সোনিয়ার বিবাহিত জীবনের আজ বাইশ বছর। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সোনিয়া ভেবেছিল জাফরের মনে নেই, মনে থাকবেও না। না এ নিয়ে জাফরের প্রতি কোন অভিমান বা রাগ কোনটাই তার নেই, বরং এটা নিয়ে এটা সেটা বলে খুনটুসি করে সোনিয়া একরকম মজা পায়।
আজ ঘুম ভাঙ্গল জাফরের হাতের স্পর্শে। গায়ে হাত দিয়ে টেনে নিয়ে কপালে চুম দিয়ে বলল ‘ভালবাসি’। সোনিয়া এক মুখ হাসি নিয়ে জাফরের বুকে মাথা রাখল।’ভালবাসি’এই কথাটা জাফর খুব কম বল,খুবই কম। হয়ত এই বাইশ বছরে বিশবার বলেছে অথবা আরও কম। বিয়ের পর সোনিয়ার খুব ইচ্ছে করতো এই কথাটা শুনতে ,কিন্তু জাফর কখনই বলতো না। একদিন একদম্পতি ওদের বাসায় এসেছিল,তাদের কথায় কথায় ভালবাসার বহির্প্রকাশ, হাসি,মধুর সম্ভাষন সোনিয়াকে মুগ্ধ করে। একধরনের ঈর্ষা নিয়ে সময় কাটায় । রাতে একান্তে ওদের সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত করলে জাফর বলে,”বেশী বেশী,লোক দেখানো কোন কিছু ভাল না। আমি ভালবাসি এটা আমার নিজস্ব গোপন ব্যাপার। বাইরের মানুষ তা জানবে কেন? সমস্যা থাকলে মানুষ এমনই জানবে না থাকলেও এমনিতেই বুঝবে, ”
“আমায় ভালবাসো?”
“তুমি বোঝনা?” সোনিয়ার চোখে পানি চলে আসে, ” বুকে জড়িয়ে বললো –“পাগলীটা” পর মুহূর্তেই জাফর হো হো করে হেসে উঠেছে, ও এই জন্য তুমি ওদের কথা বললে? চালাকী না। “ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি।”
সোনিয়ার মনে হয়েছে আসিলেই তো, এটাই তো হওয়া উচিত।
এরপর কেটেছে এই দীর্ঘ জীবন। অথচ মনে হয় এই তো সেদিন। আজ হিসাব করতে বসলে এককথায় নির্দ্বিধায় সোনিয়া বলে,বলতে পারে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী।
কিন্তু একটা অকারন অভিমান মাঝে মাঝেই হয় সোনিয়ার। কেন হয়? হয়তো সুখে থাকলে ভুতে কিলায় বলে!
২১ আগস্ট। স্বাধীন বাংলাদেশে বর্বোরোচীত ঘটনার একটি দিন। যেদিন তদানিন্তন সরকারী বাহিনী ঝাপিয়ে পড়েছিল নিরিহ মানুষের উপর।
এদিন ঘোর সংসারী সোনিয়ার কিছুতেই মনে থাকার কথা নয় যে আজ আওয়ামিলীগের মহাসমাবেশ। জাফর অফিসে যাবার পরই সোনিয়ার মনে হল আজ সে পুরানঢাকায় যাবে তার মামাশ্বশুরের বাড়িতে। সোনিয়া একাই যেতে পারে কিন্তু দেড় বছরের বাচ্চাটাকে নিয়ে যেতে হলে গাড়ি হলে ভাল হয়। যেমন চিন্তা তেমন কাজ, এটা সোনিয়ার স্বভাব। জাফরকে ফোন করে বলল গাড়ি পাঠাতে। জাফর হয়ত ব্যাস্ত ছিল, সরাসরি বলে দিল না আজ বেড় হবে না। আর গাড়িতো যাবেই না, পুরানঢাকা তো নয়ই। খুব রাগ হল সোনিয়ার। ফোন রেখেই দিল।
বাচ্চাকে রেডি করে নিজে সিএনজি ডেকে চলে গেল। সেখানে আদরে আপ্যায়নে পরিতৃপ্ত সোনিয়া তিনটার দিকে বেড় হল বাসায় আসার উদ্দেশ্যে। কোন ট্যাক্সি বা কোন সিএনজি পেল না। ছোট ছোট দূরত্বে রিক্সা করে এল। এরপর আর কোন রিক্সাও শান্তিনগরে আসবে না। গুলিস্থানে এসে দেখে সাত/আটজন পুলিশ দাঁড়িয়ে বসে হাসাহাসি করছে। তাদের জিজ্ঞাসা করল—” ভাই ট্যাক্সি কোথায় পাব?” তারা তাকে পল্টনের রাস্তা দেখিয়ে দিল। ‘সোজা গেলেই পাবেন।’ কি যে হয়েছে সেদিন সোনিয়া বাচ্চাটাকে কোলেও রাখতে পারছে না। খুব ক্লান্ত লাগছে। খুব রাগ হচ্ছে জাফরের উপরে। কি ক্ষতি হতো গাড়িটা দিলে! আমি চাইলাম আর বলে কিনা গাড়ি দেব না, ওর গাড়িতে আর জীবনেও চড়ব না। মোবাইল নেটওয়ার্কও নেই। এত্ত মানুষ! এত্ত মানুষ কেন ? কোথাও সমাবেশ হচ্ছে কি? মাইকে কেউ যেন বক্তৃতা দিচ্ছে। হঠাৎ পৃথিবী কেঁপে উঠল। মানুষ ছুটছে, চিৎকার করছে, পালাচ্ছে। সবাই বলছে পালাও,পালাও,বোমা,বোমা। সোনিয়া কোন দিকে পালাবে? দেড় বছরের বাচ্চাটা শুধু এদিক ওদিক দেখছে আর বলছে মা উজে ভয় মা উজে ভয় রক্ত।
থাক সেই বর্ননা। সোনিয়ার অভিমান নিয়ে লিখছে, অভিমানের কথাই হোক।
রাত নয়টায় সোনিয়া যখন বাসায় পৌঁছাল, তখন অনেক পানি ঘোলা হয়েছে, সারাবাড়ি অফিসের লোকজন দিয়ে ভর্তি। সেই উপাখ্যান জাফরের। সোনিয়া রিকসা থেকে নেমে কলিংবেল বাজালো। চারতলা থেকে চিৎকার ভেসে এল এসেছে , এসেছে। ক্লান্ত সোনিয়া প্রথমেই পা থেকে পেন্সিল হিল খুলে ফেলল। এরপর সিঁড়িতে শুয়ে পড়ল। কে বাচ্চাটাকে নিল কে ব্যাগ উপরে তুলল কে সোনিয়ার মাথায় পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরাল সোনিয়া তা তখন দেখেনি, কিন্তু পরে শুনেছে। জাফর একবারের জন্যও নামেনি বা কিছু জিজ্ঞাসা করেনি কাউকে। একতলার ডাক্তার বউদি সেখানেই ডিক্লারেসন দিয়েছে ভাবী মনে হয় কন্সিপ করেছে।
চারতলায় এলাম ঘরে ঢুকেই সোনিয়া দেখে জাফর টিভি দেখছে। একটা কথাও বলেনি, কেমন আছ, কি হল , কোথায় ছিলে? কিচ্ছু না।
এরপর কেটে গেছে সাতদিন। একটিবারের জন্যও সে প্রয়োজন ছারা কথা বলেনি। ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়েছে। সেদিনের জাফর উপখ্যান শুনেছে সোনিয়া লোক মুখে । তার অস্থীরতা, তার ব্যাকুলতা, তার উদ্বেগ সবই ঠিক আছে। তার কথা সোনিয়া শুনেনি এও সত্য, কিন্তু সোনিয়া তার প্রাপ্য শাস্তি পেয়েছে, তার সন্তান কোলে নিয়ে ছুটে চিলেছে, অজ্ঞাতে হলেও তার গর্ভে আরও একটি সন্তান ছিল, এই দুটিকে নিয়ে সোনিয়া কেমন করে বেঁচেছে,একটিবারও কি কপালে হাত দিতে পারতো না। জাফরের অভিমানটাই বড়। আজ পর্যন্ত ও প্রসঙ্গে জাফর কিছুই বলে না।
এই একান্ত খুব সুন্দর একটি সময়েও সোনিয়ার সেই অভিমানের কথাই মনে পড়ল।
২২টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
প্রায় চার মাস পরে লিখলেন । যদিও মাঝে-সাঁজে চোখ ফেলেছেন ব্যস্ততায় ।
ন্যাক্কারজনক এক হত্যাকাণ্ডের কথা মনে করিয়ে দিলেন ।
সুন্দর লেখায় ব্যক্তিজীবনের ভালোবাসার প্রতিফলন দেখিয়েছেন ।
খসড়া
ভাল থাকুন , ঝামেলা খুবই ব্যাক্তি জিবনের, এসব বলা মানে শুধুই অজুহাত। ভাল থাকুন।
নীলাঞ্জনা নীলা
পড়লাম অভিমানের কথা। কিন্তু জাফর কেনো এমন করলো তার কোন কারণ খুঁজে পেলাম না। কেমন স্বামী সে ? সোনিয়ারা ভালো থাকুক।
খসড়া
জাফরতো নিষেধ করেছিল। সে হয়তো ভাবছে আমি বলেছিলাম সমাবেশ ওদিকে যেও না , সোনিয়া ভাবছে সে তো সমাবেশের কথা বলে নি। তা ছারা জাফর সনিয়া বাসায় না পৌঁছান পর্যন্ত যা যা করেছে তা তো তার চরম উৎকণ্ঠা থেকেই করেছে। এই অভিমানটাই সে পুষে রেখেছে বুকের গভীরে। সেই সময়ের জাফরের কর্মযজ্ঞ আর একদিন বলবো তবেই বুঝবেন জাফরের অভিমান কেন?
লীলাবতী
এই সব অভিমান নিয়েই আমাদের জীবন। কেউ প্রকাশ করে কেউ করেনা। কয়েক মাস পরে আপনার লেখা পেলাম ভাইয়া। মিস করি আপনাকে খুব ।
খসড়া
হ্যাঁ জাফর খুব চাপা এই ব্যাপারে, থাকনা কিছু অভিমান, তা না হলে জীবনটা তো পানসে হয়ে যায়। সব সময় মিষ্টি কি ভাল লাগে লীলাবতী, তার মাঝে নুন, ঝাল, টক, তেতো সবই চাই।,
স্বপ্ন নীলা
মান আর অভিমান ——–
ভাল লেগেছে ——-
ভাল থাকবেন সব সময়
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
এই একান্ত খুব সুন্দর একটি সময়েও সোনিয়ার সেই অভিমানের কথাই মনে পড়ল। -{@ (y)
ব্লগার সজীব
অভিমান মানুষকে অনেক সময় দূরে সরিয়ে নেয় ভাইয়া। সে দুরত্ব আর অতিক্রম করা যায় না । এত মাস পরে পোষ্ট দেয়া মানবো না ।
শুন্য শুন্যালয়
দুজনেই এক অভিমান জমা করে রেখেছে, থাকুক কিছু অভিমান, শুধু বাড়িয়ে না তুললেই হলো। ভূতে মাঝে মাঝে না কিলালে সুখ পানসে হয়ে যাবে যে। সোনিয়া আর জাফর এর জন্য রইলো অনেক শুভকামনা, এমন সুখে শুধু বাইশ কেনো কএক যুগ পার করা যায়।
আপনি এমন দেরি করে লিখলে আমাদেরও অভিমান হয়।
খসড়া
প্রিয় মা মাটি আসলে অভিমান এমন এক জিনিস যা অসময়েই মনে পরে।
খসড়া
আপনিও ভাল থাকুন স্বপ্ননীলা।
খসড়া
প্লিজ ব্লগার সজীব আপনি আবার অভিমান করে দূরে যাবেন না।
খসড়া
শূন্য শূন্যালয় আসলেই দুজনই অভিমান করে আছে। 🙂 ভাল থাকুন।
জিসান শা ইকরাম
এই সব মান অভিমান নিয়েই আমাদের সংসার, আমাদের দিন রাত্রি ।
ভালো লিখেছেন।
মেঘাচ্ছন্ন মেঘকুমারী
কিছু অভিমান আসলে থাকা ভালো । আপনার লেখাটি ভালো লেগেছে।
খসড়া
জিসান ভাইয়া মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। কেন জানিনা জবাব উইন্ড খুলছে না তাই মন্তব্যে নাম উল্লেখ করে দিচ্ছি।
খসড়া
মেঘকুমারী ভাল থাকুন।
লীলাবতী
এমন অভিমান কিন্তু মধুর ও হয় ভাইয়া। এত বিলম্বে পোষ্ট দিলে কিভাবে হয় ? আমি কিন্তু অপেক্ষা করি আপনার পোষ্টের জন্য।
খসড়া
রাগ যদি হয় মধুর এমন হোক না রাগ।
শিশির কনা
এতমাস পরে লিখলেন অভিমান নিয়ে। আমিও অভিমান করলাম আপনার উপর ভাইয়া। প্রতি সপ্তাহে একটি পোষ্ট না দিলে আপনার সাথে কথা বলবোনা। লখাটি খুব খুব খুব ভালো লেগেছে।
খসড়া
কষ্ট যদি হয় আনন্দের তবে আর কি?