয়ে—¡
অরুণিমা মন্ডল দাস, বসন্তপুর ,অক্ষয়নগর,কাকদ্বীপ ,দক্ষিন চব্বিশ পরগনা
৭৪৩৩৪৭—৯৮০৪৫৫২৮০৭
১০টি মন্তব্য
অরুণিমা
সোনেলার সবাইকে লেখাটি পড়তে অনুুরোধ করছি
নীহারিকা
সত্য ঘটনা দিদি? খুবই মর্মান্তিক। এমন জীবন যেনো কারোরই না হয়।
ছাইরাছ হেলাল
ঈশ্বর তাদের মঙ্গল করুন,
এটুকু বলা ছাড়া আরা কিছু ভাবতে পারছি না।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
স্রষ্টা তাদের মঙ্গল করুক দূর থেকে এই কামনা -{@
জিসান শা ইকরাম
মন খারাপ হয়ে গেল পড়ে।
মিষ্টি জিন
সৃষ্টিকতা সবার মংগল করুন। কারো জীবন যেন এমন বিভীষিকা ময় না হয়।
অরুণিমা
সবাইকে ভালোবাসা/এবারে বলুন দুটো মেয়ে কিভাবে বঁাচবে?
নীলাঞ্জনা নীলা
কি মন্তব্য করবো? কি বলবো আমি? শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই নেই দেয়ার। কারণ যাদের ক্ষমতা থাকেনা, তাদের ওই দীর্ঘশ্বাসই থাকে।
ইঞ্জা
দিদিভাই, লেখাটি কি সত্য ঘটনা?
মনটা ভারি হয়ে গেল।
সঞ্জয় কুমার
প্রচন্ড কষ্টের কাহিনী । ঈশ্বর তাদের সহায় হোন