আর কদিনইবা অর্নব থাকবে আমার সাথে?এসব ভাবলেই মন কেমন করতো। এদিকে অর্নবের একটি একটি করে দিন শেষ হয়ে আসছে। আজকাল ওর হাত, পা ঠিকমত কাজ করে না। চোখে ভালোমত দেখতে পায় না। ওর আমাকে দেবার মত পাঁচটা বছরই ছিলো। জানি না কেন, কিভাবে পাঁচ বছর পরেও ও আমাকে দিয়ে যাচ্ছে একেকটি দিন। খুব বেশি ভালেবেসেছি বলে কিংবা যত্নে রেখেছি বলেই হয়ত সে এখনো আছে আমার পাশে।এই পাঁচ বছরে ও আমাকে কি দিয়েছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। তবে আমাকে আগেই জানানো হয়েছিলো যেন আমি ওর ওপর নির্ভরশীল না হই। হ্যাঁ, ওকে ছাড়াও হয়ত আমি বাঁচতে পারব, কিন্তু সেটাকে আর জীবন বলে মনে হবে না। অর্নব আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, এটাই বাস্তবতা, তবু তা মানতে চায়না মন। আমাদের মন সবসময় রূঢ় সত্যটাকে স্বপ্ন বলে এড়িয়ে যেতে চায়,কিংবা একটা এক্সিডেন্ট বলে কল্পনা করে ভুলে যেতে চায়। আমিও তাই চাইতাম। কিন্তু যা ঘটার তা তো ঘটবেই।
প্রোডাকশন হাউজ থেকে সংকেত পেলাম অর্নবের আয়ু আর মাত্র ৭ দিন। এই একেকটা দিন আমি কি করে কাটিয়েছি তা আর কেউ জানে না। আমি স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছি সারাদিন ওর সাথেই কাটাবো বলে। বিদ্যুৎ চলে গেলে বিকল্প ব্যবস্হা করে রেখেছি। হাত পা মুছে দিচ্ছি, রেস্টে রাখছি,কথা বলাইনি। যা যা করা সম্ভব সবই করেছি। শেষ দিন ও শুধু তাকিয়ে থাকতে পারতো। গোল গোল মার্বেলের মতন চোখ দিয়ে কেমন করে যে আমার পানে তাকাতো!মনে হতো একটা মায়াবী আকাশ পুরোটাই ওর চোখের ভেতর। ওর ভেতর কি তবে মনের অস্তিত্ব ছিলো? সেও কি তবে ভালোবেসেছিলো?
চারপাশের জটিলতায়, বিশ্রী পরিবেশে, মানুষের তিক্ত আচরনে যখন দিশেহারা হয়ে পরেছিলাম, বাঁচার জন্য কোন কারন খুঁজে পাচ্ছিলাম না,তখন সাইকেয়ার্টিস্টের পরামর্শ নেই। তিনি আমার সব হিস্ট্রি শুনে বললেন, কাওকে বিয়ে করে নিতে। বিয়ে করে একটা পরিবারের মধ্যে জীবন শুরু করলে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা জন্মাবে। কিন্তু কে করবে বিয়ে? আমার যে কোন পরিচয় নেই, ধর্ম নেই, জাত নেই! আমি একা… এতবড় পৃথিবীতে আমি একদম একা। তখন পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারলাম অর্নবের কথা। বিজ্ঞানীরা গবেষণার উন্নয়ন ঘটিয়ে এক নতুন ধরনের রোবট মানুষ আবিষ্কার করেছেন। নিঃসঙ্গ জীবনে ওরা দেবে সঙ্গীর সাময়িক স্বাদ। নারী/পুরুষ উভয় ধরনের রোবট রয়েছে। ওরা কথা বলতে পারবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে। আপনি পিসিতে যেভাবে কমান্ড সেট করে রেখে যাবেন, তারা সেভাবেই কাজ করে যাবে ক্লান্তিহীনভাবে। তবে চার্জ ফুরিয়ে গেলে চলবে না! তাই সারা রাত চার্জ করে সারাদিন চালিয়ে রেখে চলে যেতাম। ওকে দেখতে হুবহু মানুষের মতই। হাঁটা চলা যদিও একটু অস্বাভাবিক, তথাপি, কেউ ভালো করে না দেখলে ধরতে পারবে না যে ও রোবট। মূলত ওকে আমার খুব একটা অস্বাভাবিক লাগতই না, বরং স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে আরো বেশি স্বাভাবিক লাগত। কখনো কখনো অামি ভুলেই যেতাম, অর্নব সত্যি মানুষ নয়। তবে কিছু কিছু কাজ মনে করিয়ে দিত, অর্নব মানুষের চেয়েও অসাধারন কিছু। স্কুল করে ফিরে যখন অর্নবের হাতের এক কাপ চা পেতাম, তখন মনে হতো,এই ঢের ভালো। পুরুষত্বের অহং নেই, চেঁচামেচি নেই, ঝামেলা, অশান্তি নেই। আছে কেবল ভালোবাসা। তবে নূন ছাড়া যেমন তরকারীর স্বাদ নেই, তেমনি ঝগড়া ছাড়া ভালোবাসাও পানসে। নাহয় হলোই একটু পানসে, তাতে কি? সব ভালোরই ২/১ টা খারাপ দিক থাকবেই।
যেখান থেকে অর্নবকে কিনে এনেছিলাম, সেখানকার এক্সপার্টরা বলে দিয়েছিল যে, ওর সঙ্গ পাবো মোটে পাঁচ বছর। এরপরই সে অকেজো হতে থাকবে। ধীরে ধীরে বিকল হয়ে পরবে। তখন কথাটা অত গায়ে মাখিনি, ভেবেছি, “একটা রোবটই তো!” কিন্তু এই প্রানহীন ভাস্কর্যটি যে এভাবে আমার মাঝে প্রানের সঞ্চার করবে তা ভাবতেই পারিনি।
অর্নব ফুরিয়ে গেছে আজ সাড়ে তিন বছর হলো। আর কোন রোবট কিনে আনিনি। কেন যেন মনে হচ্ছে, একটা নতুন কিছু কিনে এনে যে সুখটা পাবো, তারচেয়ে ঢের বেশি কষ্ট পাবো তার ক্রান্তিলগ্নে। তাই, এই ভালো, নিজের ভেতর একাকীত্বটাকে গিলে খেয়ে বেশ আছি, বেশ অাছি এই আমি।
আজ পূর্নিমা…আবার উঠেছে চাঁদ। কিন্তু এবার আর চাঁদ হাসছে না। কেমন মুখ গোমড়া করে অালো ছড়িয়ে যাচ্ছে। যেন, ধার করা আলো ছড়াতে হবে বলে ছড়াচ্ছে, মনের আনন্দে নয়।
৩২টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
বাহ্ অন্য রকম দ্যোতনা তৈরি করে শেষে নিয় এসেছেন,
এমন ভাবতে পারিনি, রেসের ঘোড়ার মত লেখা ছুটিয়ে নিয়েছেন।
লিখুন লিখুন।
নীরা সাদীয়া
আজকাল সবকিছু যা জটিল হয়ে উঠেছে, তাতে করে একটু অন্যভাবে ভাবতেই হয়। ধন্যবাদ হেলাল ভাই আপনাকে। অনেক শুভকামনা রইলো।
শবনম মোস্তারী
আগের পর্বটিও অনেক সুন্দর লিখেছেন আপু। পড়লাম। ভালো লেগেছে।
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ। আপনাদের ভালো লাগলেই আমার স্বার্থকতা। অনেক শুভ কামনা রইলো।
শবনম মোস্তারী
ধন্যবাদ 🌹🌹
সাবিনা ইয়াসমিন
নতুন কিছু আনা যায় সহজেই, কিন্তু ফুরাবে যখন তখন কষ্ট গুলোও নতুন করে পেতে হয়। ভালোবাসা হয়তো এমনই, যাতনা আর ভাবনার সংমিশ্রণে তৈরি এক দুর্দান্ত ফরমুলা। যে নেয় ছাড়তে পারেনা।
বাকি পর্বগুলো পড়বো। শুভ কামনা রইলো ❤❤
নীরা সাদীয়া
ঠিক বলেছেন। ফুরিয়ে গেলেই আবার কষ্ট পেতে হয় নতুন করে।
আমার গল্পের এটাই শেষ পর্ব। এটাও ফুরিয়ে গেলো আপি।
বন্যা লিপি
অন্যরকম ভালোলাগলো। আরো নতুনত্বের স্বাদ চাই।শুভ কামনা রইলো।
নীরা সাদীয়া
নিশ্চই পাবেন। আবার হয়ত আরো নতুন কিছু নিয়ে হাজির হব। শুভ কামনা জানবেন।
তৌহিদ
শেষতক রোবট! আপনি স্বার্থক লিখিয়ে। প্রথম পর্ব পড়ে বুঝতেই পারিনি!!
এরকম গল্প আরো চাই।
নীরা সাদীয়া
আমিও আগে বুঝিনি, এরকম কিছু লিখতে হবে আমাকে। আমার কেন জানি মনে হয় এমন একটা দিন খুব সন্নিকটে,যেদিন মানুষ রোবটকেই সঙ্গী হিসেবে বেছে নেবে।
শুভ সকাল।
তৌহিদ
শুভ সকাল।
জিসান শা ইকরাম
দারুন সমাপ্তি, এমনটা ভাবতে পারিনি।
লেখা লেখি চালিয়ে যাও।
নীরা সাদীয়া
মানুষের আচরন আমাকে ভাবিয়েছে, কিংবা ভাবতে বাধ্য করেছে। একদিন অনেকেই হয়ত আমার মত করে ভাববে, সেদিন বেশি দূরে নয়।
অনেক ধন্যবাদ দাদা। সুপ্রভাত।
শুন্য শুন্যালয়
নীরা কিভাবে যে মিশে গিয়েছিলাম লেখাটার ভেতর! এক একবার মনে হয়েছিল মেয়েটি আমি। যেই যন্ত্রণা ফুঁটিয়েছ, তার রেশ কাটতে সময় লাগবে আমার। পর্বদুটো প্রিয়তে রাখছি।
তুমি অনেক বড় মানের লেখক। না যশে পিছিয়ে থাকবে যদিও, কারণ তুমি মেয়ে, বাংলাদেশের মেয়ে।
শুভকামনা, লিখবে ক্রমাগত।
নীরা সাদীয়া
আমার কাছে মনে হয়েছে, প্রায় প্রতিটি মেয়েই এমন যন্ত্রনা ভোগ করে, সেটা পিতৃ পরিচয় থাকুক বা না থাকুক।
আপনাদের পছন্দ হলেই আমার স্বার্থকতা। খুব বেশি কিছু চাইনা আমার। আপনাদের মত কজন মনযোগী পাঠক পেলেই মহাখুশি।
অনেক ধন্যবাদ জানালাম। ভোরের স্নিগ্ধ আলোর শুভেচ্ছা রইলো।
মোঃ মজিবর রহমান
মনে হতো একটা মায়াবী আকাশ পুরোটাই ওর চোখের ভেতর।
তবে নূন ছাড়া যেমন তরকারীর স্বাদ নেই, তেমনি ঝগড়া ছাড়া ভালোবাসাও পানসে। —- তাই বুঝি
জিবনে সব কিছুরই প্রয়োজন আছে৪ হইতো।!!!
ভাল লাগ্ল আপু।
নীরা সাদীয়া
সত্যিই তাই, জীবনে সবকিছুই প্রয়োজন আছে। আবার তেমনি, এক জীবনে সব পাওয়াও যায় না।
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। শুভ সকাল।
মোঃ মজিবর রহমান
থীক তাই। চাওয়ার শেষ নেই, পাওয়ার ও শেষ নেই।
ব্লগার সজীব
দুই পর্বই পড়লাম আপু। মানুষের আচরন নিয়ে লিখেছেন যা মানুষকে ভাবায়। ভাল লেগেছে খুব।
নীরা সাদীয়া
মানুষের এসব আচরন নিয়ে আমিও ভাবি প্রায়ই।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
মাহমুদ আল মেহেদী
সত্যিই ভাবতে দেননি সমাপ্তির ঘটনা। অসাধারন লেখনি।
নীরা সাদীয়া
আমি চেয়েছিলাম পাঠককে একটা চমক দিতে।
অনেক ধন্যবাদ ভাই। শুভ কামনা জানবেন।
রিতু জাহান
আমি একদম অবাক হয়ে গেছি। এমন একটা সারপ্রাইজ দিবে গল্পে ভাবতেই পারিনি।
বেশ লাগলো পড়ে। তবু কি জীবন এভাবে পরিপূর্ণ হতো!!
নীরা সাদীয়া
জানি জীবন পূর্ণ হতো না। কিন্তু চলে তো যেত। কিছুটা মনের খোড়াক জোগান দিত। এই আর কি।
সারপ্রাইজদদিতে পেরে আমি আনন্দিত।
শুভ কামনা জানবেন।
রিতু জাহান
এমন গল্প আরো চাই। লিখে ফেলো।
নীরা সাদীয়া
অবশ্যই। মনের আকাশে আবার যখন ভাবনার উদয় হবে, তখন তা নিয়ে আপনাদের সামনে আবার হাজির হবো।
রিতু জাহান
আমরা অপেক্ষায় থাকব।
প্রহেলিকা
প্রথম পর্ব পড়িনি, দ্বিতীয় পর্বই শুরু করেছিলাম কিন্তু গল্প নিজেই যেন প্রথম পর্বে ফিরে যেতে বাধ্য করলো। পড়লাম দুটোই। অসাধারণ গল্প, গল্পের প্লট দারুণ!
নিয়মিত চর্চা করুন, চর্চা যেন না থামে। আপনার লেখার হাত ভালো। একদিন অনেক বড় লেখক হবেন।
শুভকামনা।
নীরা সাদীয়া
দুটো পর্বই পড়েছেন জেনে কৃতজ্ঞ হলাম। আপনাদের ভালো লাগাই আমার স্বার্থকতা।
শুভ কামনা জানবেন।
মনির হোসেন মমি
এ পর্বটা পড়া হয়নি পড়ে নিলাম।গত পর্বের আমার প্রশ্নের উত্তর খুব আশ্চর্য ভাবেই পেলাম।সত্যিই আপনি খুব ভাল লিখেন।আপনার লেখায় চমক যাদু দুটোই আছে।শুভ কামনা নিরন্তর।
নীরা সাদীয়া
তাই বলেছিলাম, পরের পর্বে উত্তর পেয়ে যাবেন। আপনার অনুভূতি জানিয়েছেন, তাতে খুশি হয়েছি।
শুভ কামনা জানবেন।