নিজের কিছু কথা শেয়ার করি আপনাদের সাথে। আমি সোনেলায় Irregularly Irregular. আমি খুব একটা সময় পাই না সোনেলার ব্লগারদের ইন্টারেস্টিং ব্লগগুলো পড়তে। তবে সময় পেলে হাতছাড়া করি না। এখানে বেশ কয়েকজন নতুন ব্লগার যুক্ত হয়েছেন, চমৎকার সব লেখা পাচ্ছি। সবার জন্য শুভকামনা।

তো আমার বিষয়ে বলার তেমন কিছু নেই তবে অনেক কিছুই আছে। আমার জন্মের আগে আমার মা আরোও ৩ জনকে জন্ম দিয়েছেন। তারা সবাই মেয়ে। যথারীতি ৩ জন মেয়ের পরে আমি, আমার উপর পরিবারের আশা অনেক ছিল, আছে, থাকবে। আমার জন্মের কিছুক্ষণ পরেই বাবা কোলে নিয়ে বলেছিলেন, “আমার ছেলে ডাক্তার হবে।” আসলে এটা মায়ের ইচ্ছা, পরে ভাইরাসের মতো বাবা এবং পরিবারের সবার কাছেই ছড়িয়ে গেল। তবে আমার ইঞ্জিনিয়ার হবার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু হৈমন্তীর অপুর মতো নিজের ইচ্ছে পরিবারের কাছে তুলে ধরতে পারি নি। যেদিন ধরেছিলাম সেদিনই খবর হয়ে গিয়েছিল। আমি নাকি পরিবারের জন্য লাকি ছিলাম। আমার জন্মের ঠিক পরেই বাবা প্রোমোশন পায়। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। কাজে এতই ব্যাস্ত থাকতেন যে তাকে আমরা ভালোভাবে পাইনি।

আমাদের বাসার সামনে বিশাল বড় জায়গা ছিল সেখানে আমি বল নিয়ে খেলতাম। একা একাই খেলতে হতো। কেননা বাইরের ছেলেদের সাথে খেলে যদি ছেলেটা বখে যায় সেই ভয় মায়ের ঘুম হারাম করতো। রাবারের একটা বল, ফুটবলের চাইতে ছোট। মাটি থেকে অনেক উপরে উঠতো। একবার সেটা দেয়াল ডিঙ্গিয়ে পাশের মাঠে চলে যায়। দারওয়ান চাচাকে অনেক বলে কয়ে রাজি করালাম। অতঃপর মা ছাড়া আমার প্রথম বাইরে যাওয়া। সম্ভবত দারওয়ান চাচাই আমার প্রথম আর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। কেননা সে আমার কষ্ট বুঝতে পারতো। আর মাঝেমধ্যেই আমাকে বাইরে যেতে দিত। সেদিন থেকেই শিখেছিলাম মা এর চোখ কিভাবে ফাকি দেয়া যায়। তারপর থেকে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে বাইরেই খেলতাম। স্কুল বলতে গেলে পাশের একটা কিন্ডারগার্ডেনে ভর্তি হই ক্লাস টু তে। বয়স কম ছিল। আমার সমান বাচ্চারা নার্সারী তে পড়তো। শুরুর দিকে পড়াশোনা কিচ্ছু বুঝতাম না। ম্যাডামকে দেখলে অনেক ভয় লাগতো। চুপচাপ পিছনে গিয়ে বসে থাকতাম। আর টিচাররা আমাকেই খারাপ ছাত্র হিসেবে ধরতো, পড়া পারতাম না, মারও খেতাম। আট নং কত?? আমি ম্যামের মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতাম। হাত পাতো। তারপর ডাস্টার দিয়ে হাতে মারতো। বারি খেতে খেতে এমন অবস্থা হতো যে একসময় বারি দিলে কোন ব্যাথাই লাগতো না। আর এটা বুঝি ছিল কাঁটা গায়ে নূনের ছিটা দেয়া। ম্যাম আমাকে কয়েকটা মার বেশি দিত। আর পুরো ক্লাস ভয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতো। আমীর খানের একটা মুভি ছিল, Tare Zameen Par। এই মুভিটার পিচ্চির মতোই ছিলাম অনেকটা, তবে অতো ছিলাম না। আমি মোটামুটি কিছু পারতাম। দিনে স্কুলে বকা রাতে বাবার কাছে বকা। আমার বকাময় জীবনে আমীর খানের মতো কেও আসেনি যে আমাকে সবকিছু হাতে কলমে বুঝাবে। প্রয়োজনে এবং একপ্রকার জিদে নিজেই অনেক কষ্টে নিজেকে ঠিক করেছি। ক্লাস থ্রি তে উঠবো, বার্ষিক পরীক্ষা দিলাম। রেসাল্ট দিল। লাস্ট বয় থেকে ফার্স্ট বয় হয়ে গেলাম। আমাকে যারা ঘৃণা করতো, পাশে বসতে দিত না তারাই পরে আমারে আপন করে নিয়েছে। ফোরে উঠে আইডিয়ালে ভর্তির প্রিপারেশন নিলাম। ডিসেম্বর মাস আসলেই বাচ্চার বাবা মা রা একপ্রকার রেসে নামে। কার বাচ্চা স্কুলে চান্স পাবে!!! অঘোষিত সে রেসে দেখছি অনেক অভিবাবক অন্যদের খোঁজ খবর নিচ্ছেন কিংবা ছাউনির নিচে বসে খোস গপ্পে মেতে উঠেছেন কিন্তু সেটা যে শুধুমাত্র লোক দেখানো কিংবা মুখে মধু অন্তরে বিষ এটা বুঝতে দেরী লাগে না। যথারীতি চান্স পেলাম, পড়ালেখা চলছে। দুইবারই বৃত্তি পেলাম। অনেক বন্ধু পেয়েছি, হারিয়েছি। অনেকে ঝরে গেছে, অনেকে গাজাঁ খেয়ে হাসপাতালে যায়। তারপর আবার আমার আপুর কাছেই পরে। আপুর সামনে লজ্জায় মাথা নিচু। অনেকে অনেক মেয়ের পাল্লায় পরে ক্যারিয়ার নষ্ট করেছে, মেয়ে চায় না কিন্তু ছেলে তার জন্য পাগল। আমার এক বন্ধু ছিল, কেও যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করে, ইহজগতে আপনার কয়টা রিলেশন ছিল?? আপনি হয়তো হাতের আঙ্গুল গুনবেন। কিন্তু তাকে যদি একই প্রশ্ন করা হয় তাহলে যে গুনবে গাছের পাতা। ব্যাতিক্রম ও আছে। তবে নিজে কখনো কোন মেয়ের প্রতি ক্রাশ খাই নাই। মন থেকে কাওকে ভালো লাগে নি। কেন লাগেনি সেটা জানি না। হয়তো পড়াশোনা নিয়ে অনেক চাপে ছিলাম বিধায় আশেপাশে কিছু দেখতে পারি নি।

আমি মারাত্মক ভ্রমণপিয়াসী। রাজশাহী বাদে সব জেলাতেই গিয়েছি। তখন হাতে প্রচুর সময় ছিল। এখন নাই। না চাইতেই অনেক কিছু পেয়েছি, কিন্তু যেটা চেয়েছি সেটা মুখ ফুটে বলতেও পারি নি। পরিবারে আমার নিজস্ব ভাব প্রকাশ করার কোন ক্ষমতা ছিল না। বাবা মা যা বলেন তাই। তাই নিজের জীবনকে নিজের মতো সাজাতে পারিনি, তবে চেষ্টা করছি। ইন্টার পাশ করার পরে একরকম বাধ্য হয়েই আমাকে মেডিকেলে পরীক্ষা দিতে হল। ইচ্ছে ছিল ফেল করার। রোল পূরণ করার সময়ও ফেল করবোই, করতেই হবে এমন একটা মনোভাব ছিল। কিন্তু প্রশ্ন পাওয়ার পরে সে মনোভাব টা ধুলায় মিশে গেল। মেডিকেলে চান্স পেলাম, ভর্তি তো আমাকে হতেই হল। আমার ইঞ্জিনিয়ার হবার ইচ্ছা কে কবর দিয়ে সেখানে মেডিকেলের গাছ লাগালাম। যে গাছে পাতা খুবই কম, ফুল ফল তো নাই বললেই চলে। গিনেজ বুক নাকি ঘোষণা দিসে মেডিকেলের কোর্স নাকি সবচেয়ে কঠিন কোর্স। ভুল ত বলেনি। সারাদিন দৌড়ের উপর থাকতে হয়। একটু নিশ্বাস ফেলার সুযোগ পেলে পরবর্তী দৌড়ের কথা মনে পরে যায়। এতো কষ্ট করে ডাক্তার হব, তারপর একটু এদিক সেদিক হলেই বিপদ। তাছাড়া রোগীরা যা শুরু করেন তা বলে শেষ করার মতো না। সবকিছু ঠিকঠাক থাকার পরেও সেদিন এক রোগী স্যারকে যেভাবে শাসিয়ে গেল দেখে মনে হচ্ছিল উনি নিজেই ডাক্তার। ঈদের আগে এক রোগী আসছে, চিকিৎসা নেবার পরে বলতেছে স্যার গরীব মানুষ ভিজিট টা কম রাখেন। স্যার ও কম রাখলেন। পরে দেখলাম ঈদে কোরবানী দেয়া তার গরুর মূল্য ষাট হাজার টাকা। একাই কোরবানী দিসে। ডাক্তারের কাছে আসলেই মানুষ গরিব হয়ে যায়। যথারীতি কসাই উপাধি দেয়। আবার ঠিকই এই কসাই হবার জন্য নিজেদের ছেলেমেয়েদের উৎসাহ দিবে। অনেকে বলেন ডাক্তাররা একটু গায়ে হাত দিয়েই পাঁচশো টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই পাঁচশো টাকার জন্য সেই ডাক্তার কে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে তার কোন হিসাব নেই। ওই পাঁচশো টাকার লেভেলে যেতে তাকে শুধুমাত্র ডাক্তারিই পড়তে হয়েছে পনের থেকে ২০ বছর (ফেল করলে তো কথাই নাই। আর ফেল তো করবেই।) । সাথে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত ১২ বছর। মারহাবা!!!!! এতো কষ্ট করে যে আমাকে এক্সপার্ট হতে হবে এসব ত কখনো ভাবিই নাই। তাছাড়া এখনকার সময় এমবিবিএস ডাক্তারের কোন দাম নেই। নামের পেছনে এফসিপিএস আছে কিনা দেখে। নিজের ইচ্ছা কে কখনোই পুর্নাঙ্গ রূপ দিতে পারিনি। নিজেকে অসহায়ের মতো লাগে। কোন ফাঁদে পরলাম আমি তাই ভাবি। জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্তে আমি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি যার মাশুল হয়তো সারাজীবন আমাকে দিতে হবে। ডাক্তার হয়েও দেখবো প্রতিযোগিতা ভরা জগৎ। আবার বিসিএস। বাবা তো মুক্তিযোদ্ধা কোঠা আমাকে দিবেন না। “পড়াশোনা করে পাশ করবি, বাকি দশ জন যেভাবে পাশ করে সেভাবে করবি, নিজ যোগ্যতায় পাশ করবি।” পড়াশোনা করতাছি। করতেই আছি। এটা কবে শেষ হবে জানা নাই। শেষ হবে কিনা সেটাও প্রশ্নবিদ্ধ। এই পড়াশোনার মাঝেই নিজের জীবনকে গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করি। মাঝে মাঝে কান্না আসে। মনের কান্না মনেই থাকে বাইরে প্রকাশ করি না। মন খারাপ থাকলে আয়না দেখি। আয়না আমার ভালো বন্ধু। আমার খুশিতে সে খুশি আমার দুঃখে সে দুঃখি। বাকিদের মতো অট্টহাসিতে মেতে উঠে না। আয়নায় দেখা জীবন।

(যেমন খুশি তেমন লিখসি, ভুল ক্ষমা করবেন)

৬০৩জন ৬০৩জন
0 Shares

২৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ