অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের সন্তান আর নাতি পুতিদের সরকারী কোটায় চাকুরী দেয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল। ৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে নিরস্ত্র এবং ঘুমন্ত বাংগালীদের ওপর হানাদার পাকিস্তানী আর্মি নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং পরবর্তীতে মানুষ হত্যার পাশাপাশি নারী ধর্ষণ ঘর বাড়িতে অগ্নি সংযোগ লুটতরাজ ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে নির্মম নিষ্ঠুর জঘন্য অপরাধ শুরু করে। এমতাবস্থায় দেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে নিজেদের জীবনবাজী রেখে। শুধু একটাই চাওয়া দেশকে হানাদার মুক্ত এবং স্বাধীন করা। তখন কেউ জানতো না মাত্র নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তি যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত এবং দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। মুক্তিযোদ্ধারা কোনো প্রাপ্তি আর প্রত্যাশা নিয়ে যুদ্ধ করেনি। যারা যুদ্ধ শেষে জীবন নিয়ে ফিরে এসেছে তারাও জানতো না তাঁরা জীবন নিয়ে ফিরে আসবে। অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন, অনেকে আহত হয়ে পংগুত্ব বরণ করেছে সারা জীবনের জন্যে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বীরত্বের জন্যে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্র বীর শ্রেষ্ঠ, বীরোত্তম, বীর বিক্রম, বীর প্রতিকসহ বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করেছে। চাকুরীতে কোটা প্রদান করেছে দেশের স্বাধীনতার জন্যে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের স্বীকৃতি সরূপ। আজ শহীদদের রক্ত, মা বোনদের ইজ্জৎ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের ভিতের ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।আকাশে উড়ছে লাল সবুজের পতাকা। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক কোটা সংস্কার আন্দোলনে আজ মুক্তিযোদ্ধা আর তাঁদের পরিবারকে ভিলেন বানানো হয়েছে। দেশবাসীর কাছে এমন একটা ধারণা দেয়া হয়েছে যে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারই শুধু সরকারি চাকরিতে কোটা ভোগী। নৃ গোষ্ঠী, নারী, প্রতিবন্ধী এবং জেলা কোটা নিয়ে কারো কোনো উচ্চবাচ্য ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ যেন অনেকাংশে অপরাধ হয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কটুক্তি হেয় প্রতিপন্ন করার মধ্যে বাহবা পাওয়ার কিছু নেই। এতে শুধু যারা এসব করছেন তাঁদের হীন এবং সংকীর্ণ মন-মানসিকতার বহি:প্রকাশ ঘটছে মাত্র। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে দিলে এইসব পরিবারের দু:খ করার কোনো কারণ নেই কেননা তাঁদের পূর্বসুরীরা এই দেশটা মুক্ত স্বাধীন করে দিয়েছে। এর চেয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের চাওয়া পাওয়ার কিছুই অবশিষ্ট নেই। এহেন জটিল কঠিন অবস্থায় আমার নিজের কাছে মনে হয় একাত্তরের ছোট শিশু হিসেবে ৭০ এর নির্বাচনে আমিও মিছিল মিটিংয়ে যেতাম। আমাদের পরিবার মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় খাদ্যের ব্যবস্থা করায় পাক বাহিনীর তল্লাশী এবং আক্রান্ত হওয়ার জন্য আমাদেরকে গ্রাম ছেড়ে শহরে আশ্রয় নিতে হয়েছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে এবং সৌভাগ্যক্রমে আমাদের বাড়ি পাক হানাদার বাহিনীর আগুন দেয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। বাড়িতে না থাকায় আমার মেঝ চাচা ও মেঝ ভাই (যিনি ২৮ নভেম্বর’৭১ থেকে সম্ভবত ১২ ডিসেম্বর’৭১ পর্যন্ত মীর কাশেম আলীর আল শামস বাহিনীর টর্চার সেল ডালিম হোটেলে অমানবিক নিষ্ঠুর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন) এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে চলে যাওয়ায় সেঝভাই সহ তিন জনই পাক আর্মির হাত থেকে জীবন রক্ষা পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধে দেশের প্রতিটি পরিবার হানাদার বাহিনীর মাধ্যমে আক্রান্ত হয়নি। প্রতিটি পরিবারের সদস্যরা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি। প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ মারা যায়নি। যারা অংশ নিয়েছে, আহত বা নিহত হয়েছে বা মা বোনেরা ধর্ষণের শিকার হয়েছে বা বিভিন্ন হয়রানি ভোগান্তি দুর্ভোগ দুর্দশার শিকার হয়ে মুক্তিযুদ্ধের যন্ত্রণা আর ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে এবং প্রত্যক্ষ করেছে কেবলমাত্র তাঁদের হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধ লালিত পালিত হচ্ছে। যে বা যারা ভুক্তভোগী নয় তাঁদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ একটা কেচ্ছা কাহিনী মাত্র। আশার বিষয় হচ্ছে কোটা সংস্কার বিষয়ে রায় প্রদানকালে মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছেন — “মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাগণ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি লাল সবুজের পতাকা। তাদের প্রতি কোনো রকম অসম্মান অবশ্যই জাতি ভালোভাবে নেয় না। সংশ্লিষ্ট সকলকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে যাতে আমাদের কখনো কার্পণ্য না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে”।পাশাপাশি উক্ত শুনানিতে অংশগ্রহণকারী দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীরা মুক্তিযোদ্ধা কোটা তুলে দেয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন।বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা যারা এখনো জন্ম গ্রহণ করেনি তাদের জন্যে কোটা সংরক্ষিত রাখা উচিৎ হবে না। অনেক মুক্তিযোদ্ধা ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং তাঁদের সন্তানদের বয়স ৪০ বছর। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধারা অনগ্রসর কোনো জনগোষ্ঠী নন বরং এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং দেশের সম্মুখসারির নাগরিক। এমতাবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব নয়। তাই এই কোটা বাতিল করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মান-সম্মান আত্ম-মর্যাদা দেশের প্রতি তাঁদের সর্বোচ্চ ত্যাগ সমুন্নত রাখা দেশ জাতি এবং রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব এবং কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা, ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং ইজ্জৎ আভ্রুহারা দুই লক্ষ মা-বোনদের প্রতি গভীর এবং বিনম্র শ্রদ্ধা।
৫টি মন্তব্য
নাজমুল আহসান
কোটা একটা ভুয়া জিনিস। এটা অযোগ্য মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে বসানোর একটা ফিকির মাত্র। যাতে করে ওইসব সরকারি কর্মচারী সরকারের পা-চাটা গোলামে পরিণত হয়।
মুক্তিযুদ্ধ কোটা ট্যাগ ব্যবহার করা হয় পুরো জিনিসটাকে জায়েজ করার জন্যে। এরচেয়ে বেশি কিছু না।
মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বীর। কোটা দিয়ে “সন্মান করা” প্রকারান্তরে তাঁদের জন্যে অপমানজনক।
এইসব নষ্টামির অবসান হোক।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আমার বক্তব্যও তাই। ধন্যবাদ।
মোঃ মজিবর রহমান
বেশি গুয়ারতুমি ও ঘাউরার জন্য বিরাট এক দলের পতন হলো, যা ভাবিনি কল্পনাও করিনি। খুব কষ্ট
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আল্লাহ ছাড় দেন ছেড়ে দেন না।
আল্লাহ অহংকার পছন্দ করেন না।
হালিমা আক্তার
কোটা থেকে আর বের হলো কই। চমৎকার বিশ্লেষণ ধর্মী লেখা। দেশ টা ভালো থাকুক। শুভ রাত্রি।