” পাখি আমার খুবই প্রিয়। সবারই আসলে পাখি প্রিয়। দিন শেষে নীড়ে ফেরে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। যে কোনো পাখিই আমার অনেক প্রিয়। তাদের সম্পর্কে জানার আগ্রহও অনেক।

আমার নানার বাড়ি সুন্দরবনের কোলঘেসে মংলা পোর্টে। সন্ধের আগে পাখিদের নীড়ে ফেরার তাড়া থাকে। আমার এক খালামনির বাসা মংলা পশুর নদীর পাড়েই। খালামনির বাসার ছাদ থেকে ঝাঁক ঝাঁক পাখি দেখা যায়। দূরে হালকাভাবে সুন্দরবনের গাছগুলো দেখা যায়। পাখিগুলো সুন্দরবনের দিকে যাচ্ছে আসলে। খালামনি বলল এ পাখিগুলো সব সুন্দরবনের বিভিন্ন গাছে থাকে।
গোলপাতা, কেওড়া, সুন্দরী ইত্যাদি গাছে।

মংলা জয়মনি গোল নামে একটি জায়গা আছে। মোংলা শহর থেকে পাকা রাস্তা হয়েছে ওখানে যাবার জন্য। এতো সুন্দর এক অনুভূতি হয় সে রাস্তা থেকে যেতে, তা আপনারা যখন যাবেন উপলব্ধি করতে পারবেন। আসলে এই জায়গাটাও সুন্দরবনের অংশ। এক সময় ছোটো ছোটো খাল পাড় হয়ে এসব জায়গায় নাকি বাঘ চলে আসতো।

নানাবাড়িটা আমার খুব ভালো লাগে। একদম অন্যরকম একটা পরিবেশ। বড় বড় নদী। সাথে ছোটো ছোটো শাখা নদী। পুকুর। পুকুর ভরা মাছ। একবার আমি বর্শিতে মাছ ধরতে গিয়ে বর্শির সাথে বিঁধে থাকা মাছের সাথেই পানিতে পড়ে গেছিলাম। আমি সাতার জানিনা। তাই বেশ একটু নাকানি–চুবানি খেয়েছিলাম সেবার। বড় খালামনি পানি থেকে আমাকে তুলেছিলেন।

নানার বাড়িতে বেশি থাকা হয়না যাওয়াও হয়না। কারণ আমরা এখন দাদুবাড়ি সৈয়দপুরে থাকি। সৈয়দপুর আর খুলনা মংলা বাংলাদেশের দুই প্রান্তে। যাতায়াতের অসুবিধা খুব। এজন্যে আমার খুব ইচ্ছে হয় এমন একটি যানবাহন তৈরি করবো যা মনের গতির সাথে দ্রুত চলতে পারবে।

আমার দাদুবাড়িটা সৈয়দপুর রেল কলোনিতে। আমরা যে ঘরটাতে থাকি সে ঘরের পিছনে একটা বেত ঝাড় আছে। জানালা খুললেই বেত গাছের চিকন কাঁটা যুক্ত লতা ঘরে ঢুকে যেতো। তাই মা জানালাটা প্রায়ই বন্ধ রেখে দিতো। আমরা দুই ভাই এ রুমে বসেই পড়তাম। মা আমাদের দুই ভাইকে লিখতে দিয়ে ফাঁকে ফাঁকে বাসার টুকটাক কাজ করে। আমার একটা অভ্যাস ছিলো, রাবারের মাঝ বরাবর পেন্সিল ঢুকিয়ে দিয়ে ঘুরানো। রাবারের চোখ বানাতাম, নাক বানাতাম। পেন্সিলের মাথা ভেঙে যেতো এটা করতে গিয়ে। তাই বারবার সাপনার করতাম। পেন্সিলও তাই তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যেতো। মা একদিন এ কারণে মাইর দিয়েছে। তাই অনেক সময় ভয়ে জানালা খুলে ফেলে দিতাম।

একবার বেশ কয়েকদিন পর জানালাটা খুলে দেখি একজোড়া পাখি বসে আছে। একজোড়া ঘুঘু পাখি। আমি দেখে চিৎকার করে উঠলাম খুশিতে। দৌড়ে মাকে ডাকতে গেলাম। ভুলেই গেলাম আমার হাতে নষ্ট করা রাবার আর পেন্সিলের গুড়ো। মা কটমট করে আমার হাতের দিকে তাকালো লাগলো। কিন্তু আমার সেদিকে খেয়াল নেই। আমার উচ্ছ্বাস দেখে মাও ভুলে গেলো বকা দিতে। আমার ছোটো ভাইও চিল্লাতে লাগলো। আমাদের চিল্লাচিল্লিতে পাখিটা উড়ে গেলো না। মা বললো, ওরা মনে হয় ডিম দিয়েছে। মা তাই তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে দিলো। আর বললো, জানালাটা না খুলতে। আমরা দুইভাই মাঝে মাঝেই জানালা একটু ফাঁকা করে ওদের দেখতাম। আমি তখন লায়ন্স স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ি। স্কুলে গেলেও পাখির চিন্তায় মাথা ঘোরে। আমার বন্ধু মায়িশা, জিম, রোজা, সুবহা, ওদের বাসায় এনে দেখালাম। বাসায় তখন শুধু একটি পাখি বসেছিলো। তার পেটের নিচে দুটো পাখির ছানা। কি দারুন দৃশ্য!

রাতে একদিন প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিলো। তখন শীতকাল ছিলো। মাকে বললাম, ওদের কষ্ট হচ্ছে না মা? মা বললো না। কারণ ওদের পালক এমন সব প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে রক্ষা করে। ছানা দুটিও এখন ওর মায়ের পেটের নিচে পালকের মধ্যে আছে। সমস্যা হবে না। প্রকৃতিই তাদের এমন বৈশিষ্ট্য দিয়ে তৈরি করেছে। আমার ছোটো ভাইটা এ কাজ করে। শীতের সময় ও মাকে বলে ওর পা দুটো আম্মুর পেটের ভেতর নিয়ে রাখতে, তাহলে নাকি ওর শীত লাগে না। ও মায়ের হাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। আম্মুও ওকে এভাবেই নয়ে ঘুমিয়ে থাকে।

আমার তবু্ও ঘুম হয় না। আমি ভাবি, আমাদের টিন্র বাতাসের জোরে এতো শব্দ হচ্ছে তাহলে ওদের কতো কষ্ট হচ্ছে।

সকালে চকচক করে রোদ উঠেছে। আমার খুব খুশি লাগতে লাগলো। জানালাটা খুলে আগেই ওদের দেখলাম।

স্কুল কখন ছুটি হবে এই চিন্তা করতে করতেই ছুটি হলে বাসায় এসেই ওদের দেখতে জানালাটা খুললাম। বুকটা আমার ধকধক করে উঠলাম। মাকে দৌড়ে ডেকে আনলাম। আমার কান্না দেখে আম্মু অস্থির। আম্মু গেট খুলে পিছনে গেলো। গিয়ে দেখি বাসাটা ভেঙে নিয়ে গেছে পাশের বাসার দুষ্ট ছেলে গুলো। আম্মু ওদের বকা দিয়ে বাসায় আসলো।

আমার প্রচন্ড মন খারাপ হলো। এক মুহূর্তে কিছু দুষ্ট ছেলে পাখির বাসাটা ভেঙে দিলো। আমার মন খারাপ দেখে রাতে আম্মু আমাকে পড়ালেন না। আমরা গল্প করলাম। আম্মু বললো, পাখিগুলো দুর্বল ছিলো বলে তারা তাদের বাসস্থানকে রক্ষা করতে পারলো না। নিষ্ঠুর মনের কিছু মানুষের খাম–খেয়ালির জন্যে তাদের বাসাটা ভেঙে গেলো।

আম্মু বললো, পৃথিবীতে দুর্বলের কোনো জায়গা নেই। প্রকৃতিও তা মেনে নেয় না।

সেরকম আমরা বাঙ্গালীরা যদি এ পাখির মতো দুর্বল হতাম তবে এরকম এক খাম–খেয়ালি শাসক পাকিস্তানি গোষ্ঠী আমাদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতো। বাংগালী হিসেবে আমাদের কোনো অস্তিত্ব থাকতো না। কিন্তু এই বাঙ্গালীরাই শক্ত হাতে আমাদের মাতৃভাষা রক্ষা করেছে। প্রাণ দিয়ে দিয়ে রক্ষা করতে হয়েছে এ মাতৃভাষা। তাইতো কথায় আছে ‘” দাম দিয়ে কিনেছি স্বাধীনতা “।

আমি এসব কিছু তখন বুঝতাম না। তাই কখন যেনো ঘুমিয়ে গেছিলাম। ”

আশ্রয় নামের এই গল্পের লেখক জুহায়ের আফতাব মেমন। নবম শ্রেনীতে পড়া এক কিশোর। বাবা পুলিশ কর্মকর্তা জুলফিকার আলী আর গৃহিণী মা সুলতানা জাহান রিতু বড় ছেলে। সম্প্রতি মহান একুশে বই মেলায় প্রকাশিত তার প্রথম গল্পের বই ” মেমনের গল্প গুচ্ছ ” তারই লেখা। বইটিতে মোট নয়টি গল্প আছে। প্রতিটি গল্পই ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে সুন্দর করে লিখেছে। গল্পগুলোতে সে নিজের ভাবনা, তার প্রিয় মানুষ,তার ভালো লাগা–মন্দ লাগা সব কিছুই খুব সুন্দর করে তুলে ধরেছে। একজন কিশোর যদিও তার পৃথিবীতে বিচরণ শুরু করেছে অল্প কিছুদিন, তারপরেও সে তার ঐটুকু সময়ের কথা গুলো কতো চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছে তা রীতিমতো ভাবনার বিষয়। যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক অনেক মানুষ চাইলেও ঠিক মতো লেখার ল টাই লিখতে পারে না।

মেমনের বইয়ের প্রতিটি গল্পই ভালো। আমি এই গল্পটা ব্লগে দিয়েছি কিছু কারণে। প্রথমত গল্পটা ছোটো। এই গল্পে সে তার মা, ভাই, খালামনি, নানাবাড়ি, দাদুবাড়ি, মংলা ভ্রমণের ছোট টিপস, নিজের এক যানবাহন তৈরির পরিকল্পনা, পাখি প্রেম, এবং পেন্সিল–রাবার নিয়ে দুষ্টুমির কথা অকপটে বলে দিয়েছে যা একটি কিশোরের সহজাত বৈশিষ্ট্য।

পরেরবার, স্বাধীনতা ও মাতৃভাষা নিয়ে তার অগাধ উপলব্ধি, যেটা কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়। এই বয়সে এমন উপলব্ধি করাটাই বলে দেয় কিশোর মেমনের ভাবনা জগৎ কতটা ধীর ও পরিপূর্ণ।

অথচ, এই বই মেলাতেই প্রকাশিত হয়েছে সাবা খান নামের আরেক উঠতি লেখকের একটা বই। যে কিনা ভাষার মাসেই মাতৃভাষা বাংলাভাষার বারোটা বাজিয়ে দিতে একটুও কার্পণ্য করেনি। এরা দেশকে ভালোবাসবে কি করে যারা ভাষার প্রতিই যত্নশীল নয়। মেমনের লেখাতে তার দেশের প্রতি, ভাষার প্রতি শুধু ভালোবাসাই নয় মমতাও প্রকাশ পেয়েছে। আমরা আশাবাদী, সাবা খানের মতো লেখকদের বিলুপ্ত করবে মেমনের মতো লেখকেরা। সবশেষে মেমনের প্রতি রইলো অনেক আদর, ভালোবাসা আর অঢেল শুভকামনা। ও যেনো শিক্ষা–দীক্ষা, মানে–মনে অনেক বড়ো হয়ে উঠে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি।

* বই সম্পর্কিত তথ্য *

★ মেমনের গল্পগুচ্ছ
লেখক– জুহায়ের আফতাব মেমন
প্রচ্ছদ – এম.আসলাম লিটন
প্রকাশক– এবং মানুষ
পরিবেশক– জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, মুক্তিভবন
মূল্য– ১৪০/=

★ অনলাইনে যোগাযোগ করে বই পেতে হলে–

www.rokomari.com

১৬১৫জন ১৩৪১জন
0 Shares

৩৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ