মমব্রুর মা চিনিপ্রুর রান্না অসাধারন। রাতে খেতে বসে ভাঙা ভাঙা বাংলায় সে বললো – ভালোবেসে মমব্রুর বাবাকে বিয়ে করেছিলো। মমব্রু তার গর্ভে থাকা অবস্থায় সে মারা যায় ইশ্বরের পাহাড়ে। তাকিয়াপালা পাহাড়ে কেন গিয়েছিল মমব্রুর বাবা তা আজও কেউ জানেনা। মমব্রু তার শার্টের পকেটে সবসময় বাবার একটা সাদাকালো ছবি রাখে। মমব্রুর বাবা নাকি দেখতে অনেকটা আমার মত! এই জন্যই তাকে টাকা নিতে মমব্রু নিষেধ করেছিলো সন্ধ্যায়। ইশারা করে দেয়ালের দিকে আমাকে দেখালো চিনিপ্রু। আমি হাতবাতিটা সেটার কাছে নিয়ে গিয়ে দেখলাম সেখানে সাদাকালো প্রায় অস্পষ্ট একটা মধ্যবয়সী ছেলের ছবি টাঙানো। ছবিটা কি সত্যিই আমার মত? নাহ! তবে কপাল থেকে উপরের দিকে কিছু মিল আছে।
খাওয়ানো শেষে যাবার সময় আমাদের বললো ইশ্বরের পাহাড়ে যেন আমরা মমব্রুকে নিয়ে না যাই। ছেলে তার একমাত্র বুকের ধন। তার ভয় হয় যদি মমব্রুকেও তাকিয়াপালা নিজের বুকে টেনে নেয়! মামা তাকে অভয় দিলেন। তাকে সাথে নেবেননা সে কথাও বুঝিয়ে বললেন। মমব্রুর কথা জিজ্ঞেস করলাম, চিনিপ্রু বললো সে ঘুমিয়ে গিয়েছে।
চিনিপ্রু চলে যাবার পর মাঝেতে পাতানো বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাদের কথা ভাবছিলাম। কত সহজ সরল তারা। এই যে চিনিপ্রু কত সুন্দর প্রাণখোলা। নিজের মৃত স্বামীর কথা, তাদের ভালোবাসার কথা কত সহজেই আমাদের মত অপরিচিতের সামনে অনায়াসেই বলে দিল। কত আপ্যায়ন, আদর যত্ন! আর আমাদের গাইড ছোট্ট মমব্রু আমাকে তার বাবার আসনে বসিয়েছে কেন? পাহাড়ের মানুষ বোধহয় এমনই; কষ্টসহিষ্ণু কিন্তু প্রাণখোলা।
রাতে ভালো ঘুম হয়নি। হয়তো পাহাড়ের অতিরিক্ত নিস্তব্ধতাই এর জন্য দায়ী। সারারাত কানে বেজেছে ইতাই ঝরনার বয়ে চলা পানির শব্দ। তাকিয়াপালা পাহাড়ের সূর্যোদয় দেখতে হলে অনেক ভোরে অন্ধকার থাকতেই বেরোতে হবে। লিপনভাই ডেকে দিলেন আমাকে আর মামাকে। ফ্রেশ হয়ে বেরোবো দেখি চিনিপ্রু দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, হাতে খাবারের প্লেট। আমি অবাক হলাম! এত ভোরে সে জেগে আমাদের জন্য নাস্তা বানিয়েছে! এর জন্য কৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম তার কাছে। আমরা সাবধানে থাকবো এবং তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে এ কথা বলে বিদায় নিলাম। কারন আজই আমাদের ফিরে যেতে হবে।
উঁচুনিচু পথে প্রায় ঘন্টাখানেক হাঁটার পর তাকিয়াপালা পাহাড়ের আস্ত অবয়ব দেখতে পেলাম। পাহাড়ের বুকে উঁচু উঁচু পাথরগুলো আবছা দেখা যাচ্ছে। তখনো সূর্য উঠি উঠি করছে। হঠাৎ সরু পথের পাশের ঝোপ থেকে হুট করেই মমব্রু উদয় হলো। আশ্চর্য! সে কি পিছু পিছু এসেছে?
মমব্রু তুমি? কোথা থেকে এলে? যা বললো তাতে বুঝলাম সে আমাদের সাথেই এসেছে।ইশারায় জংগল দেখিয়ে বুঝালো লুকিয়ে এসেছে। তার ভয় হয় যদি তার বাবার মতো ইশ্বরের পাহাড় আমাদেরকেও বুকে টেনে নিয়ে নেয়! কিন্তু চিনিপ্রু যে নিষেধ করেছে! কি করি এখন? তাকে কিছুতেই ফেরত পাঠানো যাচ্ছেনা। বার বার আমাকে ইশারা করে বলছে- আত্তি আত্তি! আমি ভাবলাম পাহাড়ে তার বাবার কবরের কথাই বলছে। মামার সাথে পরামর্শ করে ঠিক করলাম সে পাহাড়ের নীচে অপেক্ষা করবে আমরা না ফেরা পর্যন্ত।
আমরা পিচ্ছিল পাহাড়ের পাথরের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উপরে উঠেছি, অপেক্ষা করছি সূর্য উঠার। অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! ইশ্বরের পাহাড় থেকে সূর্যোদয় যে এত সুন্দর নিজের চোখে না দেখলে মনে হয় জীবনটা অপূর্ণই থেকে যেত। মেঘ ফুঁড়ে রক্তিম সূর্যটা যখন ভেসে উঠলো চারপাশের পুরো প্রকৃতি যেন আগুন রুপে ধরা দিলো। পাহাড়ের নীচে তুলোর মত ভেসে বেড়ানো মেঘে যখন সূর্যের লালছটা পরলো মনে হলো কেউ আগুল লাগিয়ে দিয়েছে মেঘমালায়। আর সে লেলিহান শিখায় আমরা সাঁতার কাটছি। মামার চোখের পলক পড়ছেনা। একটু পর পর বলছে কি সুন্দর! কি সুন্দর! যে লিপন ভাই সারাক্ষণ বকবক করে সে নিজেও নিথর নিশ্চুপ হয়ে গেছে প্রকৃতির এমন সাজে। আমাকে বললো এটাই মনে হয় পৃথিবীর স্বর্গ, অষ্টম আশ্চর্য! আমি মনে মনে ইশ্বরকে ধন্যবাদ দিলাম। ধন্য তুমি তাই ধন্য করেছ আমায়!
নীচে মমব্রু অপেক্ষা করছে। সংবিৎ ফিরে আসতেই মামা বললো চল্ নীচে নেমে যাই। আমি বললাম হুম প্রকৃতির সৌন্দর্য বেশিক্ষণ দেখতে নেই, অল্পেই তুষ্ট থাকলে তা দীর্ঘায়ু হয়।
লিপন ভাই বললো দেখো দেখো পাহাড়ের কিনারের উঁচু পাথরগুলো কেমন আগুনরঙা হয়ে উঠেছে। মামা বললেন হাত দিওনা আলগা থাকতে পারে। বিপজ্জনকভাবে নীচে গড়িয়ে পড়তে পারে। তাহলে আমরাও বিপদে পড়বো। এ কথা শোনার আগেই লিপন ভাই হাত দিয়েছে একটা খাড়া পাথরের গায়ে। মাটি পিচ্ছল থাকায় তার পা একটু হড়কে গেলো আর হাতটা জোরে ধাক্কা মারলো পাথরটাতে। এতেই যা হবার তা হলো। পাথরটা নিশ্চয় আলগা ছিলো, সেটা গড়িয়ে পরতে লাগলো নীচে। আমি চট করে লিপন ভাইয়ের হাত ধরে ফেললাম, আমার হৃদস্পন্দন যেন এক সেকেন্ডের জন্য থেমে গেলো। তাকে নিজের দিকে সজোরে টেনে নিলাম। (পরের পর্বে সমাপ্য)
ছবিঃ সংগৃহীত
২১টি মন্তব্য
সাবিনা ইয়াসমিন
আবার পরের পর্বের জন্যে অপেক্ষা !!
আমিও পরের পর্বেই মন্তব্য করবো ,,😎😎
তৌহিদ
আপু ফরমেটটা এভাবেই সাজিয়েছিলামতো তাই একটু কষ্ট পাচ্ছেন। তবে এতে কিন্তু লেখাটি পড়ার আকুলতাও বেড়ে যায়। লেখকের এটা বড় পাওয়া।
ইঞ্জা
woooo এমন কিছু হতে পারে তাই ভাবছিলাম পড়ার সময়, কারণ পাহাড়কে আমি যেমন ভালোবাসি তেমনই শ্রদ্ধা করি, এর ভয়ানক রূপ আমার চেনা আছে।
তৌহিদ
ধন্যবাদ দাদা, অবশ্যই আপনি পাহাড়ের মানুষকে কাছাকাছি দেখেছেন। আপনার অভিজ্ঞতা অনেক।
ইঞ্জা
অনেক কিনা জানিনা, কিন্তু কিছুটা হলেও জানি, বুঝি।
নীলাঞ্জনা নীলা
এখন বুঝলাম কেন এই পাহাড়কে ঈশ্বরের পাহাড় বলা হয়ে থাকে। আপনার বর্ণনায় আরোও বর্ণিল হয়ে উঠলো ঈশ্বরের পাহাড়।
শেষ পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
তৌহিদ
পাহাড় আমাকে সবসময় টানে আপু। আমি নিশ্চুপ হয়ে যাই পাহাড়ের কাছে গেলে। তৃতীয় পর্ব দিলাম।
নীলাঞ্জনা নীলা
সমুদ্র নাকি পাহাড়? আমায় পাহাড় টানে।
তৌহিদ
আমাকেও পাহাড় টানে বেশী। পানি ভয় পাই আমি।
তৌহিদ
-{@ -{@
ছাইরাছ হেলাল
পড়েছি, পড়ব,
অপেক্ষা করছি।
তৌহিদ
ধন্যবাদ ভাইয়া, তৃতীয় পর্ব দিলাম।
রেজওয়ান
😎”প্রকৃতির সৌন্দর্য বেশিক্ষণ দেখতে নেই, অল্পেই তুষ্ট থাকলে তা দীর্ঘায়ু হয়”😍এটা আসলেই বাস্তব সত্যি! 👌সুন্দর ও গুছানো, খুব ভাল লাগছে ভাই, চালিয়ে যান ভাই✌
তৌহিদ
লেখাটি পড়ছেন জেনে কৃতার্থ হলাম ভাইয়া।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
শেষ দৃশ্যের সমাপ্তিটায় ভয় পেয়ে গেছিলাম। পরের পর্বের অপেক্ষায় -{@
তৌহিদ
পরের পর্ব দিলাম ভাইয়া।
জিসান শা ইকরাম
পাহাড়ের মানুষগুলো সত্যিই সহজ সরল হয়। বাংলাদেশেই পাহাড়ের উপরে উঠে এত সুন্দর সুর্যোদয় দেখা যায় তা ধারনাই ছিল না। দেখার ইচ্ছে জাগলো। পরের পর্বে যাই।
তৌহিদ
পাহাড়িদের জীবনযাত্রা অত্যন্ত কষ্টদায়ক। আমার মনে হয় এ কারনেই তাদের মনে কুটিলতাগুলি খুব কম প্রকাশ পায়।
কামাল উদ্দিন
এমন পাহাড়ের ছবি দেখলে মনটা শিউরে উঠে আমার। চিনিপ্রুর মিষ্টি রান্না খেয়েও পাহাড়ের নিস্তব্ধতায় ভালো ঘুম না হওয়াটা সঠিক হল না। আচ্ছা ওখানে কি শীতে গিয়েছিলেন না বর্ষায় তৌহিদ ভাই?
তৌহিদ
পাহাড় আমার ভালো লাগে ভাই। তবে সেখানে আমি যায়ইনি কারন লেখাটিতো কাল্পনিক!!
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভাই।
কামাল উদ্দিন
এক সময় এডভেঞ্চারের খোঁজে পাহাড় চষে বেড়াতাম, এমন সময় পাইনা, তবে নেশাটা এখনো ভালোই আছে,,,,,,,,,,,,,,,শুভ কামনা সব সময়।