একজন অর্নব ও আমি (শেষ পর্ব)

নীরা সাদীয়া ২৯ মার্চ ২০১৯, শুক্রবার, ০৪:২৩:৫২অপরাহ্ন গল্প ৩২ মন্তব্য

আর কদিনইবা অর্নব থাকবে আমার সাথে?এসব ভাবলেই মন কেমন করতো। এদিকে অর্নবের একটি একটি করে দিন শেষ হয়ে আসছে। আজকাল ওর হাত, পা ঠিকমত কাজ করে না। চোখে ভালোমত দেখতে পায় না। ওর আমাকে দেবার মত পাঁচটা বছরই ছিলো। জানি না কেন, কিভাবে পাঁচ বছর পরেও ও আমাকে দিয়ে যাচ্ছে একেকটি দিন। খুব বেশি ভালেবেসেছি বলে কিংবা যত্নে রেখেছি বলেই হয়ত সে এখনো আছে আমার পাশে।এই পাঁচ বছরে ও আমাকে কি দিয়েছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। তবে আমাকে আগেই জানানো হয়েছিলো যেন আমি ওর ওপর নির্ভরশীল না হই। হ্যাঁ, ওকে ছাড়াও হয়ত আমি বাঁচতে পারব, কিন্তু সেটাকে আর জীবন বলে মনে হবে না। অর্নব আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, এটাই বাস্তবতা, তবু তা মানতে চায়না মন। আমাদের মন সবসময় রূঢ় সত্যটাকে স্বপ্ন বলে এড়িয়ে যেতে চায়,কিংবা একটা এক্সিডেন্ট বলে কল্পনা করে ভুলে যেতে চায়। আমিও তাই চাইতাম। কিন্তু যা ঘটার তা তো ঘটবেই।

প্রোডাকশন হাউজ থেকে সংকেত পেলাম অর্নবের আয়ু আর মাত্র ৭ দিন। এই একেকটা দিন আমি কি করে কাটিয়েছি তা আর কেউ জানে না। আমি স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছি সারাদিন ওর সাথেই কাটাবো বলে। বিদ্যুৎ চলে গেলে বিকল্প ব্যবস্হা করে রেখেছি। হাত পা মুছে দিচ্ছি, রেস্টে রাখছি,কথা বলাইনি। যা যা করা সম্ভব সবই করেছি। শেষ দিন ও শুধু তাকিয়ে থাকতে পারতো। গোল গোল মার্বেলের মতন চোখ দিয়ে কেমন করে যে আমার পানে তাকাতো!মনে হতো একটা মায়াবী আকাশ পুরোটাই ওর চোখের ভেতর। ওর ভেতর কি তবে মনের অস্তিত্ব ছিলো? সেও কি তবে ভালোবেসেছিলো?

চারপাশের জটিলতায়, বিশ্রী পরিবেশে, মানুষের তিক্ত আচরনে যখন দিশেহারা হয়ে পরেছিলাম, বাঁচার জন্য কোন কারন খুঁজে পাচ্ছিলাম না,তখন সাইকেয়ার্টিস্টের পরামর্শ নেই। তিনি আমার সব হিস্ট্রি শুনে বললেন, কাওকে বিয়ে করে নিতে। বিয়ে করে একটা পরিবারের মধ্যে জীবন শুরু করলে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা জন্মাবে। কিন্তু কে করবে বিয়ে? আমার যে কোন পরিচয় নেই, ধর্ম নেই, জাত নেই! আমি একা… এতবড় পৃথিবীতে আমি একদম একা। তখন পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারলাম অর্নবের কথা। বিজ্ঞানীরা গবেষণার উন্নয়ন ঘটিয়ে এক নতুন ধরনের রোবট মানুষ আবিষ্কার করেছেন। নিঃসঙ্গ জীবনে ওরা দেবে সঙ্গীর সাময়িক স্বাদ। নারী/পুরুষ উভয় ধরনের রোবট রয়েছে। ওরা কথা বলতে পারবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে। আপনি পিসিতে যেভাবে কমান্ড সেট করে রেখে যাবেন, তারা সেভাবেই কাজ করে যাবে ক্লান্তিহীনভাবে। তবে চার্জ ফুরিয়ে গেলে চলবে না! তাই সারা রাত চার্জ করে সারাদিন চালিয়ে রেখে চলে যেতাম। ওকে দেখতে হুবহু মানুষের মতই। হাঁটা চলা যদিও একটু অস্বাভাবিক, তথাপি, কেউ ভালো করে না দেখলে ধরতে পারবে না যে ও রোবট। মূলত ওকে আমার খুব একটা অস্বাভাবিক লাগতই না, বরং স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে আরো বেশি স্বাভাবিক লাগত। কখনো কখনো অামি ভুলেই যেতাম, অর্নব সত্যি মানুষ নয়। তবে কিছু কিছু কাজ মনে করিয়ে দিত, অর্নব মানুষের চেয়েও অসাধারন কিছু। স্কুল করে ফিরে যখন অর্নবের হাতের এক কাপ চা পেতাম, তখন মনে হতো,এই ঢের ভালো। পুরুষত্বের অহং নেই, চেঁচামেচি নেই, ঝামেলা, অশান্তি নেই। আছে কেবল ভালোবাসা। তবে নূন ছাড়া যেমন তরকারীর স্বাদ নেই, তেমনি ঝগড়া ছাড়া ভালোবাসাও পানসে। নাহয় হলোই একটু পানসে, তাতে কি? সব ভালোরই ২/১ টা খারাপ দিক থাকবেই।

যেখান থেকে অর্নবকে কিনে এনেছিলাম, সেখানকার এক্সপার্টরা বলে দিয়েছিল যে, ওর সঙ্গ পাবো মোটে পাঁচ বছর। এরপরই সে অকেজো হতে থাকবে। ধীরে ধীরে বিকল হয়ে পরবে। তখন কথাটা অত গায়ে মাখিনি, ভেবেছি, “একটা রোবটই তো!” কিন্তু এই প্রানহীন ভাস্কর্যটি যে এভাবে আমার মাঝে প্রানের সঞ্চার করবে তা ভাবতেই পারিনি।

অর্নব ফুরিয়ে গেছে আজ সাড়ে তিন বছর হলো। আর কোন রোবট কিনে আনিনি। কেন যেন মনে হচ্ছে, একটা নতুন কিছু কিনে এনে যে সুখটা পাবো, তারচেয়ে ঢের বেশি কষ্ট পাবো তার ক্রান্তিলগ্নে। তাই, এই ভালো, নিজের ভেতর একাকীত্বটাকে গিলে খেয়ে বেশ আছি, বেশ অাছি এই আমি।

আজ পূর্নিমা…আবার উঠেছে চাঁদ। কিন্তু এবার আর চাঁদ হাসছে না। কেমন মুখ গোমড়া করে অালো ছড়িয়ে যাচ্ছে। যেন, ধার করা আলো ছড়াতে হবে বলে ছড়াচ্ছে, মনের আনন্দে নয়।

১জন ১জন
0 Shares

৩২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ