একজন অর্নব ও আমি

নীরা সাদীয়া ২৮ মার্চ ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ১২:০১:১৫পূর্বাহ্ন গল্প ১৫ মন্তব্য

অর্ণবের সাথে আমার প্রথম দেখা কবে, কোথায় তা একটা ছোটখাট ইতিহাস। তবে প্রথম দেখেই কেন যেন খুব মনে ধরে গেলো। এমন কথায় খুব অবাক হচ্ছেন? কথাগুলো একটা ছেলে মুখে যতটা কমন, মেয়ের মুখে ততটাই আনকমন। কমন বা আনকমন শব্দের মানানসই কোন বাংলা পাচ্ছি না, যাই হোক, কথা হলো অর্নবকে আমার মনে ধরেছে! হালকা পাতলা গরন, কিছুটা ফর্সা গায়ের রঙ, বেশ লম্বা দেখতে। ফুল হাতা শার্ট পরে স্লিভ ভাঁজ করে রাখে। শার্টের রং, ডিজাইন বেশ রুচিশীল। মনে ধরার পরপরই তাকে পছন্দের বিষয়টা জানালাম এবং সে আমার সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নিয়ে হ্যাঁ সূচক মতামত দিলো। বলা চলে তার হাত ধরেই শুরু হলো এক অন্য জীবন।

আমি মধুমিতা, কারো কাছে শুধু মিতা। আমার পরিবারে আমি একা, একদম একা। কে কবে একটা এতিমখানায় এনে রেখে গেছিলো, তা মনে নেই। সেখানে ভাত আছে তো ডাল নেই, ডাল আছে তো নূন নেই…এভাবে বেড়ে উঠেছি। ছোট থেকেই দেখতে বেশ ফুটফুটে ছিলাম, এরই সুবাদে কিনা জানি না, এতিমখানা পরিদর্শন করতে আসা একজন ফাদার আমাকে দত্তক আবার একটা খৃষ্টান মিশনারি স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। এরপর থেকে আমি ওখানেই পাঠ নেই, বেড়ে উঠি যীশু খৃষ্টের আদর্শে। যদিও আমার মনের ভেতর নির্দিষ্ট কোন ধর্ম নেই। একসময় পাঠ করা বিদ্যে ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে মিশনারি স্কুলের বাহিরে এই পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে পা রাখি।টিউশন করিয়ে, খেয়ে না খেয়ে একাডেমিক শিক্ষাটা শেষ করি। ভাগ্যিস অভাবের সাথে জন্মের পরদিন থেকেই পরিচয় ছিলো। শিক্ষাজীবনের ইতি টানার পর হন্যে হয়ে একটা চাকরী খুঁজতে থাকি। বাহিরে খুব একটা পরিচিত কেউ না থাকায়, সিভি নিয়ে এ পথে ও পথে দৌড়াতে দৌড়াতে মাথার ঘাম পায়ে পরতো। চাকরী পেতে পেতেও হারিয়ে ফেলতাম। এভাবে খাবি খেতে খেতে একদিন একটা স্কুলে চাকরী পেয়ে যাই। ঢাকার ভেতর ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, তাই বেতন ভালো দেয়, পুরো চল্লিশ হাজার। একজন মানুষের জন্য এত টাকা লাগে না। টাকা হাতে এলে মানুষের ভীমরতি হয়, আমারও তাই হলো।খুঁজে নিলাম অর্নবকে।

অর্নবকে নিয়ে আমার নতুন সংসার।দুজন থাকার মত নিরিবিলি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম। একটা দুটো করে হাঁড়ি পাতিল কিনি, আলমারি কিনি। দেখতে দেখতে তৈজসপত্র আর আসবাবে কেমন সেজে উঠলো আমার নতুন বাড়ি। ওর জন্য নিজের মনমত পোশাকও কিনলাম। ব্যবহারের সকল জিনিস একে একে কিনে এনে পুরোদস্তর সংসারী হয়ে উঠলাম। সকালে স্কুলে যাই, অর্নব বাসায় থেকে টুকটাক কাজ করে আর আরো একটি দিন বেঁচে থাকার জন্য রসদ সংগ্রহ করে। বিকেলে তার হাত ধরে আমি ঘুরতে যাই, কখনো পার্কে, কখনো রেস্তোরাঁয়। আমাদেরকে যেই দেখে সেই ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকে। চেয়ে থাকে থাকুক,তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না।

একদিন ইস্টার সানডের ছুটিতে ঘরে বসে ম্যাগাজিন পড়ছিলাম। অর্নব চা করে নিয়ে এলো। পাশে বসে চুলের ভেতর একটু একটু করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মাথার চুলে হালকা একটু টেনে টেনে হাত বুলিয়ে ম্যাসাজ করে দেওয়াটা আমার দারুন প্রিয়। আমি খুব আরামে একটু সুখনিদ্রায় বিভোর হলাম। তখনই মনে হলো, কেন আমার জীবনটা স্বাভাবিক আর পাঁচজনের মত হলো না? আমার কোন পরিবার নেই, আত্নীয়-স্বজন নেই, এই পৃথিবীতে আমি একদম একা!চারদেয়াল ঘেরা মিশনারির বাহিরে পড়াশোনা করতে এসে কিছু বন্ধু জুটেছিলো কপালে। কিন্তু তাদের কারো সাথেই কেন যেন মানিয়ে উঠতে পারলাম না। মেয়েরা দেখি প্রেম নিয়ে ব্যস্ত। আমার কোন পরিচয় নেই বলে প্রেম করা সম্ভব হলো না। কেউ টাইমপাস করতে যে চায়নি, তা নয়। তবে নিজের পরিবার নেই বলে নৈতিকতা থেকে সরে আসার কথা ভাবতেও পারিনি। আর ছেলে বন্ধু? সে তো মস্ত ব্যপার! কিছু কিছু ছেলে এত গোঁড়া টাইপ, কথায় কথায় বুঝিয়ে দেয় যে আমি মেয়ে, মানুষ নই মোটেও। এসব সহ্য করে মেয়ে হবার অপরাধে লজ্জিত হয়ে মাথা নীচু করে কাঁচুমাচু হয়ে টিকে থাকতে আমি পারিনি।তাদেরকে বুঝিয়েছি, মেয়ে হওয়া লজ্জার নয়, বরং গৌরবের। যারা এটা বুঝতে চায়নি তাদেরকে ত্যাগ করেছি। ভাগ্যের কী পরিহাস, পরবর্তীতে যেখানেই যাই, পদে পদে তাদেরই দেখা পাই। একটা নতুন জায়গা, নতুন কর্মক্ষেত্র, সেখানে প্রবেশ করেও দেখি তাদের কেউ না কেউ রয়েছে সেখানে। আমি মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই, এহেন মস্তবড় অন্যায় তারা হজম করতে না পেরে কর্মক্ষেত্রে নিত্য নতুন জটিলতা তৈরি করতো আমার জন্য। বারবার আমার সাথেই ঘটত নানান অপ্রীতিকর ঘটনা। ফলে আমার ওপর সকলেই অতিষ্ঠ হতো। কেউ আমার দিকটা বুঝতো না,কিংবা আমিই বোঝাতে পারতাম না। ফলে যা হবার তাই হতো। নতুন কোন কাজ খুঁজে পেলে আগের তিক্ত কর্মস্থলটা ছেড়ে দিতাম।দিনকে দিন মানুষের প্রতি মনে একটা ঘৃণা জন্মাতে লাগলো। এভাবে কয়েকটা কাজ বদল করার পর এই স্কুলের চাকরীটা পেলাম। না, এখানে আমার পূর্ব পরিচিত কেউ নেই। ফলে এখানে টিকে আছি তিন বছর ধরে। আর অর্নবের সাথে চলছি এক বছর হলো।

সেদিন বাসায় ফিরে দেখি কারেন্ট নেই। সকাল থেকে কারেন্ট ছিলো না। অর্নবের অবস্থা খুব সংকটময়। সে লম্বা হয়ে বিছানায় পরে আছে। আমি তাৎক্ষণিক বিদ্যুৎ অফিসে ফোন করলাম। কিছুক্ষণের মাঝেই সব ঠিক হয়ে গেলো। কিন্তু মনের ওপর দিয়ে বয়ে গেল এক বিশাল ঝড়। আমার জীবনে যে কী ঘটতে চলেছিলো, তা কেবল আমিই জানি। তবে পরক্ষনেই সব স্বাভাবিক হওয়ায় রাতের রান্না চাপাতে গেলাম। খেয়ে সব গুছিয়ে বাড়ান্দায় এসে দেখি চাঁদ উঠেছে। অর্নবকে আর ডাকলাম না, একাই বসে বসে চাঁদের আলোর ময়না তদন্ত করলাম। চাঁদকে জিজ্ঞেস করলাম,

“অন্যের ধার করা আলোয় রূপবতী সেজে তোমার লাভ কী?”
চাঁদ হেসে কুটি কুটি। বললো,
“কেন তোমার হিংসে হয়?”
আমি বললাম “হয় তো খানিকটা।”
চাঁদ বললো, “একটু আলো মেখে নাও, সব ব্যাথা ধুয়ে যাবে।”

চাঁদের সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে বারান্দার ইজি চেয়ারটায় ঘুমিয়ে পরলাম কে জানে। সকালে ঘুম ভেঙে দেখি অর্নব পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর তার হাতের ঘড়িতে এলার্ম বাজছে। দ্রুত উঠে হাত মুখ ধুয়ে নাশতা করে রওনা হলাম স্কুলের দিকে। এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো আমাদের একেকটি দিন, একেকটি বছর। চারপাশের মানুষের হাসাহাসি, মুখ ঝামটা সব দূরে সরিয়ে রেখে আমরা তৈরি করেছিলাম নতুন একটা পৃথিবী। এখানে বাহিরের পরশ্রীকাতর সমাজের তৈরি করে দেওয়া কোন নিয়ম খাটতো না, কারো চোখের ইশারায় পুতুল হতে হতো না। নিজেদের পৃথিবীতে আমরা ছিলাম বেশ, ঠিক যেন নতুন জোড়া নেওয়া কপোত কপোতী!

দেখতে দেখতে পাঁচটি বছর চলে গেলো। আমার মনে এবার নিত্য নতুন সংশয় দানা বাঁধতে শুরু করলো। আর মাত্র কটা দিন, এরপর…

চলবে…

৮৯৫জন ৭৫১জন
0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ